চ্যাম্পিয়ন হিমি

11 Mar 2021, 01:58 PM আকাশলীনা শেয়ার:
চ্যাম্পিয়ন হিমি

ছোটবেলা থেকে গান, নাচ, আবৃত্তি নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। বর্তমানে তিনি মিডিয়ার ব্যস্ত একজন মডেল ও অভিনেত্রী। পাশাপাশি নাচের চর্চাও নিয়মিত করে চলেছেন। ২০১৪ সালে ‘মডেল হান্ট’ নামে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে হিমির নাটকে অভিনয়ের কাজ। হিমির বর্তমান কাজসহ নানাদিক নিয়ে এবারের আকাশলীনা আয়োজন। লিখেছেন নিথর মাহবুব...


গেল ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত বিটিভির ‘শুদ্ধ মানুষ’ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন হিমি। মনি হায়দারের রচনা ও আফরোজা সুলতানার প্রযোজনায় বিটিভিতে এ নাটকটি প্রচার হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। মূলত বিটিভির মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে মিডিয়ায় পথচলা শুরু হয় হিমির। হিমির কথায়, ‘ছেলেবেলা থেকে নাচ, গান, আবৃত্তি শিখেছি। কচিকাঁচা ও ছায়ানটের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে বিটিভির শিশুতোষ অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছি তখন থেকেই। ছোটবেলায় বিটিভিতে কয়েকটি নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবেও অভিনয় করেছি। আর এখন বড়ো হয়ে বিটিভির নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছি।

বিটিভির প্রসঙ্গ ধরেই প্রশ্ন করি, এখন যখন বড়ো হয়ে বিটিভিতে কাজ করতে যান এ-বিষয়টা কেমন উপভোগ করেন ? এবার এই অভিনেত্রী বলেন- বিটিভিতে কাজ করতে গেলে খুবই ভালো লাগে। মেকআপ রুম থেকে শুরু করে সবখানে সবাই বলাবলি করেন, কত ছোটো দেখেছি হিমিকে। এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। সবার আদরও পাই। বিটিভির কাজ আমি খুব উপভোগ করি।

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নির্ভর সিনেমা ‘বঙ্গবন্ধু’তে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল এই মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের প্রতিযোগী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমির। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকদিন আটকে থাকে ছবির কাজ। পরে যখন কাজ শুরু হলো তখন জানা গেল, হিমির পরিবর্তে শেখ হাসিনার চরিত্রে নতুন কেউ আসছেন। এর আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষিত ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমার শিল্পী তালিকাতে নাম ছিল হিমির। কিন্তু পরবর্তীসময়ে মুম্বাই থেকে পাঠানো লিস্টে নাম নেই তার। এ বিষয়টির প্রসঙ্গ আনলে হিমি বলেন, এর আগেও আমি এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এসেছি। সুতরাং এই পরিস্থিতি আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবে দর্শকদের সমর্থন সবসময় আমার সঙ্গে ছিল এবং আছে। দর্শক আমাকে পছন্দ করে, এটা আমার জন্য অনেক বড়ো প্রাপ্তি। তাই কোথা থেকে বাদ পড়লাম এ নিয়ে আফসোস নেই আমার। যেসব কাজ করছি সেগুলো মনোযোগ দিয়ে করতে চাই। দর্শকদের মনে স্থায়ী হতে চাই। তবে, ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমার অডিশন দেওয়ার পরে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড়োবেলার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। এত বড়ো একটি চরিত্রে অভিনয় করা সকল অভিনেত্রীরই স্বপ্ন। স্বপ্ন যে একমুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে সেটা অকল্পনীয় ছিল। চরিত্র থেকে বাদ পড়ার কারণ, এমনকি চরিত্র থেকে যে বাদ পড়েছি কোনো কিছুই কর্তৃপক্ষ জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। কর্তৃপক্ষ সরাসরি যোগাযোগ করে একজন অভিনেত্রী হিসেবে সামান্যতর সম্মান প্রদর্শন করবেন এতটুকু আশা ছিল। সবশেষে, নতুনভাবে নির্বাচিত অভিনেতা অভিনেত্রীরা অসাধারণ অভিনয় করবেন এবং ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো রুপালি পর্দায় ফুটিয়ে তুলবেন এর জন্য শুভকামনা রইল।

মিডিয়ার ক্যারিয়ারে এর আগেও এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। ‘মডেল হান্ট’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও হিমি অংশ নেন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায়। চূড়ান্ত পর্বে প্রথমে বিচারকদের রায় অনুসারে ‘মিস বাংলাদেশ’ হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। পরে অনুষ্ঠানের আয়োজক জানান, ভুল করে তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত আয়োজকেরা তাদের পূর্বনির্ধারিত একজনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এ নিয়ে মিডিয়ায় অনেক আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে বাদ পড়ে আয়োজকদের পছন্দের প্রার্থীও। তবে ঘোষণা অনুসারে হিমি দ্বিতীয় রানার্স-আপ হলেও ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন অন্য একজন। তারপর অনেকটা সময় এই অভিনেত্রী দূরে ছিলেন অভিনয়ের জগত থেকে। পরে সব বিতর্ক পেছনে ফেলে অলরাউন্ডার হিমি আবার কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।

হিমি বলেন, আমি অভিনয় থেকে দূরে যাইনি তখন। মূলত ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কারণে কিছুদিন সব কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কারণ, প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী তখন কোনো প্রতিযোগীই অন্য কোনো কাজ করতে পারেনি। যে-কারণে মাঝে দর্শক আমাকে অভিনয়ে দেখতে পায়নি।

‘মডেল হান্ট’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও কেন আরেকটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে এই অভিনেত্রী বলেন, যখন জানতে পারলাম ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ আসরে আমাদের দেশ থেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে, তখন নাম লেখালাম। কারণ এর মাধ্যমে নিজেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপনের সুযোগ ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান আয়োজকদের সম্পর্কে তখনো আমি খুব বেশি কিছু জানতাম না। এরপর যদি আমি কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিই, তাহলে এর পেছনে কারা আছেন, তাদের ব্যবস্থাপনা কেমন, সবকিছু জেনেই যাব। ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’-এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান অন্তর শো-বিজ সম্পর্কে আমার পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না।

হিমি কচিকাঁচা, ছায়ানটসহ অনেক জায়গাতেই নাচ-গান শিখেছেন। বেড়ে ওঠার পর নজরুলসংগীতে তালিম নেন শিল্পী ফেরদৌস আরার কাছে। তার পক্ষে এসব সম্ভব হয়েছে পরিবারের পরিপূর্ণ সমর্থন ছিল বলেই। ছোটবেলার মতো এখনো বাবা-মা তাকে শুটিংয়ে নিয়ে আসেন। এককথায় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই হিমির বেড়ে ওঠা। নাচের ক্ষেত্রেও দক্ষ হিমি। ক্লাসিক্যাল নৃত্য রপ্ত করেছেন। মোট কথা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন অল্প অল্প করে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলচ্চিত্র থেকে বাদ পড়লেও, বড়ো পর্দায় কাজ করার অভিজ্ঞতা অনেক আগেই হয়েছে হিমির। শুরুতে কলকাতার রেশমী মিত্রের নির্দেশনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান এ তারকা। সিনেমায় হিমির বিপরীতে দেখা গিয়েছিল কলকাতার দ্বীপ ভট্টাচার্যকে। বাংলাদেশের ইলিয়াস কাঞ্চন আর ওপার বাংলার দেবশ্রী রায়ও ছিলেন ছবিটিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতা অবলম্বনে হিমি ‘হঠাৎ দেখা’ চলচ্চিত্রে ওপার বাংলার দেবশ্রী রায়ের তরুণী বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হিমি আরো ছবিতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে নাচ-গান-অ্যাকশনে ভরপুর মসলাদার ছবিতে কাজ করার ইচ্ছা নেই তার। ভালো গল্প-চরিত্র ও গুণী পরিচালকদের কাছ থেকে প্রস্তাব এলে ভেবে দেখতে চান তিনি।

নিজের ব্যস্ততা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হিমি বলেন, ছোটবেলায় গান ও নাচ শিখতাম। কিন্তু অভিনেত্রী হব কখনো ভাবিনি। তবে অভিনয়ের সঙ্গে যখন সম্পৃক্ত হলাম তখন ইচ্ছে ছিল চলচ্চিত্রে কাজ করার। সেই সুযোগটাও হয়ে যায় ‘হঠাৎ দেখা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। এখন চেষ্টা করছি নিজেকে আরো ভালোভাবে গুছিয়ে নেওয়ার।

সাংবাদিক, সেনাবাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে ছোটবেলায় অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন মডেল-অভিনেত্রী ! আরটিভি ও ফ্যাশন হাউজ রঙ আয়োজিত ‘মডেল হান্ট’ প্রতিযোগিতায় মায়ের ইচ্ছায় অংশ নিয়েছিলেন হিমি। যার ফলে খুলে যায় সুযোগের দুয়ার। এরই মধ্যে সৌভাগ্য হয়েছে তার কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নায়িকা হওয়ার। হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের গুণের কোনো সীমা নাই’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এতে মিনা চরিত্রে অভিনয় করে খুব প্রশংসিত হন। এটি প্রচার হয় চ্যানেল আইয়ে। এ নাটকে কাজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে হিমি বললেন, অল্প সময়েই হুমায়ূন স্যারের গল্পের নায়িকা হতে পেরেছি। তিনি বেঁচে থাকলে নিজেকে আরো ভাগ্যবতী মনে করতাম। মেহের আফরোজ শাওনের পরিচালনা আর রিয়াজ ভাইয়ের মতো অভিনেতার সঙ্গে কাজ করে অভিনয়ের অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

এছাড়াও হিমির সৌভাগ্য হয়েছিল নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে কাজ করার। ‘চেয়ারম্যানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’র নায়িকা কমলার চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। তার বিপরীতে ছিলেন সম্রাট। তিনিই গ্রামের চেয়ারম্যান। তার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক।

এ নাটকে কাজ করা প্রসঙ্গে হিমি বলেন, আমার সামনে রাজ্জাক স্যার ! প্রথমে স্বপ্নের মতো লেগেছে। প্রথমে যখন স্যারের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি হাত-পা কাঁপছিল। জানা কাজ ভুল করছিলাম। পরে স্যার ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে অনেক গল্প করেছেন, কাজের বিষয়ে বুঝিয়েছেন। স্যারের সঙ্গে কাজের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

‘মডেল হান্ট’ প্রতিযোগিতা বিজয়ের পর অরুণ চৌধুরীর পরিচালনায় ধারাবাহিক নাটক ‘মোহর আলী’তে অভিনয় করেন হিমি। এটি চ্যানেল আইয়ে প্রচার হয়। এরপর একে একে অসংখ্য নাটক ও টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন এই অভিনেত্রী। তাকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও। ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে ‘সেন্টার ফ্রেশ’, মোবাইল ফোন কোম্পানি সিম্ফনি এবং শিক্ষার ওপর সরকারি বিজ্ঞাপনসহ অনেক বিজ্ঞাপনে হিমির উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য।

অভিনয়ের পাশাপাশি হিমিকে নাচের অনুষ্ঠানে দেখা গেলেও গানে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে হিমি বলেন, সামনে গানের দিকে নজর দেব। সব কাজ একবারে করলে কোনোটাই সঠিকভাবে করা যায় না।