আমার ভেতরে অন্য সত্তা জেগে ওঠে -কঙ্কন দাশ

21 Sep 2021, 11:53 AM আবৃত্তি শেয়ার:
আমার ভেতরে অন্য সত্তা জেগে ওঠে -কঙ্কন দাশ

বাংলাদেশের সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মীদের তুলনায় বিভিন্ন জেলার সংগঠনগুলোর কর্মীরা সুযোগ সুবিধা কমই পেয়ে থাকেন। তারপরেও নানা সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে ঢাকার বাইরে নিয়মিত শিল্পের চর্চা করে চলেছেন নিবেদিতপ্রাণ অনেক শিল্পী। তেমনই একজন চট্টগ্রামের কঙ্কন দাশ। তিনি আবৃত্তি এবং অভিনয় দুটি মাধ্যমেই সক্রিয়। এবারের আবৃত্তির আয়োজন কঙ্কন দাশকে ঘিরে...

আনন্দভুবন : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পেশা ও পরিবার সম্পর্কে বলুন

কঙ্কন দাশ : চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে ৯ নভেম্বর আমার জন্ম। বাবা, বিশ্বেশ্বর দাশ, চট্টগ্রাম সিটি করেপোরেশন পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মা, মুকুল দাশও শিক্ষকতা করতেন। আমার স্বামী আশীষ রায় চৌধুরী পেশায় সফট্ওয়্যার প্রোগ্রামার এবং একটিমাত্র ছেলে কুশল রায় চৌধুরী। আমার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি মডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এরপর মাধ্যমিক পাশ করি ডা. খাস্তগীর সরকারি বিদ্যালয় থেকে, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ করি। এরপর বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএড করি। মা-বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি শিক্ষকতা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২১ বছর ধরে কর্মরত।

আনন্দভুবন : সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এলেন কেমন করে ?

কঙ্কন দাশ : ছেলেবেলা থেকেই নিজের আগ্রহে এবং পরিবারের সমর্থনে শিল্পের সঙ্গে পথচলা শুরু। শুরুটা হয় নৃত্য দিয়ে। নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাসের মাধ্যমে। এরপর একসময়ে বুঝে যাই পথ তৈরি হচ্ছে নাটক এবং আবৃত্তিতে। পরিবেশ, প্রকৃতি এবং যাদের সঙ্গে বড়ে ওঠা, সহ-অভিনেতা-অভিনেত্রী, বন্ধুরা, পরিচালক এবং গুণীজনেরা তারা কোনো-না-কোনোভাবে প্রস্তুত হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বদাই সাহায্য করেছে। সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আনন্দভুবন : কোন কোন সংগঠনে কাজ করেছেন ?

কঙ্কন দাশ : ১৯৮৬ সালে ‘শব্দ সড়ক’-এর মধ্য দিয়ে আবৃত্তিতে পথচলার শুরু। পরবর্তীসময়ে ‘প্রতিভাস’ নাট্য দল এবং ১৯৯১ সালে ‘প্রমা আবৃত্তি সংগঠনে’ যোগদান করি। তবে নাটকের ক্ষেত্রে আমি নিজ দল ‘প্রতিভাস’ ছাড়াও অরিন্দম, নান্দীমুখ, উত্তরাধিকার, একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস, শিল্পকলা একাডেমি, মঞ্চমুকুট, এক্টওয়ান, ইউনিভার্সিটি থিয়েটার দলের সাথেও বিভিন্ন প্রযোজনায় কাজ করেছি। এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন দলের সঙ্গে কাজ করে চলেছি।

আনন্দভুবন : আবৃত্তি ও অভিনয় এই দুই মাধ্যমে একসঙ্গে কীভাবে সময় দিচ্ছেন ?

আমি কাজ করতে এসে দেখেছি এবং জেনেছি যে, শিল্প একে অপরের পরিপূরক। আবৃত্তিতে যখন একটি কবিতাকে দৃশ্যমান করি, তখন নাটকীয়তার অনিবার্য প্রয়োজন। আর অভিনয় করতে যখন মঞ্চে দাঁড়াই তখন কোনো সংলাপ বা চরিত্রে আবৃত্তির মতো আবেগ দাবি করে। এই দুয়ের কোনো পার্থক্য বা প্রতিবন্ধকতা নেই বলেই আমি দুটোতেই সমানভাবে কাজ করতে পারি।

আনন্দভুবন : আপনার কাজগুলো সম্পর্কে      বলুন ?

কঙ্কন দাশ : ‘প্রমা’ আবৃত্তি সংগঠনে আমার নির্দেশনায় কাজগুলো হলো : সোজন বাদিয়ার ঘাট, মহুয়ার পালা, রাম রাবণের ছড়া, পরিচয়ে আমি বাঙালি, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, রঙিন ফানুস, ভাবি যাহা মনে। ‘প্রতিভাস’ নাটকের দলে আমার করা নাটকগুলো হলোÑ কিনুকাহারের থেটার, কোর্ট মার্শাল, জায়া প্রজায়িনী, শরতের মেঘ। এছাড়াও শিল্পকলার নির্বাহী সদস্য আমি। তাই বিভিন্ন প্রযোজনায় কাজ করে যাচ্ছি। যার মধ্যে আছে বধ্যভূমি, কানার হাট বাজার, রাজনীতির কবি, মেহেরজান, সোহরার রুস্তম।

উল্লেখযোগ্য আরো কাজের মধ্যে আছে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় নাটক ‘দুঃখিনী’ বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনার নাটক ‘মীনকন্যা’ বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের যৌথ প্রযোজনা ‘গ্লোবালাইজেশন ভার্সেস আইডেন্টি ফিকেশন’। উষা গাঙ্গুলীর পরিচালনায় ‘ইয়াসমীন’ এছাড়া, অরিন্দম প্রযোজনায় জলকন্যা, দুঁতিয়ার চাঁদ, নান্দিমুখ প্রযোজনায় লাললণ্ঠন, বেলা শেষের গল্প, উর্ণাজাল, অ্যাক্টওয়ান পরিচালিত ‘বৃত্তের বাইরে’, একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস-এর প্রযোজনা ‘আগুন পাখি’, মঞ্চমুকুট পরিচালিত ‘পুতুল খেলা’, উত্তরাধিকার প্রযোজনা- সাম্পাননাইয়া, মন তার শংকিনী, মৃত্যুপাখি, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার প্রযোজনা- ‘এন্টিগোনে’ শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজনা- বধ্যভূমি, মেহেরজান, সোহরাব রুস্তম, কানার হাট বাজার, রাজনীতির কবি, ফিল্মে অভিনয়- ‘ন ডরাই’ [২০২০-এর শ্রেষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কারপ্রাপ্ত ছবি], ভূমিকম্পের পরে, লড়াই, হলুদ শিখরে স্বপ্নের কোলাজ, খোলা হাওয়া। একক আবৃত্তি : আই.সি.সি.আর, ঢাকা আয়োজিত- আবৃত্তিসন্ধ্যা, বঙ্গীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে, শান্তিনিকেতনে একক পরিবেশনা। চ্যানেল ওয়ান, কলকাতায় একক পরিবেশনা, অবন মহল, ঢাকুরিয়া, কলকাতায় একক পরিবেশনা, কবিতালোক, ত্রিপুরায় একক পরিবেশনা, ভুবনেশ্বরী টেলিভিশন, ত্রিপুরা আয়োজিত একক পরিবেশনা, স্বাধীনতা ২০১৭, বাংলাদেশ হাইকমিশনার আয়োজিত অনুষ্ঠানে একক পরিবেশনা, মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে আয়োজন ‘রাঙ্গা সকাল’, তারা টিভি আয়োজিত ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ একক পরিবেশনা।

আনন্দভুবন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলুন

কঙ্কন দাশ : আমি ভবিষ্যতে আবৃত্তির একটা ইন্সটিট্যুট গড়তে চাই। যেখানে নাটক ও আবৃত্তি একযোগে কাজ করবে। এছাড়া কবিতামনস্ক ও শিল্পমনস্ক কিছু ছেলেমেয়ে তৈরি করা। এছাড়া, আমাদের যারা অগ্রজ, শ্রদ্ধার যেমন- শাঁওলী মিত্র, স্বাতী লিখা, তৃপ্তি মিত্র, ফেরদৌসী মজুমদার, শিমুল ইউসুফ, লাকী ইমাম, আরো যারা শ্রদ্ধাজন আছেন তাদের মতো করে কিছু নারী নাট্যকর্মীকে তৈরি করা। যারা আমাদের আজকের সমাজের এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে শিল্পের এই জগৎকে উত্তরোত্তর উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে।

আনন্দভুবন : শিল্পের অঙ্গনে কাজ করতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি ?

কঙ্কন দাশ : পারিবারিকভাবে প্রতিবন্ধকতা নেই। আমার স্বামী, সন্তান, মা এবং আমার পরিবারের সবাই সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই পারিবারিকভাবে আমার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে কিছু প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই আছে। সেগুলো বিশদ ব্যাখ্যা না করে আমি বলতে চাই নানা ধরনের অন্ধত্ব ও অন্যায্য সমালোচনা, ঈর্ষা ও হিংসার স্বীকার হতে হয় এবং এই সামাজিক প্রতিবন্ধকতা শিল্পের প্রতিটি শাখায় আছে। কিন্তু আমার কথা এই যে, এই প্রতিবন্ধকতা আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি ও পারবেও না। এটাই বাঙালি নারীদের সাহস ও গর্বের গল্প।

আনন্দভুবন : শিল্পচর্চার মাধ্যম হিসেবে আবৃত্তি কেন বেছে নিলেন ?

কঙ্কন দাশ : আমি কবিতা অন্তঃপ্রাণ। কিন্তু কবিতা লিখতে পারি না। যখনই কোনো কবিতা আমার মনে সুরের মতো বাজে, কোনো কবিতা রক্তকে ছলাৎ ছলাৎ করে জাগিয়ে তোলে, কোনো কবিতা অকারণে চোখের পাতা ভিজিয়ে দেয়। সেই কবিতাকে ধারণ করতে হলে আবৃত্তির কোনো বিকল্প নেই। কবিতা আবৃত্তি আমার নেশা।

আনন্দভুবন : প্রিয় কবি ও প্রিয় আবৃত্তি শিল্পী কে ?

কঙ্কন দাশ : প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজসহ আরো অনেকে। তবে বর্তমানে অনেকেই সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখছেন। আর প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী হচ্ছেন গোলাম মোস্তাফা, হাসান ইমাম, আসাদুজ্জামান নূর, কামরুল হাসান, শম্ভু মিত্র, গৌরী ঘোষ, পার্থ ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ আরো অনেক প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী রয়েছেন।

আনন্দভুবন : কোন ধরনের আবৃত্তি করতে পছন্দ করেন ?

কঙ্কন দাশ : আমি বিশ্বাস করি, মর্মস্পর্শী, মন আর্দ্র হয়, আমার ভেতরে অন্য সত্তা জেগে ওঠে, এমন ধরনের আবৃত্তি করতে খুব পছন্দ করি। তবে সবধরনের আবৃত্তিরই একটা সুখকর জায়গা রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আনন্দভুবন : একটা আবৃত্তি করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি কেমন থাকে ?

কঙ্কন দাশ : একেকটি কবিতা একেক ধরনের মেজাজ ও রুচি বহন করে। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বা জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ কিংবা রবীন্দনাথ ঠাকুরের কোনো কবিতা বা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ প্রত্যেকটি কবিতার নির্মাণ ভিন্ন হতে বাধ্য। প্রথমে কবিতা পাঠ করি এরপর আত্মস্থ করি। কবিতার ভেতরে প্রবেশ করি। নিজের মতো করে তুলতে চেষ্টা করি। এভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করি।

আনন্দভুবন : করোনার এই সময়টা কীভাবে কাটাচ্ছেন ?

কঙ্কন দাশ : অন্য সবার মতোই কাটাচ্ছি। সময়টা কেটে যায় ডিজিটালের এই যুগে অন্যভাবে। ধন্যবাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বায়বীয়ভাবে পুরো বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এছাড়া করোনাকালে পরিবারের সঙ্গে কাটানো দুর্লভ অনুভূতি রয়েছে। বিশ্বায়নে নিজেকে যুক্ত করার অসাধারণ অনুভূতি। এককথায়        বলা যায় “বিশ্ব সাথে যোগে যেথা বিহারে সেইখানে যোগ তোমার       সাথে আমারে”। 

লেখা : নিথর মাহবুব