ইউটিউব ও অ্যাপে বাড়ছে নাটকের দর্শক

30 Jan 2022, 01:43 PM আকাশলীনা শেয়ার:
ইউটিউব ও অ্যাপে বাড়ছে নাটকের দর্শক

প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সেকেন্ডের মধ্যে চলে

যাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। আর এই কাজটির সহযোগিতা করছে গুগুল।

একটা সময় ছিল যখন আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল বিটিভি। সাদাকালো টেলিভিশনে যুগেও মানুষ মাসব্যাপী অপেক্ষায় থাকতেন সিনেমা দেখার। বিদ্যুতের তখন গ্যারান্টি না থাকায়, গ্রামের সবাই চাঁদা তুলে ব্যাটারি ভাড়া করে রাখতেন সিনেমা বা নাটক দেখার জন্য। এক গ্রামে একটি কিংবা দুটি টেলিভিশন থাকত, গ্রামের সবাই দল বেঁধে যেতেন যে বাড়িতে টেলিভিশন আছে সে-বাড়িতে। যুগের বিবর্তনে এই দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়। দেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে এটিএনবাংলা যাত্রা শুরু করে। বিনোদনেও আসে পরিবর্তন। এইভাবে দেশে যোগ হতে থাকে একের পর এক স্যাটেলাইট চ্যানেল। অনুষ্ঠানেও আসে পরিবর্তন। প্রতিযোগিতার এই সময়ে প্রতিটি চ্যানেল চেষ্টা করেছে ভালো মানের অনুষ্ঠান উপহার দিতে। যারা ভালো করেছেন, দর্শক তাদের সঙ্গেই ছিলেন। স্যাটেলাইট চ্যানেল বৃদ্ধি পাওয়ায়, ভাগ হয়ে যায় বাণিজ্যিক বিষয়টি। এতে করে কমতে থাকে বিজ্ঞাপনের রেট। বাড়তে থাকে বিজ্ঞাপনের ব্যাপ্তিকাল। বাড়তি বিজ্ঞাপনের জন্য দর্শকও হারাতে থাকে চ্যানেলগুলো। এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় ইউটিউব। বিরতিবিহীনভাবে যেকোনো কনটেন্ট দর্শক দেখে নিতে পারেন এক পলকে। যার ফলে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ইউটিউবের। তবে এখন ইউটিউবেও বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা বাড়ছে। যার ফলে দর্শক ঝুঁকছে অ্যাপের প্রতি। অ্যাপে কোনো বিজ্ঞাপন না থাকলেও এখানে পে করে দর্শককে নাটক কিংবা সিনেমা দেখতে হচ্ছে। আবার কিছু ফ্রি অ্যাপে স্বল্প বিজ্ঞাপনে কনটেন্ট দেখতে পাচ্ছেন দর্শক। হয়তো এক সময় ইউটিউবের প্রতিও মুখ ফিরিয়ে নেবেন দর্শক। জনপ্রিয়তা বাড়বে অ্যাপের।

ধরুন, আপনি মনোযোগ দিয়ে কোনো একটি কাজ করছেন, সেই সময়ে কেউ একজন আপনাকে ডেকে বা অন্য কোনো উপায়ে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করল, কেমন লাগবে ? নিশ্চিয়ই উত্তর আসবে বিরক্তিকর।

বিজ্ঞাপনচিত্রের বিরতি না থাকায় ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমে নাটক বা সিনেমা দর্শকদের স্বস্তি দিচ্ছিল, কিন্তু সেখানেও এখন বিজ্ঞাপনের চাপে বিরক্ত হচ্ছে দর্শক। বর্তমানে বিনোদনের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম হচ্ছে ইউটিউব। আর এই সুযোগটির সদ্ব্যবহারও করছেন তারা। শুধু নাটক বা গানই নয়, গোটা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে ইউটিউবে। একটা সময় যেখানে নতুন সিনেমার বিজ্ঞাপন করা হতো নানা কায়দায়, এখন সেখানে সিনেমার ট্রেইলারও ছাড়া হচ্ছে ইউটিউবে।

নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলিরা অনেকে এই প্ল্যাটফর্মকে মনে করছেন ‘বক্স অফিস’ হিসেবে। এখন ইউটিউবে যার ভিউ বেশি হচ্ছে, তাকে নিয়েই সবাই কাজের আগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে করে বাড়ছে নাটকের বাজেটও। আজ থেকে চার-পাঁচ বছর আগে যেখানে একটি নাটকের বাজেট ছিল ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে সেখানে খরচ হচ্ছে ৭ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। যেখানে নাটকে একজন শিল্পীর সর্বোচ্চ সম্মানী ছিল ৩০ হাজার টাকা, সেখানে এখন ৪০ মিনিট ব্যাপ্তি নাটকের জন্য শিল্পীকে প্রদান করতে হচ্ছে এক থেকে দুই লাখ টাকা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। কারণ একটি নাটক প্রচার করে চ্যানেলের যে-পরিমাণ অর্থ আসে তাতে একজন শিল্পীর বাজেটও আসে না। যার ফলে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষও স্যাটেলাইট চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলেও ঝুঁকছে। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় স্যাটেলাইট চ্যানেল ইউটিউব চ্যানেলে তাদের অ্যাকাউন্ট খুলছে। এরমধ্যে রয়েছে আরটিভি, মাছরাঙ্গা, বৈশাখী, এনটিভি, দীপ্তটিভি প্রভৃতি। স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারের পরপরই ইউটিউবে তাদের নাটক ও অন্যান্য কনটেন্ট তুলে দিচ্ছে। কতটা লাভজনক জানতে চাইলে কয়েকটি চ্যানেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে জানান, ইউটিউব ও গুগল থেকে মানুষ ভালো রোজগার করছে।

মানুষ যেভাবে ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝুঁকছে সে কারণেই তারাও এই দিকে বিনিয়োগ করছেন। ভিউয়ার প্রতি কত আয় তা নির্ভর করে কোথা থেকে কোন সময় দেখা হচ্ছে তার ওপর। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ইউটিউবের দর্শকরা বেশি দেখেন।

নিউজ পোর্টালেও এখন ইউটিউব চ্যানেল খোলা হচ্ছে। তবে ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে দর্শক মূলত বিনোদনমূলক কিংবা হালকা মেজাজের কন্টেন্ট দেখতে চায়, বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এই ক্ষেত্রটি লাভজনক হয়ে ওঠায় এখন বিনোদন জগতের অনেকেই সেদিকে ঝুঁকছেন।

সাধারণত টেলিভিশনে প্রচারের জন্যই নাটক তৈরি হতো এতদিন। ইউটিউব আসার পরে সেই নাটকগুলো টেলিভিশনে প্রচারের পর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হতো। এখনো এই ধারা চলছে। তবে বছরখানেক ধরে নতুন আরেক চিত্র দেখা গেছে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে। এখন ইউটিউবের জন্যই নাটক তৈরি হচ্ছে। সেই নাটকগুলো একবার প্রচারের জন্য বিক্রি করা হচ্ছে টিভি চ্যানেলে। তাতে টেলিভিশন থেকে এককালীন একটা অর্থ পাচ্ছেন প্রযোজক। আবার ইউটিউব থেকেও আসছে অর্থ।

শুধু টেলিভিশনের জন্য নাটক তৈরিতে যেখানে খরচ হয় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা, সেখানে ইউটিউবের জন্য নির্মিত বেশির ভাগ নাটকের বাজেট টিভি নাটকের চেয়ে অনেক বেশি। চার লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ইউটিউবের নাটকের পেছনে খরচ করেন প্রযোজকেরা। কোনো কোনো নাটকের বাজেট বেড়ে বারো লাখও হয়। কারণ, এখানে দু’ভাবে নাটক দিয়ে আয় করার সুযোগ রয়েছে। বছরখানেক ধরে ইউটিউবকেন্দ্রিক এসব বড়ো বাজেটের বেশির ভাগ নাটকই ইউটিউবে প্রকাশের আগে একটা মূল্য ধরে একবার প্রচারের জন্য টেলিভিশনের কাছে বিক্রি করছেন প্রযোজকেরা। এরপর প্রযোজকেরা তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করছেন নাটকগুলো। ডজনখানেক ইউটিউব চ্যানেল এই প্রক্রিয়ায় নাটক নির্মাণ করছে। এগুলোর মধ্যে আছে মোশন রক এন্টারটেইনমেন্ট, সিনেমাওয়ালা, ধ্রæব টিভি, সিডি চয়েস, ওজন এন্টারটেইনমেন্ট, এস এস মাল্টিমিডিয়া, গোল্লাছুট, সিএমভি, ক্লাব ইলেভেন প্রভৃতি।

ইউটিউবের জন্য নাটক নির্মাণ করে টেলিভিশনে একবার প্রচারের জন্য বিক্রি করছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘গানের ডালি’। প্রতিষ্ঠানটির সিইও শাহ আমির খসরু বলেন, আগে টেলিভিশনের জন্য তৈরি করে সে নাটক টেলিভিশনে প্রচারের পর ইউটিউবে আপলোড দিই। এখন টেলিভিশনের পাশাপাশি ইউটিউবের জন্য আমরা নাটক বানাচ্ছি। এই ছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠান তো রয়েছেই। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মোশন রক এন্টারটেইনমেন্ট শুধুই ইউটিউবের জন্য নাটক নির্মাণ করছে। এ পর্যন্ত বেশকিছু নাটক নির্মাণ করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাসুদ উল হাসান বলেন, টেলিভিশনগুলো কম মূল্যে এসব বড়ো বাজেটের ভালো শিল্পীদের নাটক প্রচার করার সুযোগ পাচ্ছে। আগে তো চ্যানেলগুলো বিশেষ দিনের জন্য ভালো শিল্পী ও গুণী নির্মাতাদের নাটক প্রচার করত। এর জন্য বেশি বাজেট লাগত। এখন ইউটিউব চ্যানেলের কারণে সারাবছরই কম খরচে ভালো মানের নাটক প্রচার করার সুযোগ পাচ্ছে টেলিভিশনগুলো।

শুধু ইউটিউব নয় ফেসবুক পেইজ, প্রাইম ভিডিও, টিকটক, লাইকি, ইমো প্রভৃতি থেকে আয় করা যাচ্ছে। দিনের বিবর্তনে, এই অঙ্গনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত সবাই ঝুঁকছে নতুনের দিকে...

লেখা : শেখ সেলিম