ফুলটির নাম সূর্যমুখী। দূর থেকে দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো আর দিনমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে বলে এর নাম সূর্যমুখী। এই গাছ তিন মিটার বা প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। গোলাকৃতির ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার বা ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
হলুদ রঙের সূর্যমুখী ভোর হতে না হতেই পুব দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্য ওঠার পর সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। মাঝ দুপুরে ঊর্ধ্ব পানে চেয়ে থাকে। বিকেলে ফুলের মুখ থাকে পশ্চিম দিকে। কিন্তু কেন এই বিশেষ ফুলটির ক্ষেত্রে এমন ঘটে, বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এর একটা স্পষ্ট উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন। পরিণত অবস্থার আগ পর্যন্ত দিনের বেলায় প্রতিটি সূর্যমুখী সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। কিন্তু পরিণত অবস্থায় পৌঁছার পর এই ফুলটি সেভাবে আর সূর্যকে অনুসরণ করে না, বরং সবসময় পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। উদ্ভিদের মধ্যে একটা বায়োলজিক্যাল ঘড়ির মতো প্রক্রিয়া আছে- যার ফলে সে দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারে এবং কখন সূর্য ওঠে, কখন সূর্য অস্ত যায়, সেটা বুঝতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলে সার্কেডিয়ান রিদম। মানুষের ভেতরও এই সার্কেডিয়ান রিদম আছে, যেটি ২৪ ঘণ্টার একটি চক্র। একটি তরুণ সূর্যমুখী ফুল সকালে পুবদিকে মুখ করে থাকে এবং পরবর্তীসময়ে দিন যত গড়াতে থাকে, ফুলটিও তত পশ্চিমদিকে হেলতে থাকে। রাতের বেলা এটি আবার পুবদিকে মুখ করে থাকার অবস্থানে ফিরে আসে এবং সকালে আবার নতুন করে চক্র শুরু করে। বিজ্ঞানীদের মতে, সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে গাছটির পক্ষে অনেক বেশি ফোটন কণিকা শুষে নেওয়া সম্ভব হয়, আর আলো হচ্ছে গাছের জন্য খাদ্যের মতোই একটি উপাদান। যুক্তরাষ্ট্রর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট বায়োলজির অধ্যাপক স্টেসি হারমার টাইম-ল্যাপস ভিডিও দিয়ে পরীক্ষা করে সূর্যমুখী গাছের এই চক্রের [দিনের বেলা ক্রমাগত পশ্চিমদিকে আবর্তন এবং রাতের বেলা ক্রমাগত পুবদিকে অবর্তন] প্রমাণ পেয়েছেন।
সূর্যমূখী একধরনের একবর্ষী ফুল গাছ। ভোজ্য তেলের উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়। সমভূমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে, উঁচু লালমাটি এলাকায় বর্ষাকালে এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় শীতকালীন শস্য হিসাবে সূর্যমুখীর চাষ হয়। বাংলাদেশের রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাংগাইল প্রভৃতি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখীর চাষ হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। দৃষ্টিনন্দন ফুল হিসেবে সূর্যমুখী সবার কাছে পরিচিত। ফুলটি তেলবীজ হিসেবেও দারুণ সমাদৃত। সূর্যমুখীর বীজ ও তেলে রয়েছে নানা উপকারী গুণ। এই তেল অন্যান্য রান্নার তেল হতে উৎকৃষ্ট এবং হৃদরোগীদের জন্য বেশ কার্যকর। এতে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুবই কম। সূর্যমুখী তেল ভিটামিন এ, ডি ও ই-সমৃদ্ধ। আমাদের শরীরের কার্যমতা বাড়াতে এবং দীর্ঘদিন কর্মক্ষম রাখতেও সূর্যমুখী তেলের ভূমিকা অনন্য। সূর্যমুখী বীজ আমাদের দেহের হাড় সুস্থ রাখে ও মজবুত করে। আমাদের দেহে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও কপারের চাহিদা পূরণ করে সূর্যমুখী তেল।
সূর্যমুখী ফুলে আছে লিনোলাইক অ্যাসিড, যা ত্বকে মেলানিন উৎপাদন কমায়। এছাড়া রোদে পোড়া ত্বক থেকে ট্যান দূর করে সূর্যমুখীর তেল। ত্বকের যাবতীয় সমস্যা যেমন ব্রণ, র্যাশ, ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডস, বলিরেখার প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে। সূর্যমুখীর তেলের লিনোলাইক অ্যাসিড খুব অল্প সময়ে ত্বকের গভীর ক্ষত থাকলে তা সারিয়ে তোলে। যাদের ত্বক স্পর্শকাতর, তারা ত্বকে কিছু লাগাতে ভয় পান। এ ক্ষেত্রে সূর্যমুখীর তেল চোখ বন্ধ করে ব্যবহার করতে পারেন।
এই বীজে আছে ভিটামিন-ই, যা আমাদের দেহের নানা রকম ব্যথা দূর করতে সহায়তা করে। সেইসঙ্গে সূর্যমুখী বীজের তেলে বিদ্যমান ভিটামিন-ই সূর্যের আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি থেকে আমাদের ত্বক রক্ষা করে। ত্বকের অযথা বুড়িয়ে যাওয়া ও য় রোধে এই তেল খুবই উপকারী।
লেখা : শ্যামল কায়া