আ মরি বাংলা ভাষা -ইকবাল খোরশেদ

13 Feb 2024, 01:41 PM অন্যান্য শেয়ার:
আ মরি বাংলা ভাষা  -ইকবাল খোরশেদ

‘আমার এমন মধুর বাংলা ভাষা

ভায়ের বোনের আদর মাখা

মায়ের বুকের ভালোবাসা।

-জসীমউদ্দীন

“একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি এক যুগান্তকারী দিন।”

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পর বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভাষা-সংস্কৃতি হারানোর উপক্রম হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে বাঙালি জাতিকে নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার প্রয়াস পায়। তারা প্রথম আঘাত হানে বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর।

হিন্দুরা তাদের দেশে থাকবে, মুসলিমরাও থাকবে নিজেদের দেশে- এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার শাসকেরা স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনার সবক্ষেত্রে ধর্মকেই অবলম্বন করে। তাই ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পরপরই নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রভাষা’ উর্দু করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, পূর্ব-বাংলার জনগণকে নেতৃত্বশূন্য ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাঙালি জনগণকে চাকরি তথা প্রশাসনে অংশগ্রহণের জন্য একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষার বোঝা বহন করতে হবে। এতে করে বাঙালিরা স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব-বাংলার জনগণ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য গর্ববোধ করে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ছিল বাঙালির আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব-বাংলার জনগণের এমন বাঙালি সংস্কৃতিপ্রীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে মনে করে। তাই তারা বঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে উদ্ধত হয়। অথচ এখন থেকে প্রায় হাজার বছর আগে প্রাকৃত ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম। এরপর ক্রমরূপান্তরের মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষা বর্তমান রূপ পায়।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই শাসকচক্র ঘোষণা করে যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। কুমিল্লার অধিবাসী গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেদিন এর প্রতিবাদ করেন। তিনি উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্টভাষা করার দাবি জানান। পাকিস্তানের ধ্বজাধারী নাজিমুদ্দিন-তমিজুদ্দিন গং সেদিন ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। অথচ তাঁর দাবি ছিল খুবই যৌক্তিক। কিন্তু শাসকচক্র বাংলাকে কোনোরকম সরকারি বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে নারাজ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা করেন : urdu and shall be the state language of pakistan  কিন্তু এদেশের ছাত্র-যুবারা সে সমাবেশেই no, no, it can't be ধ্বনি তুলে তার এ-ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানায়।

এদিকে পাকিস্তান সরকারও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজির সাথে শুধু উর্দু ব্যবহার করে। মুসলিম লীগ নেতারা যখন পাকিস্তানের নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দু-কেই ‘রাষ্ট্রভাষা’র বিশেষ মর্যাদা দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন, তখন বাঙালি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ উপলব্ধি করেন যে, পূর্ব-বাংলা নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হলেও এখানে লোকসংখ্যা বেশি এবং পুরো পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোক বাংলায় কথা বলে। অন্যদিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পূর্ব-বাংলার জনগণের ওপর ভিনদেশি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হলে তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, সরকারি চাকরি ও অন্যান্য ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং তারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলে। বাঙালিদের এ দাবি ছিল যেকোনো বিবেচনায় ন্যায্য দাবি।


পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা পাঁচটি : বেলুচী, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ও বাংলা। পশ্চিম-পাকিস্তানে উর্দু ভাষা নেই তা নয়, তবে, বাংলাও আছে। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানের তো নয়ই, পুরো পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের মাতৃভাষাই উর্দু নয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচন করতে হলে এই পাঁচটি ভাষার মধ্য থেকেই করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম চারটি ভাষায় যারা কথা বলে, তাদের কারোরই সংখ্যা বাংলাভাষীদের সমান নয়। পশতুভাষীদের সংখ্যা এক কোটির অনেক নিচে। বেলুচী এবং সিন্ধিভাষীদের সংখ্যা তার চেয়েও কম। এসব ভাষায় কোনো উন্নত সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। অতএব, এসব ভাষাকে রাষ্ট্রভাষিক প্রশ্ন থেকে বাদ দেওয়া যায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি একমাত্র বাংলারই রয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে তো বটেই সাহিত্যচর্চার দিক থেকেও বাংলা ভাষা ছিল অনেক এগিয়ে। ’৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ব-বাংলায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটির মতো। পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসংখ্যা কিছু কমবেশি তিন কোটি। এই তিন কোটি লোক মোট চারটি ভাষায় কথা বলে। হিসাবমতে পাকিস্তানের সব থেকে বেশি লোকে কথা বলে বাংলা ভাষায়। আবার বাংলা ভাষার রয়েছে এক সমৃদ্ধ সাহিত্য ভা-ার। চর্যাপদ এবং মঙ্গলকাব্যের মধ্যযুগের সমৃদ্ধ সাহিত্যের কথা বাদ দিলেও আধুনিককালের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভার বিশ্বের যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়। তাই পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি সবচেয়ে বেশি বাংলার।


বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দেই ঢাকার অগ্রণী ছাত্রসমাজ ও সংস্কৃতিমান বুদ্ধিজীবীগণ প্রথম আওয়াজ তোলেন। তখন থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু হওয়া উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি উত্থাপন করেন।

এদিকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেন্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ভাষার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা আসে বায়ান্ন খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি।

উনিশশো বায়ান্ন খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা-শহিদদের অবদান কতখানি তা হয়ত পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দেখলেই বোঝা যায়।

একটি স্ফুলিঙ্গ যেমন একটি দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি পূর্ব-বাংলার গণআন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ থেকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সৃষ্টি হয় একটি অপ্রতিরোধ্য দাবানল।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এক জনসভায় ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করার পর সেই আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি ক’রে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্রসমাজ।

দশ জন দশ জন করে স্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল এগোতে থাকে অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে। শুরু হয় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস। কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে বহুসংখ্যক হতাহত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতোকক্তর শ্রেণির ছাত্র আবুল বরকত, তার পেটে গুলি লাগে। একজনের মাথার খুলি উড়ে গেছে তার নাম রফিকউদ্দিন। রফিকউদ্দিন ছিলেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামের ছেলে। ঢাকায় তিনি পিতার মুদ্রণব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। পুলিশের গুলিতে পায়ের গোড়ালি ফাটা বাঁশের মতো ফেটে যায় আব্দুল জব্বারের। আবদুল জব্বার ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামের সন্তান। তিনি নিজ গ্রামে আনসার কমান্ডার হিসেবে কাজ করতেন। ঢাকায় অসেন শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে। ভাষার দাবিতে তিনি ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেন। শফিউর রহমান ঢাকার হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরি করতেন। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকার নবাবপুর রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে সন্ধে সাতটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আব্দুস সালাম ছিলেন নোয়াখালি জেলার ফেনী মহকুমার লক্ষণপুর গ্রামের ছেলে। সালাম ঢাকায় সরকারি অফিসের পিওন ছিলেন। থাকতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটায় মেডিকেল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মারা যান তিনি। এছাড়াও অহিউল্লাহ নামে এক কিশোর শহিদ হন।

একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার অভিঘাতে গোটা পূর্ব-পাকিস্তনে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা ও মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙে। ভাষাশহিদদের আত্মদানের স্ফুলিঙ্গ থেকে যে দাবানল জ্বলে ওঠে, তার কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে সেখানে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তীসময়ে এই দাবানলই একে একে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ভাষা-আন্দোলনে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন, তারা এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।