মঞ্চ, নাটক এবং চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা অভিনেত্রী মনিরা ইউসুফ মেমী। আবৃত্তিকার হিসেবেও বেশ পরিচিতি আছে তার। টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন বহুদিন ধরে। এখন আর আগের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তার অভিনয় এবং বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে কথা হয় আনন্দভুবনের সঙ্গে। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল ...
মনিরা ইউসুফ মেমীর জন্ম ২১ অক্টোবর, বরিশালে। নিজ গ্রামে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেন। মেমীর শৈশব কেটেছে একেবারে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে। নদীতে সাঁতার কেটেছেন, শিশির ভেজা ঘাসে হেঁটেছেন। ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। জীবন ছিল খুব সিস্টেমেটিক। তিন-চার বছর বয়স থেকেই খেলাঘরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাছাড়া গার্লস গাইড, রেড ক্রিসেন্ট, উদীচী, শিল্পকলা একাডেমিতে নাচ, গ্রুপে থিয়েটার এগুলো করে কেটেছে। সুন্দর একটা শৈশব ছিল মেমীর। নাটক, আবৃত্তি, অভিনয় করতেন ওই সময় থেকেই। মেমীর প্রথম নাটক ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’। মমতাজ উদদীন আহমেদের লেখা, মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনায় ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ডিসেম্বরের বিশেষ নাটক হিসেবে প্রচার হয়েছে।
বর্তমান ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেমী বলেনÑ আমি এখন অভিনয় করি না। করতে ইচ্ছে করে। করি না এই জন্য যে আমাদের চরিত্রগুলো লেখকেরা লেখেন না। লিখলেও হয়ত সেটা আমার ভাগ্যে জোটে না। গতানুগতিক চরিত্রে অভিনয় করতে ভালো লাগে না। সেজন্য এখন অভিনয় করি না বললেই চলে। এখন আমার ব্যস্ততা হচ্ছে রূপ কম্যুনিকেশনস নামে আমাদের একটি অর্গানাইজেশন আছে সেখানে আমি গত চার-পাঁচ বছর ধরে সিরিয়াসলি বসছি। আমি ডকুমেন্টারি করি, টিভিসি করি, কর্পোরেট ইভেন্টগুলো করি। ক্যামেরার পেছনে চলে গেছি।
মানানসই চরিত্র হলে অভিনয় নিয়মিত করবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেনÑ আমি কখনোই নিয়মিত অভিনয় করিনি। নিয়মিত করব না, তবে হ্যাঁ, ভালো লাগলে করব। চরিত্রনির্ভর গল্প এখন অনেকটাই কমে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে গল্প এবং নাটকগুলো সীমাবদ্ধ থাকে। এই বিষয়টাকে আপনি আসলে কীভাবে দেখেন- এই কনসেপটা আসলে পাল্টানো উচিত। পাল্টানোর জন্য সবার আগে সমন্বয় দরকার। একটা চ্যানেল, রাইটার, ডিরেক্টর এবং যারা স্পন্সর করেন সবাই মিলে একটা সমন্বয় দরকার। কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমি মনে করি এরকম সাহসী দায়িত্ব যদি কেউ নেয় তাহলে আমি অভিনয় করব। এটা করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। জাস্ট সবাইকে একমত হওয়া, পৃষ্ঠপোষকতা করা।
মঞ্চ, রেডিও, চলচ্চিত্রের কথা জানতে চাইলে বলেনÑ মঞ্চ নাটকটি আমার আসল। আমি মঞ্চনাটক করার জন্যই ঢাকায় এসেছি। বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই যে, আমি মঞ্চনাটক করিনি। আমি আইসিসিআরের আমন্ত্রণে কলকাতা, দিল্লি, জয়পুরে মঞ্চনাটক ‘জমিদার দর্পণ’ করেছি থিয়েটারের হয়ে। বেতার প্রচুর কাজ করেছি। একেকটি মাধ্যম একেক রকম। সুতরাং কোনোটা ছেড়ে কোনোটা হতে পারে না। একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি মনে করি সমস্ত মাধ্যমেই কাজ করা উচিত। ‘মন মানে না’ চলচ্চিত্রে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম অভিনয় করি। তারপর লালসালু, লালটিপ, অনুদানের ছবি পুত্র, কালো মেঘের ভেলাসহ আরো কিছু ছবিতে কাজ করেছি।
আপনাদের প্রজন্ম এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে পার্থক্য করুন- পার্থক্য মানে আমি কোনোটির কিছু বলতে চাই না কারো সম্পর্কে। আসলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যখন যে-রকম যুগ এখন তার সেই ভাবেই কাজ করতে হবে। এখন যেমন ইন্টারনেটের যুগ। সারাদুনিয়াই এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের টেকনিক্যাল সাইট অনেক ডেভেলপ করেছে। এখন তো প্রজন্মের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের আসলে সমন্বয়ের ব্যাপার আর কিছু নয়। এই শিল্পটা যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে সবার সচেতন হওয়া উচিত। আমি আসলে প্রজন্ম নিয়ে কী বলব, আমরা যখন ঢাকায় গ্রুপে থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য আসি তখন আমাদের সময়ে অভিনয় করে বেঁচে থাকা, পয়সা ইনকাম করা, এটা দিয়ে সংসার চলবে, বাড়ি কিনবো, গাড়ি কিনবো এগুলো চিন্তাও করতে পারতাম না। এখন সেরকম অবস্থা হয়েছে, মানুষ ইনকাম করছে। এসবের জন্য আমি প্রজন্মের দোষ দেব না। আসলে আমাদের সিস্টেমের দোষ দেব। আমাদের সমন্বয়ের অভাব। সমন্বয় যদি ঠিকমতো থাকে তাহলে সব শিল্পীই টিকে থাকবে। সবাই সম্মানের সঙ্গে থাকবে এটাই আমার মনে হয়।
বর্তমান প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী- সত্যি কথা হচ্ছে, আগে একজন শিল্পী তিনটা নাটক করে যে টাকা পেত এখন সেই টাকা পাওয়ার জন্য তাকে সাত-আটটা নাটক করতে হচ্ছে। আগে পেমেন্টের সিস্টেম ছিল একরকম এখনকার সিস্টেম আরেক রকম। যাই হোক সেই ইনকামটা করার জন্যই সে দশটা নাটকে অভিনয় করছে। মোট কথা লোভ-লালসা কমিয়ে শিল্পীরা যদি একটু অভিনয়ের দিকে যত্নশীল হয় সেটাই মনে হয় ভালো। একটু সময় দিয়ে ভালো করে স্ক্রিপ্ট পড়া, ভালো করে অভিনয় করা এগুলো আর কি। আমি অভিনয় না করলেও কিছু খবর জানি। এখন নাকি এরকম হয়ে গেছে যে, এই নায়কের সঙ্গে এই নায়িকা অভিনয় করবে। মানে জুটি হয়ে গেছে। সেখানে অনেকেই এখন যারা নিয়মিত কাজ করছে তারাও নাকি কাজ করতে পারছে না। যারা প্রফেশন হিসেবে অভিনয়কে নিয়েছে তারা অনেকেই বিপাকে আছে। একসময় তারা অনেক নাটক করেছে, তাদের একটা ভালো ইনকাম ছিল এখন সেটা হচ্ছে না। একচেটিয়া কিছু শিল্পীই নাকি অভিনয় করছে। সুতরাং আমি বলব আমাদের সিস্টেমেরই দোষ। আমাদের সমন্বয়ের অভাব। আমাদের ওইরকম চক্র যদি থেকে থাকে আমি বলব সেটা না থাকাই ভালো। আমি এটাই বলবো। তারপর চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে অভিনয় করা উচিত।
এখন আমাদের দেশে নাটকে একটা জিনিস প্রায়ই দেখে থাকি যে, রান্না করেও যে মেকআপ গেটআপ আবার বেড়াতে যাচ্ছে ওরকমভাবেই। মানে আলাদা করা যাচ্ছে না কার ক্যারেক্টার কী। মেকআপ খুব চড়া। চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সে একটা কসটিউম মেকআপের বিষয় আছে সেগুলো মনে হয় আগে খেয়াল করা উচিত। যতটুকু নাটক দেখি তাতে আমার কাছে এরকম মনে হয়। এই, আর কী বলবো।