আফরোজা বানু ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মঞ্চে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। এর আগে বাংলাদেশ বেতারে নাটকে অভিনয় এবং উপস্থাপনা শুরু করেন গুণী এই শিল্পী। যারা টেলিভিশনে নাটক দেখেন তাদের কাছে আফরোজা বানু পরিচিত একটি নাম। আগে নিয়মিত নাটক করতেন বর্তমানে ছেলেমেয়ের কাছে কানাডায় যাওয়া আসার কারণে সংস্কৃতি অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তার ব্যস্ততা এবং প্রবাস-জীবনের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দভুবনের সঙ্গে। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল ...
আফরোজা বানুর জন্ম ১৫ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানার গোপীনাথপুর গ্রামে। আফরোজা বানু ঢাকার অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ বেতারে অভিনয় এবং অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে শুরু করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে থিয়েটারে যোগ দেন। ওই বছরই থিয়েটারের হয়ে ফেরদৌসী মজুমদারের নির্দেশনায় এবং মমতাজ উদদীন আহমেদের নাট্যরূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বোন’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। রেডিওতে কাজ করার সময় এক সময়ের স্কুল শিক্ষক ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তার কাছ থেকেই মূলত আফরোজা বানু অভিনয়ের অনুপ্রেরণা পান। তিনিই আফরোজা বানুকে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হতে বলেন। সেখান থেকে আস্তে আস্তে থিয়েটার, রেডিও এবং টেলিভিশনে জড়িত হন আফরোজা বানু। টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘মরা মানুষের পাঠশালা’ নাটকে। অভিনেত্রী হিসেবে তারকাখ্যাতি পান বেগম মতাজ হোসেনের রচনায় এবং রহমতউল্লাহর প্রযোজনায় ‘সকাল সন্ধ্যা’ ধারাবাহিক নাটকে শিমু চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। মঞ্চ এবং ছোটপর্দার বাইরে বড়োপর্দায়ও অভিনয় করেন। ওয়াকিল আহমেদের নির্দেশনায় ‘কে অপরাধী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বড়ো পর্দায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন আফরোজা বানু।
সা¤প্রতিক সময়ে ব্যস্ততার কথা জানতে চাইলে বলেন, ব্যস্ততা বলতে আমি করোনার আগে থেকে কানাডায় আছি। ছেলেমেয়ের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। করোনা শুরু হওয়ায় আর দেশে আসতে পারিনি। ওখানেই ছিলাম গত আড়াই বছর। দুই মাসের জন্য দেশে এসেছি। এসে একটু বাসার গোজগাজ করলাম। আবার চলে যাব। দেশে এসে কোনো কাজকর্ম করিনি। করিনি মানে ছুটিকালীন একটু তাড়াহুড়ো, পারিবারিক কাজ এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে কোনো কাজ এই মুহূর্তে করিনি। সামনের বছর যদি ফিরে আসি তাহলে তখন হয়ত করার ইচ্ছে আছে।
দেশে এসে আগের মতো নিয়মিত অভিনয় করবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন কিছুই বলতে পারছি না। কোভিডের কারণে সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। ওদের একটাই ভয় আমাকে নিয়ে, আমি বাইরে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কে দেখবে। বাসায় তোমরা দুইজন লোক [আমার হাজবেন্ড অবসরে চলে এসেছে]। ওরা বলে বাবা একটা বাসায় থাকবে তুমি বাইরে কাজ করতে যাবে কোনো কিছু হলে আমরা দেখাশোনা করতে পারবো না এ অবস্থায়। আসলে ওরা ওদের কাছেই রাখতে চায় আমাদের। ওখানে ফিরে যাওয়ার পরেই বলতে পারবো। এখন বলা খুব কঠিন। ওদের কাছে অনেকদিন ছিলাম তো তাই পারিবারিক কিছু কাজেও ওদের আমাকে এখন প্রয়োজন আছে। আমার যেতে হবে আর কি। তারপরেরটা অতো ভাবি না। যা হয় হবে।
কানাডায় কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বা ওখানে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছেনÑ আসলে আমি যেখানে থাকি ওখানে বাঙালি কম। ওখানে কোভিডের সময় কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। আমি হাইকমিশনের সঙ্গে শুধু দু’চারটি অনুষ্ঠান করেছি। আমি অটোয়ায় থাকি। ক্যালগেরিতে থাকলে করা যায়। ওখানে অনেক বাঙালি সংগঠন আছে। অটোয়াতে ওইভাবে বড়ো কোনো সংগঠন নেই। যদিও ছোটো কয়েকটা অর্গানাইজেশন আছে। কোভিডের কারণে সেগুলোতে আমার যাওয়া হয়নি। কানাডায় কোভিডের বিধিনিষেধ খুব কড়া ছিল। ওখানে সিনেমা হল, থিয়েটার হলগুলো বন্ধ ছিল। কোনো অনুষ্ঠানই করতে দেওয়া হয়নি। এখন আস্তে আস্তে খুলছে। তাছাড়া কানাডায় এত বেশি ঠান্ডা, এখনো পুরোপুরি বরফ গলেনি। যার কারণে ওখানে এই সময়ে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। জুন-জুলাই মাসে ওখানে গরমকাল শুরু হবে তখন দেখা যাবে কী হয়। তখন বড়ো ধরনের কোনো কাজ না করলেও কিছু কাজ হয়ত করবো। আবার নাও করতে পারি। আমি তো অভিনয় করি, ওখানে থিয়েটারের দল গঠন না করলে আমার করার কিছু নেই। আর আমি যে দল গঠন করবো সে সিচুয়েশন নেই। জুনিয়র ছেলেমেয়েরা যারা আছে তারা হয়ত করতে পারে। আসলে আমার মনে হয় না অটোয়াতে এরকম কিছু হবে। ওখানে বাংলা কেরাবান নামে একটি সংগঠন আছে। ওরা বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজ করে, গানের অনুষ্ঠানই বেশি করে এবং শিশুরাই জড়িত। আমি ওখানে একুশে ফেব্রæয়ারিতে একটা নাটকে অভিনয় করেছিলাম, সেটা মূলত ইংরেজি নাটক। ওখানকার শিশুরা অনেকেই আছে যারা একুশে ফেব্রুয়ারি বোঝে না। তাই পুরো বাংলায় করলে বুঝবে না। তারপর তো মার্চের পরে কোভিডের কারণে একদম লকডাউনে চলে যায়। তারপর আর কোনো অনুষ্ঠান হয়নি।
আপনাদের সময় অনেক মানসম্মত নাটক নির্মাণ হয়েছে। যেগুলোতে অভিনয় করে অনেকেই তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। এখন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আফরোজা বানু বলেন, এর মূল কারণ আমার মনে হয় সময় পাল্টে গেছে, যুগ পাল্টে গেছে, টেকনোলজি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন সবাই ওটিটি প্লাটফর্ম, নেটফিল্ম, ইউটিউবে নাটক দেখতে পাচ্ছে। নানান ধরনের ওয়েব সিরিজ নানান নামে যাচ্ছে। আর এখন টেলিভিশন চ্যানেলও তো অনেক। আগে শুধু বিটিভি ছিল এখন একটার পর একটা চ্যানেল আসছে। যার কারণে নাটকের সংখ্যাও বাড়ছে। এক সময় একুশে টেলিভিশনে অসাধারণ সব নাটক প্রচার হতো। সেটা কিন্তু বিটিভি যুগের পরে এবং তারপর আমরা দেখছি যে, এনটিভি, আরটিভি হলেই ভালো নাটক। এই সময়গুলো আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন শিল্পীরাও আসছে প্রচুর। একটা শাখা যদি নাটক ধরি সেখানে একজন নাট্যকার, একজন নির্দেশক এবং ভালো একজন শিল্পী তো একদিনে তৈরি হয় না। এটি একটি চর্চার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে আসে। আপনি ওয়ার্কশপ করে অভিনেতা বের করতে পারবেন। লেখক তো নিজের প্রতিভাগুণে আসে। সেই জন্য আমার মনে হয় ভালো নাটক হচ্ছে না। বিটিভিতে একসময় সপ্তাহে দুটি নাটক হতো। আর এখন দেখেন কতগুলো নাটক প্রচার হয়। বেশ কিছুদিন আগে আমি ৫০টির মতো গুণে দেখেছিলাম। এখন তো অনেক। ধরুন যদি ১০০টি নাটক মাসে তৈরি হয় তাহলে ১০০টিই কী ভালো হয় ? হয় না। তবে সেখানে দশ-বিশটি ভালো হয়। আনফরচুনেটলি আমরা হয়ত সব ভালো নাটক দেখি না। আবার ঈদের সময় মানুষ বসে থাকে ভালো নাটক দেখার জন্য। আমি একবার এক বাড়িতে গিয়ে দেখেছি তারা ঈদের নাটক দেখার জন্য পেপারে লাল কালি দিয়ে মার্ক করে রেখেছে। মানে কোন নাটকটা তারা দেখবে। একেবারেই ভালো নাটক হয় না তা কিন্তু নয়। আবার সব নাটকই যে ভালো হয়েছে সেটাও নয়। সেটা সম্ভবও না। আমি শুধু নাটকের ব্যাপারে বলবো না, সব অনুষ্ঠানেই আজকাল বাজেটের ব্যাপার আছে, অ্যারেঞ্জমেন্টের ব্যাপার আছে। সব মিলিয়ে হয়ত সব নাটক সেই মান অতিক্রম করে না। তবে এখনো ভালো নাটক হয়।
আপনাদের প্রজন্ম এবং বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে পার্থক্য করুন- আমাদের সময়ে মানুষরা ছিল সেই সময়ের আর বর্তমান প্রজন্মের যারা শিল্পী তারা এই সময়ের মানুষ। এই যে সামাজিক একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে সেটা কিন্তু সব মানুষের মধ্যেই এসেছে শুধু শিল্পী বলে নয়, সবার মধ্যেই আছে। সময় পাল্টাচ্ছে, যুগ পাল্টাচ্ছে, মানুষের শিক্ষা-দিক্ষা-সংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি সব পাল্টাচ্ছে এবং বর্তমান প্রজন্মের যে ছেলেটা বা মেয়েটা কাজ করতে আসবে সে বর্তমান সময়কে নিয়েই আসবে। সুতরাং তারা আমার মতো হতে পারে না। আমাকেই বরং চেষ্টা করতে হবে এই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। না হলে আমি টিকতে পারবো না। কারণ আমার মা খড়ির চুলায় রান্না করতেন, আমি গ্যাসের চুলায় রান্না করছি। এখন ইন্ডাকশন চুলায় করে। আমাকে ইন্ডাকশন চুলা ব্যবহার করতে শিখতে হবে। ননস্টিক ব্যবহার করতে শিখতে হবে, ব্যালেন্ডার করতে শিখতে হবে, এসি চালাতে জানতে হবে। হাত পাখা দিয়ে চলবে না। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের উদ্দেশে কিছু বলুনÑ আমি বলবো আমরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে যে কাজটা করি প্রথমত কাজটাকে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে তারপর এই কাজটা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। শিখতে হবে, বুঝতে হবে,। গান ভালো করে শিখে সুর লাগিয়ে যেন গানটি গাই। অভিনয় করতে হলেও ভালোবেসে শ্রদ্ধা রেখে বিষয়টি জেনে-বুঝে-শিখে যেন অভিনয় করি। আমি যেন আমার কাজটা ঠিকমতো করতে পারি, সদ্ভাবে করতে পারি। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। দুটো পয়সা পাব বলে যা ইচ্ছে তাই করলাম আমার মনে হয় সেই সময়টা পেরিয়ে গেছে। মাঝখানে একটা সময় ছিল তখন যা ইচ্ছে তাই করে দুটো টাকা উপার্জন করা যেত। এখন যারা টাকা দিচ্ছে তারা তার কাজটাকে একটা বড়ো জায়গায় নিয়ে মার্কেটিং করতে চায় এখন কিন্তু ভালো কাজ না করলে তারা কাজ পাচ্ছে না। এগুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
আবৃত্তি কেমন চলছে- আসলে যারা নিয়মিত আবৃত্তি করেন আমি তাদের দলের নই। আমি আবৃত্তি করতাম, এখনো করি। আমি বোধ হয় একটু সৌখিন আবৃত্তিকার। আমাকে কোথাও আবৃত্তি করতে বললে আমি একটু প্র্যাকটিস করে গিয়ে আবৃত্তি করেছি। আসলে যারা নিয়মিত আবৃত্তি করেন তাদের চর্চাটা অন্য রকম। তবে আবৃত্তিটা দরকার। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে তো গান, কবিতা এগুলো মিশে আছে। এগুলো না জানলে চলে না।