বিনোদনের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম চলচ্চিত্র। আর এই চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে সরকার শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে। মাধ্যমটিকে এগিয়ে নিতে সরকার প্রতিবছর বেশকিছু সিনেমার জন্যে অনুদান প্রদানও করে। প্রতি বছরই বাড়ছে অনুদানের বরাদ্দও। কিন্তু কোনোভাবেই যেন এই মাধ্যমটিকে দাড় করানো যাচ্ছে না। এই দিকে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের কারণে এর অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। বেশকিছু ছবি মুক্তির জন্যে প্রস্তুত থাকলেও করোনার কারণে আটকে রয়েছে ছবিগুলো।
বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের থাবায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে বিনোদন মাধ্যম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে চলচ্চিত্র অঙ্গন। ছবি ঠিকই কমবেশি নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ থাকছে বন্ধ, নির্মিত ছবিগুলো থেকে যাচ্ছে বাক্সো বন্দি। এইদিকে বেশকিছু ছবি নির্মিত হয়ে পড়ে থাকা সত্ত্বেও মুক্তি দিচ্ছে না প্রযোজকরা। আবার পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি না পেয়ে সিনেমা হল বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন সিনেমা হল মালিকরা। সবমিলিয়ে দিনদিন সমস্যা বেড়েই চলছে। এই সমস্যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে চলচ্চিত্র বোদ্ধাশ্রেণির কোনো বৈঠক হয় না বলে অনেকে অভিযোগ করেন। সিনেমা হল উন্নয়নের জন্যে সরকার একটি বাজেট ঘোষণা করেন। কিন্তু বরাদ্দকৃত ঋণের টাকা এখনো পাচ্ছেন না সিনেমা হল মালিকরা। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির মধ্যেই সীমিত হয়ে আছে এই অর্থ। সিনেমা হল মালিকরা এমনও ভাবছেন এই ঋণ নিয়ে সিনেমা হল সংস্কার করলেও ছবি যদি পাওয়া না যায় তাহলে আয়ের অভাবে সেই ঋণ তারা শোধ করবেন কীভাবে। বিদেশি ছবি আমদানির জন্য সরকার চলচ্চিত্র সমিতিগুলোকে এক হয়ে আবেদন করতে বললেও সমঝোতার অভাবে তাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এফডিসি হয়ে পড়েছে পরিত্যক্ত ভাগাড়ের মতো আর সমিতিসর্বস্ব একটি সংস্থায়। সংস্থাটির নানা স্থাপনা ও রাস্তাঘাটের ভগ্নদশা দেখলে মনেই হয় না এটি চলচ্চিত্রের মতো দেশের প্রধান একটি গণমাধ্যম তৈরির সূতিকাগার। বৃষ্টিতে পানি জমে যায় এফডিসিতে, এতে করে চলচ্চিত্রের কাজ ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সিনিয়র চলচ্চিত্রকারদের কথায় যা আগে কখনো হয়নি। চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে অনেকের বিতর্কিত কাজের কারণে এই শিল্পটির প্রতি এখন সাধারণ মানুষের মনে নতুন করে নেতিবাচক ধারণা জন্মাচ্ছে। সবমিলিয়ে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে চরম দুঃসময় পার করছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প।
নানা কারণে দিনদিন হাহাকার বাড়ছে চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে। বলতে গেলে কয়েক দশক ধরেই চলচ্চিত্র শিল্প আইসিইউতে রয়েছে। এমন দাবি বরাবরই করে আসছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা মাসুদ পারভেজ। নব্বই দশকের শেষভাগে যখন আচমকা অশ্লীলতা চলচ্চিত্রের ওপর জেঁকে বসে তখন গুণী নির্মাতা ও শিল্পীরা মানসম্মান বাঁচাতে চলচ্চিত্রাঙ্গন ছাড়েন। তাদের স্থান মহাসমারোহে দখল করে নেন অশ্লীল নির্মাতারা। তাদের উলঙ্গপনায় মর্যাদাসম্পন্ন দর্শকও সিনেমা হলবিমুখ হয়ে পড়েন। যুক্ত হয় পাইরেসি আর নকল। নামিদামি প্রযোজনা সংস্থা আর সিনেমা হল বন্ধের দুঃখজনক অধ্যায় শুরু হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন নবাব-জমিদাররা, তা এসে পড়ে দুর্বৃত্তদের হাতে। এতে ধস নেমেছে এই শিল্পে। ফলে দেশি ছবির নাম শুনলে মানসম্পন্ন দর্শকরা নাক সিটকাতে শুরু করেন। বর্তমান সরকারের নানামুখী উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও কিছু মানসম্মত নির্মাতা-শিল্পী মাঝে-মধ্যে আশার আলো দেখালেও তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না। গেল বছর থেকে এসব সমস্যার সঙ্গে বৈশ্বিক মহামারি করোনা যোগ হওয়ায় চলচ্চিত্র শিল্প বলতে গেলে চলে গেছে কোমায়। ১৮ মার্চ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস করোনার কারণে সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ থাকে। ১৬ অক্টোবর সিনেমা হল খুললেও বেশির ভাগ প্রযোজক ছবি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তাদের কথায় করোনার ভয়ে সিনেমা হলে দর্শক কতটা আসবে তাতে সন্দেহ থেকেই যায়, তার ওপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমা হলের অর্ধেক আসন খালি রাখতে গিয়ে চলচ্চিত্রে লগ্নিকৃত অর্থ কতটা ফেরত আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রযোজকরা টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি চেয়েছেন প্রদর্শকদের কাছে আর প্রদর্শকরা বলেছেন, ছবি যে মানসম্মত এই গ্যারান্টি আগে দিতে হবে প্রযোজকদের। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে অক্টোবরে সিনেমা হল খোলার পরও উল্লেখযোগ্য ছবি মুক্তি পায়নি। এতে হতাশ প্রদর্শকরা।
করোনার কারণে যেসব ছবির মুক্তি আটকে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ পর্ব-১, ‘জ্বীন’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘পরাণ’, ‘দিন : দ্য ডে’, ‘ক্যাসিনো’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘কমান্ডো’, ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’, ‘সাইকো’, ‘সাহসী যোদ্ধা’, ‘পদ্মপুরাণ’ প্রভৃতি।
হল মালিকরা সিনেমা মুক্তি প্রসঙ্গে বলছেন ছবি মুক্তি দিতে প্রযোজকরা অহেতুক ভয় পান, ভালো গল্পের ছবি হলে, দর্শক হলে আসবেই। যত ভালো ছবিই হোক ছবি যদি নির্মাণের পর দীর্ঘদিন মুক্তি না দিয়ে ফেলে রাখে তাহলে সেই ছবির মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। দর্শকও ছবিটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ২৫ জুন সিনেমা হলে মুক্তি পায় শাকিব-মাহি অভিনীত ‘নবাব এল এল বি’ ছবিটি, এই ছবিটি গেল বছরের ১৬ ডিসেম্বর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায়। ছবিটি সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ায় ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হলসহ করোনার কারণে গত বছর থেকে দেশে বন্ধ থাকা অনেক সিনেমা হলই খুলতে যাচ্ছে। প্রদর্শকরা বলছেন, ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে বন্ধ থাকা হলগুলো ঠিকই খুলবে। দর্শকও হলমুখী হবে।