বটতলার খনা আখ্যান -ইকবাল খোরশেদ

13 Feb 2024, 01:23 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
বটতলার খনা আখ্যান  -ইকবাল খোরশেদ

গত রাতে ঢাকায় হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি ঝরে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একজন ফেসবুকে লিখলেন :

“যদি বর্ষে মাঘের শেষ

ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।”

এটি খনার বচন হিসেবে প্রচলিত। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ‘খনা’র কথা।

প্রায় হাজার বছর ধরে ‘খনা’ নামের এক বিদুষী নারী বাঙালি সমাজে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। তার আরও একটি নাম আছে, সেটি লীলাবতী। খনা’র খ্যাতির আড়ালে লীলাবতী চাপা পড়ে গেছেন প্রায়। শুধু বাংলায় নয়, খনার কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে উড়িষ্যা ও বিহার পর্যন্ত। ইতিহাস বলে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তো দীর্ঘকাল একসঙ্গেই ছিল। বাঙালি সমাজে খনা-কে নিয়ে নানা মত প্রচলিত। কেউ বলেন, খনা কেবলই এক কিংবদন্তি, জনশ্রুতি ছাড়া এ আর কিছুই নয়। আবার কারো মতে লীলাবতী খনা নামে সত্যিই কেউ ছিলেন। যিনি কৃষিকাজ, ফসলের যত্নে, আবহাওয়া, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গৃহনির্মাণ বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান রাখতেন এবং সেগুলো পদ্যের ছন্দে প্রকাশ করতেন ; বাঙালি সমাজে এগুলো ‘খনার বচন’ নামে পরিচিত। ব্যাকরণের ভাষায় বলা যায়, ‘মৌখিক সাহিত্যিক ঐতিহ্য’। আমাদের জানামতে, কোনো ঐতিহাসিকই লীলাবতী খনা-কে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। তাই খনা সত্যিই জনশ্রুতি না বাস্তবে ছিলেন কোনো বিদুষী, তা নির্ণয় করা যায় না।

নাট্যকর্মী সামিনা লুৎফা নিত্রা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ‘খনা’ নামে একটি নাটক লিখতে শুরু করেন। সম্ভবত তিনি বেশ কয়েক বছর সময় ব্যয় করেন নাটকটি শেষ করতে। তাঁর ‘খনা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের ভূমিকা পড়ে এটি বোঝা যায় যে, তিনি প্রয়োজনীয় বইপত্র পড়েছেন এবং লীলাবতী বা খনা নামে বাস্তবে কোনো চরিত্র ছিল কি না তা অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু খনা কেবলই জনশ্রুতি না ঐতিহাসিক সে প্রশ্নে তিনিও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। “খনা কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নন, তার উৎস বা জীবন খুঁজতে হবে তাঁকে নিয়ে চালু থাকা কিংবদন্তির মাঝে।” [খনা ও অন্যান্য, সামিনা লুৎফা নিত্রা, কবি, অক্টোবর ২০২২] তবে তাঁর হাতে খনা’র পুনর্জন্ম হয়েছে- একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।

কিংবদন্তি কিংবা বাস্তব যাই হোক না কেন, খনা সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য যে তত্ত্বটি প্রচলিত তা হলো : “জনশ্রুতি আছে যে, খনার নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত সদর মহকুমার দেউলিয়া গ্রামে। বর্তমানে যেটি চন্দ্রকেতুগড় প্রন্তস্থল ; এটি ‘খনামিহিরের ঢিবি’ নামে পরিচিত। এমনকি, তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরন্তের একজন বলে কথিত। বরাহমিহির-এর পুত্র মিহির তার স্বামী ছিল বলেও উড়িষ্যা কিংবদন্তিতে প্রচলিত।” [বাংলা লোকঐতিহ্য পরিচয়, ইকবাল খোরশেদ, মূর্ধন্য, ২০১৮]

বেশ কয়েক বছর আগে বাটতলার ‘খনা’ নাটকের খুব প্রশংসা শুনেছিলাম। কিছুদিন আগে দেখলাম, খনা মঞ্চস্থ হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। সাগ্রহে গেলাম দেখতে। এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল কানায় কানায় পূর্ণই শুধু নয়, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত অনেক দর্শক টিকিট কেটে দর্শক আসনসারির মাঝের চলাচলের পথে বসেও দেখেছেন নাটক। হলের তিনদিকে দর্শক বসেছেন, মাঝখানে অভিনীত হচ্ছে নাটক। মঞ্চনাটকের পরিভাষায় নাটকের এই ফর্ম-কে বলে ‘এরিনা’। তবে, নাটকটি প্রসেনিয়ামেও মঞ্চস্থ হয়ে থাকে।

খনা এবং তার বচনের সঙ্গে বাঙালি সমাজ কম-বেশি পরিচিত হলেও খনা-কে নিয়ে আগ্রহ আছে কয় জনের, ক’জনই-বা জানতে চায় বা চেয়েছে প্রকৃতই খনা কিংবা লীলাবতী নামে কোনো চরিত্র হাজার বছর আগে বাংলায় বিরাজ করত কি না ? প্রাচীন ইতিহাস, সমাজ বা সাহিত্যের গবেষক ছাড়া এমন প্রশ্ন খুব কম সাধারণ মানুষের মনে উদিত হয় এমন ভেবে নেওয়া অমূলক নয়। সামিনা লুৎফা নিত্রা খানা’র বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন, কেন ? সে প্রশ্নে না গিয়ে তিনি আগ্রহী হয়েছেন এবং খানা-কে জানার বোঝার জন্য প্রচুর পড়েছেন, প্রচুর খেটেছেন এজন্যই তিনি ধন্যবাদার্হ। তাঁর পঠন-পাঠন এবং অনুসন্ধানের পরিসমাপ্তিতে তিনি একটি গল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যেটি একদিকে যেমন প্রচলিত গল্পের ছায়া ছুঁয়ে বেড়ে উঠেছে অন্যদিকে তেমনি তা তাঁর নাটকের দর্শকদের কাছে বিশ^াসযোগ্য হয়ে উঠেছে। জীবনঘনিষ্ঠ যেকোনো সাহিত্যকর্মের এটিই প্রধান অন্বিষ্ট। বটতলার খনার প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য এর নির্দেশক মোহাম্মাদ আলী হায়দারও। তিনি নাটকটিকে উপস্থাপনের জন্য এমন এক নাট্য-আঙ্গিক বেছে নিয়েছেন, যেটি একদিকে যেমন কুশলী, মেধাবী শিল্পিত প্রয়োগে অনন্য, অন্যদিকে তেমনি সুখ-দর্শন।

মঞ্চনাটকে অভিনয়ের দুটি প্রধান দিক, একটি বাচিক অভিনয় আর অন্যটি শরীরের ভাষা। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আধুনিক মঞ্চনাটকের উপস্থাপনা ও প্রয়োগে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগে মঞ্চে নাট্যদৃশ্য অনুযায়ী একটি আবহ তৈরি করা হতো এবং পাত্রপাত্রীগণ যতটা সম্ভব দর্শকদের দিকে মুখ করে বসে বা দাঁড়িয়ে সংলাপ বলতেন। দর্শক একটু মনোযোগী হলেই নাটকের ভাষ্য বা বক্তব্য বুঝতে পারতেন। আধুনিক নাট্যফর্ম কিন্তু এর থেকে অনেক ভিন্ন, অনেকটাই আলাদা। এখন এমন অনেক নাটক নির্মিত হচ্ছে, যেগুলোতে একটিমাত্র সেটেই নাটকের সকল দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়, দৃশ্যান্তর বোঝানোর জন্য আলো, মিউজিক বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায়। আলোচ্য ‘খনা’ নাটকেও এই শৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। আবার আধুনিককালের মঞ্চনাটকে অনেক কোরিওগ্রাফি থাকে। তবে কোরিওগ্রাফি অনেক ক্ষেত্রেই সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত লাফালাফিতে পরিণত হয়। সেসব নাটক দেখে দর্শক নাটকের মাথামু- কিছুই বুঝতে পারেন না। যদিও খনা’র কোরিওগ্রাফি ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহনীয়।

রাজ্যের কৌতূহল ও আগ্রহ নিয়ে ‘খনা’ দেখতে গিয়ে প্রথমেই একটু হোচট খেলাম। প্রথম কয়েক মিনিট কোনো সংলাপই বুঝতে পারলাম না। সংলাপ উচ্চারণে অভিনয়শিল্পীবৃন্দ ছিলেন খুবই দুর্বল। আরও বিস্মিত হলাম যখন জানতে পারলাম যে, নাটকটির একাশিতম মঞ্চায়ন এটি। যে-নাটক শত প্রদর্শনীর দ্বারপ্রান্তে প্রায়, তার পাত্র-পাত্রীদের সংলাপ প্রক্ষেপণ এত দুর্বল হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। তবে হ্যাঁ, একথা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ; অনেকে অবশ্য ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়েছেন। নাটকে দেহভঙ্গি বেশি থাকলে কিংবা কোরিওগ্রাফিতে অনেক উলল্ফন থাকলে বাচিক অভিনয় অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। কেননা, আপনি যখন বসে কথা বলবেন তখন আপনার একরকম শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, দাঁড়িয়ে বললে আরেক রকম, হাঁটতে হাঁটতে বললে দম বেশি লাগবে আর দৌড়াতে দৌড়াতে কথা বলতে হলে অনেক বেশি দমের প্রয়োজন হয়। অভিনয়শিল্পী যদি শরীরিকভাবে সক্ষম না হন কিংবা তিনি যদি পর্যাপ্ত মহড়া না করেন তাহলে তাঁর বাচিক অভিনয় মার খাবে, স্পষ্ট উচ্চারণ দর্শকের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না এটিই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে অভিনয়শিল্পীদের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত, দর্শক যখন টিকিট কেটে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে নাটক দেখেন তখন নাটকের প্রতিটি শো ‘সম্পূর্ণ’ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মঞ্চে খনা চরিত্রে সামিনা লুৎফা এবং মিহির চরিত্রে ইভান রিয়াজের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে রসায়ন ভালো ছিল। তবে, পরস্পরের মধ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা বোঝানোর জন্য একের ওপর আরেককে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন খুব জরুরি কি না তা ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে। কেননা, এতে পাত্র-পাত্রীর অনেক প্রাণশক্তি খরচ হয়ে যায়। রাখাল চরিত্রে হুমায়ূন আজম রেওয়াজ, রঘুনাথ চরিত্রে পঙ্কজ মজুমদার এবং জ্যাঠা চরিত্রে আব্দুল কাদের সপ্রতিভ অভিনয়শৈলী প্রদর্শন করেছেন। রানি চরিত্রে শেঁউতি শাহগুফতার অভিনয় ছিল চলনসই। বরাহ মিহির চরিত্রে ইমরান খান মুন্না, রাজা চরিত্রে তৌফিক হাসানকে তুলনামূলক ¤্রয়িমাণ মনে হয়েছে।

পুরো নাটকে আলোর ব্যবহার চমৎকার এবং দারুণ কৌশলী ছিল। আবহসংগীত ছিল সুখশ্রাব্য। পোশাক ও সাজসরঞ্জাম নাটকের বিষয়, কাল ও উপস্থাপনরীতির সঙ্গে ছিল মানানসই।

লীলাবতী খনা ঐতিহাসিক চরিত্র হোক বা না হোক, তিনি মিশে আছেন এদেশের কাদা-মাটি-জলে। তাঁর যে আখ্যান সামিনা লুৎফা নিত্রা আর মোহাম্মদ আলী হায়দার আমাদের উপহার দিয়েছেন, নাট্যমঞ্চে তা তাঁর সময়কাল পেরিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সূচনাকালেও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক ; একথা কৃষিকাজের বেলায় যেমন তেমনি নারীর পরাধীনতা এবং নিগ্রহের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য।

মঞ্চে

খনা : সামিনা লুৎফা নিত্রা

বরাহ : ইমরান খান মুন্না

কঙ্কনা : শারমিন ইতি

রানি : শেঁউতি শাহগুফতা

রাজা : তৌফিক হাসান

মিহির : ইভান রিয়াজ

রাখাল : হুমায়ূন আজম রেওয়াজ

হারান : মাহবুব মাসুম

পঞ্চি কাকি : হাফিজা আক্তার ঝুমা

জ্যাঠা : আব্দুল কাদের

মন্ত্রী : মিজানুর রহমান

রাজকবিরাজ : ম. সাঈদ

কবি : চন্দন পাল

রঘুনাথ : পঙ্কজ মজুমদার

গ্রামবাসী : ইফতি, অশ্রু, পুঁথি, রানা, সানজানা, আশা, লোচন


নেপথ্যে

রচনা : সামিনা লুৎফা নিত্রা

নির্দেশনা : মোহাম্মদ আলী হায়দার

মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা : আবু দাউদ আশরাফী

আলোক প্রক্ষেপণ : মোহাম্মদ আলী হায়দার ও অঙ্ক

সংগীত পরিকল্পনা : ব্রাত্য আমীন, শারমিন ইতি, জিয়াউল আবেদীন রাখাল

সংগীতদল : লায়েকা বশীর, রিশাদুর রহমান রিশাদ, লোচন পলাশ, রেওয়াজ

পোশাক পরিকল্পনা : তাহমিনা সুলতানা মৌ, তৌফিক হাসান

রূপসজ্জা : শেঁউতি শাহগুফতা,

আব্দুল কাদের, শারমিন ইতি

প্রযোজনা ব্যবস্থাপক : রানা তিওয়ারি