উত্তম কুমার হওয়ার চেষ্টা করা যায় কিন্তু হওয়া যায় না : আলমগীর

06 May 2021, 09:36 PM মুভিমেলা শেয়ার:
উত্তম কুমার হওয়ার চেষ্টা করা যায় কিন্তু হওয়া যায় না : আলমগীর

পরিবার চেয়েছিলেন তাদের সন্তান ডাক্তার হবেন। আর সন্তান চেয়েছিলেন গায়ক হবেন। কোনোটাতেই সফল হলেন না, সফল হলেন অভিনয়ে। বলছি দেশবরেণ্য অভিনয়শিল্পী আলমগীরের কথা। যার ক্যারিয়ারের প্রায় প্রতিটি ছবিই সুপারহিট। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন দুই শতাধিক ছবি। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র ও অন্যান্য পুরস্কার। গুণী এই শিল্পী বৈশি^ক মহামারি করোনা ভাইরাসে ছাড়ে নি তাঁকেও। এই প্রতিবেদন লেখা অব্দি তিনি চিকিৎসাধীন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনগাঁথা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আনন্দভুবন এর ঈদসংখ্যায় থাকছে বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন শেখ সেলিম...


১৯ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বরেণ্য অভিনেতা আলমগীর। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি ভালো আছেন।

বরেণ্য অভিনেতা আলমগীর ১৯৫০ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস বাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। তার পিতা কলিমউদ্দিন আহম্মেদ ওরফে দুদু মিয়া ঢালিউডের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ—’-এর একজন অন্যতম প্রযোজক।

১৯৭৩ সালে অভিনয়ে এসে প্রায় চার দশকে ২৩০টি ছবিতে অভিনয়, ৭টি ছবি নির্মাণ এবং নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন আলমগীর। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাও পান তিনি।

তিনি বলেন, অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন সবার মতো আমারও ছিল। তবে আমি গায়ক হতে চেয়েছিলাম। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হই। একসময় ছবিতে প্লে-ব্যাক করতে চলচ্চিত্র নির্মাতা সফদর আলী ভূঁইয়ার অফিসে গেলাম। তিনি আমাকে গাইতে বললেন। চোখ বন্ধ করে গাইলাম। তিনি বললেন, তোমার এক্সপ্রেশন খুব সুন্দর। তুমি চেষ্টা করবে নায়ক হতে। ছেলেবেলায় দিলীপ কুমার, উত্তম কুমার আর পরে রাজ্জাক সাহেবের ছবি দেখতাম। উত্তম কুমারের স্টাইল, ফ্যাশন, কথা বলার ভঙ্গি বেশ ভালো লাগত। বলতে পারি উত্তম কুমারের অনুপ্রেরণায় অভিনয়ে এসেছি। তবে উত্তম কুমার হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। চলচ্চিত্রে আসার ১০-১৫ বছর পর ঝুঝতে পারলাম উত্তম কুমার হওয়ার চেষ্টা করা যায় কিন্তু হওয়া যায় না। কারণ, উত্তম কুমার ওয়ান পিস। এই বোধ থেকেই বলতে পারেন নিজের মতো করে অভিনয় জীবনের পথ চলতে শুরু করলাম।

চলচ্চিত্র জীবনের কথা বলতে গিয়ে নানা স্মৃতি আওড়ান এই অভিনেতা। তিনি বলেন, এই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার সঙ্গে ‘শিল্পী’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ছবির নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম সাহেব যখন প্রস্তাব দেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে রিফিউজ করি। কারণ আমার সময় ছিল না। শেষ পর্যন্ত রুনা লায়লা নিজেই আমাকে অনুরোধ করেন। তার অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত শিল্পী ছবিটিতে কাজ করা।

নিজের সম্পর্কে আলমগীর বলেন, আমি খুব গোছালো একজন মানুষ। সুখ একটি আপেক্ষিক শব্দ। সুখের অর্থ কি? এর উত্তর কেউ জানে না। সুখের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কারও জীবনে পূর্ণ প্রাপ্তি আসে না। পূর্ণতার জন্য শুধুই সাধনা করে যেতে হয়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং দর্শকপ্রিয়তা, দুটিই আমি পেয়েছি। দুটি দুইরকম অর্থ বহন করে। দর্শকের ভালোবাসা হলো অনুপ্রেরণা। এতে কাজ নিয়ে পথ চলা সহজ হয়। দর্শক ছাড়া আমরা শূন্য। আর জাতীয় স্বীকৃতি প্রতিটি শিল্পীর পরম কাম্য। প্রতিটি শিল্পীর জীবনে এই স্বীকৃতি বিশাল অবদান রাখে, দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। কিন্তু জনগণই আমাদের সবকিছু।

সাফল্যের সূত্র প্রসঙ্গে আলমগীর বলেন, পৃথিবীতে কোনো জিনিসই সহজ এবং সস্তা নয়। যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা পেতে সাধনার বিকল্প নেই। কাজ করতে হবে সিনসিয়ারলি। ছেলেবেলা থেকে একটি জিনিস জেনেছি, আর তা হলো সাধনা। সাফল্যের সবচেয়ে বড়ো সোপান সাধনা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, এসব কিছু মিলিয়ে হলো সাফল্য।

তিনি বলেন, সবাই মনে করে আমি খুব রাশভারি লোক। আসলে আমি রাশভারি নই। সময় উপযোগী একজন মানুষ। যখন যেখানে যেমন পরিস্থিতি থাকে আমি সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারি। আমার সম্মানবোধ অনেক বেশি। যেখানে আমার সম্মান থাকবে না মনে হয়, সেখান থেকে সবসময় দূরে থাকি।

নির্মাণ এবং অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন, কোনোটিই আমার কাছে কষ্টের নয়। তবে অভিনয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এগুলো হলো ক্রিয়েটিভ বিজনেস। নিজেকে অভিনেতা দাবি করতে খুব কষ্ট হয়। আমি নিজেকে অভিনেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে গেলে কোনোরকমে টেনেটুনে পাস মার্ক পাব। অভিনেতা দাবি করার মতো অবস্থা আমাদের দেশের কোনো শিল্পীর রয়েছে কিনা জানি না। আমার তো নেই। অভিনয়ের বিশালতা এবং এর ব্যাপ্তি এত বড় যে, তা একজনের পক্ষে একজনমে ধারণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য হয়ত শত জনম লাগবে। তা পাব না। কারণ, জন্ম তো মাত্র একবারই। নির্মাতা হিসেবে আমি কখনই হ্যাপি নই। হ্যাঁ আমার নির্মিত ছবিগুলো হিট হয়েছে। আমি আরেকটি ছবি নির্মাণ করব। আসলে ছবি হিট হবে এমন আশা নিয়ে নির্মাণ করি না।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বরেণ্য শিল্পী বলেন, নতুন প্রজন্মকে বলব, তোমরা সাধনা কর। আগে চলচ্চিত্র ভালোবাসো আর নিজের মধ্যে ধারণ করো। চলচ্চিত্র এমন একটি জায়গা যেখানে টাকার পেছনে ছুটলে নিজে এবং চলচ্চিত্র দুইই ধ্বংস হবে। আর চলচ্চিত্রকে সাধনা ও ভালোবাসা দিয়ে ধারণ করলে অর্থ তোমাদের পেছনে ছুটবে। এতে তোমাদের ও চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হবে।

অভিনেতা আলমগীর গত শতকের আট ও নয়ের দশকে বেশ দাপটের সঙ্গেই কাজ করেছেন। পারিবারিক টানাপোড়েন, সামাজিক অ্যাকশন, রোমান্টিক অ্যাকশন, ফোক ফ্যান্টাসিসহ সব ধরনের চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন সফল।

আলমগীর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র আলমগীর কুমকুম পরিচালিত যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আমার জন্মভূমি’ ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। তার অভিনীত দ্বিতীয় ছবি ‘দস্যুরাণী’ [১৯৭৪], ১৯৭৫ সালে তিনি শাবানার বিপরীতে ‘চাষীর মেয়ে’ ও কবরীর বিপরীতে ‘লাভ ইন শিমলা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৮ সালে দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘জিঞ্জীর’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাক ও সোহেল রানার সঙ্গে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ‘নিষ্পাপ’ ছবিটি পরিচালনা করে, পরিচালকের খাতায় নাম লেখান। ১৯৮৫ সালে ‘মা ও ছেলে’ ছবিতে দীপক চৌধুরী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

পরবর্তীসময়ে ‘অপেক্ষা’ [১৯৮৭], ‘ক্ষতিপূরণ’ [১৯৮৯], ‘মরণের পরে’ [১৯৯০], ‘পিতা মাতা সন্তান’ [১৯৯১], ‘অন্ধ বিশ্বাস’ [১৯৯২], ‘দেশপ্রেমিক’ [১৯৯৪] ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে আরও ছয়টি জাতীয় পুরস্কারে ভ‚ষিত হন।

‘জীবন মরণের সাথী’ [২০১০] ও ‘কে আপন কে পর’ [২০১১] ছবিতে অভিনয়ের জন্য টানা দুবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালে তার নির্দেশিত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘একটি সিনেমার গল্প’ মুক্তি পায়।

ব্যক্তিগত জীবনে আলমগীর দুবার বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী গীতিকার খোশনুর আলমগীর। তাদের ঘরে জন্ম নেয় কণ্ঠশিল্পী আঁখি আলমগীর। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৯৯৯ সালে কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাকে বিয়ে করেন।