ভালোবাসা মানে...

14 Feb 2024, 01:17 PM মুক্তগদ্য শেয়ার:
ভালোবাসা মানে...

ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি

ভালোবাসা মানে গোপন গোপন খেলা

ভালোবাসা মানে কান্নাভেজা চোখে

ভালোবাসা নীল খামেদের ভেলা ॥

-কণ্ঠ : অনিন্দ্য বসু, ব্যান্ড : পরশ পাথর

ভালোবাসা নিয়ে দেশে-বিদেশে, বাংলা, ফারসি, ফরাসি ভাষায়, লোককথায়, গানে, ধর্মগ্রন্থে, পুরাণ কিংবা বিজ্ঞানে এত এত কথা বলা হয়েছে যে, সেসব মুখস্থ করেও কোনো লাভ নেই, যদি না নিজে একবারের জন্য হলেও প্রেমে না পড়া যায়। বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, রসগোল্লার স্বরূপ বুঝতে অন্তত একটা রসগোল্লা মুখে পুরতেই হবে। তা না করে যতই তার আকার, স্বাদ, রং বর্ণনা করা হোক না কেন- তা কিছুতেই প্রকৃত রসগোল্লার স্বাদ বুঝতে সাহায্য করবে না। তাই প্রেম বা ভালোবাসা বুঝতে প্রেমে পড়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা, জীবনে প্রেম-ভালোবাসা যে আসলে কত জরুরি তা গুণিজনদের নানা উক্তিতেই সহজে প্রতীয়মান হয়। যেমন-

প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি, প্রেমই পরিবর্তনের গুপ্তশক্তি, প্রেমই দিব্য সৌন্দর্যের দর্পণস্বরূপ।

-জালাল উদ্দিন রুমি

ভালোবাসা হলো যখন আপনি কারো পাশে বসেন, কিছুই করেন না, তবুও আপনি পুরোপুরি সুখী হন।

-সংগ্রহ

প্রেমিকাবিহিন তরুণের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা, ঘাসবিহীন মাঠে গোরুর পায়চারির মতো।

-হুমায়ূন আহমেদ

তবে ভালোবাসা আর প্রেম কিন্তু আমার কাছে কখনো এক মনে হয় না। মা সন্তানকে ভালোবাসেন, পিতা কন্যাকে, শিক্ষক ছাত্রকে, বন্ধু বন্ধুকে, কেউ কাজ, কেউ সংগীত-শিল্প, কেউ প্রকৃতি ভালোবাসেন। এরকম ভালোবাসাগুলোর মধ্যে আছে দায়বদ্ধতা, সুস্থতা, স্বাভাবিকতা। এই ভালোবাসা প্রাণিকুলের স্বভাবের মধ্যে বিরাজিত। মমতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, স্নেহ, যত্নে এসব খুব আরাধ্য, প্রশংসিত এবং কাম্য। কিন্তু সমস্যা করে ওই প্রেম নামক বস্তুটি। প্রেম সর্বজনস্বীকৃত নয়, তাই করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে, কাউকে না জানিয়ে। ব্যক্তির কাছে এটা কাম্য ও প্রশংসিত তবে তা শুধু নিজের ক্ষেত্রে। এটা আরাধ্য কিন্তু সহজলভ্য নয়। কাজেই প্রেম মানুষের জীবনের নিত্যকার স্বাভাবিক কোনো ঘটনাও আসলে নয়।

প্রেম মানব-মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকলাপের বাইরে এক অস্বাভাবিক অবস্থা, অসুখের মতো। তাই বলা হয়, ‘প্রেমেপড়া’- প্রেমে বসা বা ওঠা নয়। যেমনিভাবে লোকে অসুখে পড়ে- তেমনি প্রেমেও পড়ে। তবে মানব-মানবীর এই দশাও স্বাভাবিক, মানে কপালগুণে এমনটা সৌভাগ্যবান কারো কারো ক্ষেত্রেই ঘটে থাকতে পারে। তবে, সবার ভাগ্যে প্রেম জোটে না। কবি তসলিমা নাসরিনের ভাষায়-

প্রেম হলে আমার যা কিছু এলোমেলো,

যা কিছু খুঁত, যা কিছুই ভুলভাল অসুন্দর

থাক, সামনে দাঁড়াবো, তুমি ভালোবাসবে।

কে বলেছে প্রেম খুব সহজ, চাইলেই হয় !

এত যে পুরুষ চারিদিকে, কই প্রেমিক তো দেখি না !’

প্রেমকে যদি অসুখ বলি, তাহলে এই রোগের স্থায়িত্ব কিন্তু স্বল্পমেয়াদি নয়। এ অসুখ তিন-চার দিনে, একসপ্তাহে, একমাসে সারবার নয়। আবার এই প্রেম-রোগের রয়েছে মারাত্মক এমনকি জীবন উচ্ছন্নে যাওয়ার মতো সাইড এফেক্টও। কাজেই হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়ও নয় এটা। একবার আক্রান্ত হলে, বছর দুই তো নিদেনপক্ষে, আর ক্ষেত্রবিশেষে আরো বহু বছরও লেগে যেতে পারে পুরোপুরি সেরে ওঠার জন্য। আবার কারো পক্ষে সেরে ওঠাও হয় না একজীবনে। আবার দুর্বল ইমিউনিটির মানব-মানবীকে জীবনে একাধিকবারও এই প্রেমরোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

এবার আসি প্রেমরোগের লক্ষণ বিষয়ে। জ্বর হলে যেমন একটা বিশেষ মাত্রার তাপমাত্রা সার্বক্ষণিক বিরাজ করে দেহজুড়ে, প্রেমেরও ওই একই রূপ। এক বিশেষ মাত্রার তাপ জুড়ে থাকে সর্বাঙ্গে। তবে, এই তাপের মাত্রা পরিমাপ করতে বিশেষ ধরনের থার্মোমিটার এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। হয়ত হয়ে যাবে একসময়। বিজ্ঞানের অগ্রসরতার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক রোবট আবিষ্কৃত হয়ে পড়বে হয়ত যে চ্যাটজিপিটির মতো যান্ত্রিক গলায় বলে দিতে থাকবে, আপনার প্রেমমাত্রা এখন একশ’ দুই ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তো এই রকম একশ’ দুই ডিগ্রি মাত্রার প্রেম নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরের পৃথিবীতেও ধাবমান হতে দেখা যায়। তখন যেদিকেই দু’চোখ যায়, বুকের ভেতর অজানা হাহাকার জেগে ওঠে। যে দিকেই তাকানো যায় সে দিকেই রং দেখতে থাকে, প্রেম দেখতে থাকে। সকাল বেলার রোদ্দুরে দেখে হলুদ রঙা প্রেম, গাছের পাতায় দেখে ঘাপটি মেরে থাকা সবুজ সবুজ প্রেম। দেখে চড়ুই পাখির ফুড়–ৎ ফুড়–ৎ উড়ে যাওয়া ডানায় আশ্রয় নেওয়া প্রেম, দেয়াল বেয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটায় নিবিড় প্রেম। প্রেম গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে মিশে থাকে চলার পথের ধুলোয়, শেষ বিকেলের লাল আলোয়।

সত্যি, এ যেন এক ঐশ্বরিক অনুভূতি, যা বুকের ভেতর লাল আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে। বুকের মাঝে হাত দিলে, সেই ওম ওম আগুন হাত গলে বাইরে বেরিয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে টপটপ। চিন্তা, চাল-চলনে হয় আকাশচুম্বী পরিবর্তন। মন-মগজ তখন কেবলই প্রেমের দিকে ধাবিত। রাত আসে মিষ্টি হয়ে, সকাল হয় আকাক্সক্ষাকে সাথি করে। দিনটা সমাপ্ত হয় প্রেমের কথা ভাবতে ভাবতে, সকালটা হয় যেন তার কথা ভাবতে বসার জন্যেই। প্রতীক্ষায় কাটে অষ্টপ্রহরÑ কখন তার মিলবে দেখা, কখন তার আসবে টেলিফোন।

আশায় আশায় বসে আছি

ওরে আমার মন

কখন তোমার আসবে টেলিফোন

-মহীনের ঘোড়াগুলি

এ প্রেমীর তখন কাজে-কর্মে মন নেই। মিটিং, ডেডলাইন, মক টেস্ট, বাজারের ফর্দ চুলোয় যাক সব। এমন যখন অবস্থা, সমাজে, পরিবারে, যুদ্ধের প্রশিক্ষণে সে তো তখন অকেজো মাকাল ফলই বটে। প্রতীক্ষায়, নানা আশঙ্কায় মন দুরুদুরু, অভিমানে ফুসে ওঠে মন, চোখের কোণে না চাইতেই জল- টলমল। দুরালাপনিতে আর ভরসা নেই। সাদা কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষরে হাতের লেখা চর্চার শুরু। শব্দগুলো যেন কাগজে পদ্য হয়ে ফুটে উঠতে থাকে। পৃষ্ঠা ভরে যেন একটা কথাই বলতে থাকে- ভালোবাসি। নিজের ভাষার দৌরাত্ম্যে কুলোয় না যখন, গ্রন্থ হাতড়ে খোঁজে, কী বলেছেন সুনীল, পুর্ণেন্দু, রুদ্র ? মনের মতো শব্দাবলি খুঁজে বের করাতেই তখন মনোনিবেশ। ‘ভালোবাসি’ না-বলেও কতভাবে বোঝানো যায় ভালোবাসি তা খুঁজে বের করা।

যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে প্রেম, যে পাড়ায় তার বাস, যে বাড়িটায় তার বসবাস- সবই তখন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। যে গ্লাসে খেল জল, কাপে দিল একটা চুমুক, যে টেবিলটিতে বসেছিল সে কিছুক্ষণ- এই সমস্ত জড়পদার্থগুলোও অর্থবহ আর মূল্যবান হয়ে ওঠে তখন।

ভালোবাসা মানে টেলিফোনে চুপিচুপি

সারাটি রাত ধরে গেঁথে যাও কথামালা

ভালোবাসা মানে কবি কবি ভাবনাতে

কোনো কবিতায় মগ্ন যা বড়ো জ্বালা।

-গান : নকীব খান, সুর : প্রিন্স মাহমুদ


মেটাফিজিকাল পোয়েট জন ডান ভাবেন, যে মশাটাও হুল ফুটিয়ে পান করলো তার আর তার প্রেমের রক্ত, সেই মশার দেহও যেন আজ দু’জনের রক্তের মিলনের এক পবিত্র মন্দির, ফুলশয্যা।

this flea is you and i. and this our marriage bed, and marriage temple is..."

-john donne.

কাজেই আশেপাশে কারো মধ্যে এসব লক্ষণ ধরা পড়লে বুঝে নিতে হবে সে কারো প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়ার আগে কিছু সাবধানতার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই :

প্রেম আসতে পারে জীবনে যখন তখন, পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ও ক্রেডিট কার্ডের অঙ্কটা দেখে নিতে হবে। কারণ প্রেম চালানো ব্যাপক খরচার বিষয়ও বটে। সময় ইনভেস্টমেন্টও করতে হয় প্রচুর। কাজেই কার জন্য এসব ইনভেস্ট করা হচ্ছে, সেটাও বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিতে হবে।


পুনশ্চ

প্রেম ধরে রাখতে করতে হয় পড়াশোনা। আপডেট থাকতে হয় চলতি বিশ্ব, সমাজ, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, সিনেমা ইত্যাদি বিষয়ে। দায়িত্বশীল হতে হয় নিজের কাজের প্রতি। আচরণে হতে হয় রুচিশীল ও মার্জিত। মনে রাখতে হবে প্রত্যেকেই চায় তার পছন্দের জন হোক সুন্দরের পূজারি, পজেটিভ একজন মানুষ। যার কাছে এসে দু’দন্ড শান্তি মেলে, পাওয়া যায় মুক্তির স্বাদ। কাজেই নাটোরের বনলতাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হওয়ার দিন আর নেই। নিজেকেই গড়ে তুলতে হবে বনলতা করে, যার কাছে এসে শান্তি পাবে অপরজন।

আর প্রেমে লোকশান বলে কিছু নেই আসলে। বনলতার সন্ধান মিলুক বা না মিলুক নিজেকে নিজের ভালো লাগার মতো গড়ে তোলাও কিন্তু কম কথা নয়। আসুন নিজেকে ভালোবাসি, সম্মান করি- দেখবেন ভালো একদিন ঠিকই খুঁজে নেবে আপনাকে। 

লেখা : ইভা আফরোজ খান