চুপ চুপ ওই ডুব দেয় পান কৌটি
টুপ টুপ দেয় ডুব ঘোমটার বৌটি
-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
বাংলাদেশের বিলাঞ্চলে পানকৌড়ি অতি পরিচিত এক পাখি। লম্বায় ৫১ সেন্টিমিটার পানকৌড়ির সারা গা ও বুক কাককালো, তাতে সামান্য চকচকে আভা। গলায় সাদা দাগ, পাখার নিচের পালক ধূসর রংয়ের। লেজের গড়ন নৌকার বৈঠার মতো। ঠোঁট সরু, প্রায় গোলাকার ; ওপরের ঠোঁটের আগা তীক্ষè ও বাঁকানো। পা দুটি খাটো তবে, বেশ মজবুত ; পায়ের পাতা হাঁসের পায়ের মতো জোড়া লাগানো। এরা পানির মধ্যে দাঁড়ের মতো পা দিয়ে পানি ঠেলে এগিয়ে চলে। চোখ সবুজাভ বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একইরকম।
পানকৌড়ির ইংরেজি নাম লিটল করমোর্যান্ট, বৈজ্ঞানিক নাম ফ্যালাক্রোকোর্যাক্স নিগার। এরা শিকার ধরার জন্য মাছেদের রাজ্যে গিয়ে ধাওয়া করে, ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকে না।
পানকৌড়ি উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পাখি। এরা বাংলাদেশের নদী, খালবিলে বিচরণ করতে ভালোবাসে। সময় সময় সমুদ্রের তীরে দেখা গেলেও পানকৌড়ি মূলত মিঠা পানির পাখি। বড়ো পুকুর ও বিল অঞ্চলই এরা বেশি পছন্দ করে। সুন্দরবন অঞ্চলের জোয়ার-ভাঁটার নদীগুলো এদের খুবই প্রিয়। সাঁতরানোর সময় তাদের শরীর পানির নিচে ডুবে থাকে, কেবল গলা ও মুখ পানির ওপরে ভেসে থাকে। মাছের সন্ধানে এরা পানির অনেক নিচে চলে যায়। সময় সময় একসঙ্গে অনেক পানকৌড়ি একসারিতে একইদিকে ডুব দিয়ে দিয়ে চলতে থাকে।
পানকৌড়ি বাসা বাঁধে গাছের উপর। ঝিল বা পুকুরের ধারে কিংবা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, এমন গাছই এরা পছন্দ করে। ছোটো ছোটো খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। পানকৌড়ির শরীরের গঠনের তুলনায় বাসা অনেক ছোটো হয়। বাসা বানাতে এরা পটু নয়, কাক বা বকের পুরোনো বাসা পেলে তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। পানকৌড়ি সামাজিক পাখি। এরা একইগাছে কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে বাস করে। শুধু নিজেরাই দল বেঁধে থাকে না, অন্য জাতের পাখি যেমন বক, বাচকা (নিশিবক), শামুকখোল ইত্যাদি পাখির সঙ্গে একইগাছে বাসা বেঁধে ছানাদের লালনপালন করতে পছন্দ করে।
এদের প্রধান খাদ্য ছোটো মাছ, তবে কাঁকড়া, ব্যাঙাচি, ব্যাঙ ইত্যাদিও খায়। পানকৌড়ি একবারে তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো লম্বাটে, একদিক ক্রমে সরু। নতুন ডিমের রং সবুজ আভাযুক্ত নীল, খোসা বেশ শক্ত। ডিম ফোটার আগে হলদে ও বাদামি রং ধারণ করে।
চীন ও জাপানে জেলেরা মাছ ধরার জন্য পানকৌড়ি পোষে। এদের গলায় আংটা পরিয়ে তাতে লম্বা শক্ত সুতা বেঁধে জলে নামিয়ে দেয়। ডুব দিয়ে মাছ ধরে যখন জলে উপর ভেসে ওঠে তখন এর পালনকারী সুতা টেনে পাখির মুখ থেকে মাছ খুলে নেয়। গলায় আংটা থাকায় পানকৌড়ি মাছ ধরেই গিলে ফেলতে পারে না। কিছুদিন এমন অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর ঘলায় আংটা পরানোর দরকার হয় না ; নিজে থেকেই মাছ এনে কাছে জমা দেয়।
লেখা : শ্যামল কায়া