হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি, রূপকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন ব্যক্তির নাম নয়, এক অনন্য ইতিহাস। যে ইতিহাস মিশে আছে তেরশত নদীর জলের ধারায়, বাংলার সবুজময় প্রান্তরে, গায়ক পাখির ঠোঁটে আর কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়। কালের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু, পরিণত হয়েছিলেন শোষিত মানুষের পরম আত্মীয়ে। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এক অভিন্ন ও অবিভাজ্য। যতদিন এই বিশ্ব থাকবে, থাকবে বৈশ্বিক মানচিত্র এবং ইতিহাস ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবেন বিশ্বাসীর মন ও মননে। কেননা, জীবনবোধ, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও অপরিমেয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করেছেন। তাদের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন আর তা করতে গিয়ে মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি প্রায় চৌদ্দ বছর কারাভোগ করেছেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। পূর্ব-বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এই ভূখ- পূর্ব-পাকিস্তান নাম নিয়ে পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। কয়েক মাস যেতে-না-যেতেই বাঙালি বুঝতে পারে, এই মেকি আজাদী তাদের মুক্তি আনেনি। এ কথা বেশি করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে শুরু করেন। দীর্ঘ ২৩ বছর নিরলস সংগ্রাম করে তিনি বাঙালিকে স্বাধীনতা-আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সূচনা হয় বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লড়াই। চলতে চলতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক অসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য-সহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনায় দেশ শাসন করতে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম-নিশানা মুছে ফেলার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে। ২১ বছর ধরে চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে জাতির পিতার তনয়া শেখ হাসিনা সামরিক শাসকের শাসনামলে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে দেশে এসে পুনরায় তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশ পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। মাঝখানে সাত বছর বাদ দিয়ে আবার তিনি এবং তাঁর দল ২০০৮-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানকে নিয়ে এই প্রথম নির্মিত হয়েছে একটি চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন ভারত ও উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। বঙ্গবন্ধু এমন এক মহান অতুলনীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব যাঁকে চলচ্চিত্র-সহ যেকোনো মাধ্যমে ধারণ ও পরিস্ফুট করে তোলা এককথায় দুঃসাধ্য ও অসম্ভব। কেননা, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস তো বটেই, এমনকি বৈশ্বিক ইতিহাসেও শেখ মুজিবের মতো মহানায়কের আবির্ভাব সহজে ঘটে না বললেই চলে। তবু আমরা আশাবাদী হতে চাই এই দেখে যে, বাঙালি জাতির দীর্ঘপ্রতীক্ষার অবসান হলো অবশেষে।
‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ বাংলাদেশের প্রথম কোনো বায়োপিক। এর আগে দেশে কখনো কারো বায়োপিক নির্মিত হয়নি। নানারকম সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে মুজিবের জীবনীকে পর্দায় তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন শ্যাম বেনেগাল। সিনেমাটির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মোটাদাগে জাতির পিতার জীবন ও সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে পারবে।
চলচ্চিত্রটির সঙ্গে যুক্ত সকলেই কাজটি করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। জানিয়েছেন নিজেদের অনুভূতিও। সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করার অনুভূতি জানিয়ে অভিনেতা আরিফিন শুভ বলেন, ‘মুজিব সিনেমায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতা বলে বুঝানোর মতো নয়। আমি মনে করি এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হয়ে থাকবে। এই সিনেমার পর আর কোনো কাজ না করলেও আমার আক্ষেপ থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছবিটি দেখে প্রশংসা করেছেন।
ইতিহাসনির্ভর কিংবা ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ সত্যিকার অর্থেই খুব দুরূহ কাজ। সময়ের বিবর্তনে বদলে যায় প্ররিবেশ-প্রতিবেশ, তখন চলচ্চিত্রকে প্রামাণ্য করে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রের বেলায়ও একথা সত্যি যে, অনেক সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করেই নির্মাণ করতে হয়েছে ছবিটি। বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রই নির্মাণ করতে চেয়েছেন শ্যাম বেনেগাল। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। কেননা, ঐতিহাসিক চরিত্রনির্ভর চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাণ করা যায় না। এতে অনেক তথ্যবিভ্রাট ঘটে। বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতে হয়।
১০ই জানুয়ারি ১৯৭২, পাকিস্তান থেকে কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বিমান থেকে নেমে মাটিতে কপাল ঠেকান এবং উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ফুলের মালা দিয়ে সাড়ম্বরে মুজিবকে বরণ করেন। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিব তাঁর বক্তব্যে দেশ পুনর্গঠনের বার্তা দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব [রেণু]-র বয়ানে শেখ মুজিবের শৈশব থেকে ঘটনাপ্রবাহ এগোতে থাকে।
কিশোর বয়সে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হকের সাথে পরিচয় হয় মুজিবের। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে [বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ] পড়তে গিয়ে ব্রিটিশ ভারতে মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুজিব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালীন মুজিব হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে পথে নামেন। এর একবছর পর ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে মুজিবও কলকাতার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এতে পূর্ব-পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলিম লীগের এই পূর্ব-পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ভাষার প্রশ্নেœ তার নেতৃত্বে প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের গেট দিয়ে মিছিলটি বের হলে পুলিশ সরাসরি তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এসময়, জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব অনশন পালন করলে জেল কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তার অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে শেখ মুজিব সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমেদ, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মানিক মিয়া এবং শামসুল হক সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে তৎকালীন সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপে প্রতিবাদের পাশাপাশি পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা, বিতর্ক ও দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে শেখ মুজিব পূর্ব-বাংলার রাজনীতিতে খ্যাতি লাভ করেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনে মুজিব অনপ্রাণিত হন ও পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হন ও কারাভোগ করেন। শেখ মুজিব ও তার পরিবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা দাবি ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে।
১৯৭১ খ্রিষ্টব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে [বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান] শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রদান করেন ও স্বাধীনতার ডাক দেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টব্দের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা পরিচালনা করলে মুজিব বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র্র হিসেবে ঘোষণা করে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি কারাভোগ করেন। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে বেগম মুজিব রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচার গণহত্যা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত সরকার বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
১৯৭২ খ্রিষ্টব্দে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে ক্ষমতা গ্রহণের পর অগ্রজদের দিগনির্দেশনা গ্রহণ এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাফল্য লাভ করেন। এই সময় সংবিধান প্রণীত হয় এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একসময় দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টির হয়। পরবর্তীসময়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ নামে একটি অস্থায়ী জাতীয় দল গঠন করা হয়। এই বিষয়ে পত্র-পত্রিকার সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে শেখ ফজলুল হক মনি কয়েকটি পত্রিকার উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। নবগঠিত দলের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। মুজিবের দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিবাহ অনুষ্ঠান শেষে মুজিবের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে যান।
মুজিব তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ সফল করতে সকলকে একত্র হয়ে কাজ করার আহবান জানান। এইসময়, শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর সামরিক বাহিনীর কয়েক জন জেনারেলের সাথে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক করেন। শেখ কামাল জামালের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসে ভারতের রাষ্ট্রদূত সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বরাত দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চলমান সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক করেন। কিন্তু শেখ মুজিব বিশ^াস না করে বার্তাটি উপেক্ষা করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টব্দের ১৫ই আগস্ট রাতে একদল সামরিক অফিসার শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে।
ইতিহাসের ঘটনার সঙ্গে চলচ্চিত্রে প্রস্ফুটিত ঘটনার বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে। সেগুলো এমন :
প্রথম দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘অচিন মাঝি কোন সে পারের বন্ধু’ গানটি শোনা যাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে বিমানে জানালার পাশে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর মুখোমুখি ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর তামাকের পাইপে তামাক ভরছেন। বঙ্গবন্ধু তামাক পছন্দ করতেন ঠিকই তাই বলে বিমানে বসে তিনি পাইপে তামাক ভরছেন এটি দেখানো অনিবার্য ছিল কি ? কেননা, বিমানে তো তিনি পাইপ ব্যবহার করতে পারেননি। তাহলে পাইপে তখন তামাক ভরবেন কেন বঙ্গবন্ধু ? তখন তিনি তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল ও উদ্গ্রীব ছিলেন, তাই নয় কি ?
বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। তখন কলাভবন ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের ভেতরে। চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে ‘মুজিব’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম রিকশায় আসেন এবং নামেন বর্তমান কলাভবনে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় থাকা লাখো জনতার মধ্যে স্বাধীন দেশে পা ফেলেন তিনি। তখন বিমানের সিঁড়িতেই বহু মানুষ তার গলায় মালা পরান। তখন সিঁড়ির কাছেই হাজারো মানুষ ভিড় করে, সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চায় এবং জাতির পিতাকে স্পর্শ করতে চায়।
অথচ ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, মুজিব বিমানের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামছেন, সঙ্গে মাত্র তিনজন লোক, পাশে লাল কার্পেট বিছানো, সুসজ্জিত ব্যান্ড পার্টি দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে আছেন মালা হাতে নেতৃবৃন্দ। সিঁড়ি থেকে নেমে তিনি মাটিতে কপাল ঠেকিয়েছেন। তারপর এক মুঠো মাটি তুলে কপালে ছুঁইয়েছেন।
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় শেখ মুজিব কলকাতার বেকার হোস্টেলে ছিলেন। বেকার হোস্টেল সস্থানে বর্তমান। মুজিব যে ঘরটিতে থাকতেন, সেটিকে জাদুঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। অথচ চলচ্চিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল বেকার হোস্টেল হিসেবে দেখানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। তখন কলাভবন ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের ভেতরে। চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে ‘মুজিব’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম রিকশায় আসেন এবং নামেন বর্তমান কলাভবনে।
ইতিহাস বলে, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে মুজিব পরিবার যখন প্রথম প্রবেশ করে তখন বাড়িটি তিন রুমের একতলা একটি বাড়ি ছিল। “১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়।” [ শেখ মুজিব আমার পিতা, শেখ হাসিনা, পৃ. ৬৮] অথচ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে দোতালা বাড়িতে প্রবেশ করছে কিশোরী শেখ হাসিনা, কিশোর শেখ কামাল ও শেখ জামাল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলাভবন গেট দিয়ে ছাত্রদের যে মিছিল বের হয় সেই মিছিলে গুলি হয়নি, সেই মিছিলের কেউই মারা যাননি। প্রথম মিছিল বের হবার পাঁচ ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে তিনটায় ছাত্রদের জমায়েতে পুলিশ গুলি চলাল। “প্রায় বেলা ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতারী বরণ করতে লাগল। তখন ধীরে ধীরে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে, মেডিক্যাল কলেজ গেটে ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে গিয়ে জমায়েত হতে থাকে। ... ছাত্ররা যতই স্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় ততই পুলিশ তাদের হানাা দেয়। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদনে গ্যাস ছাড়ল আর তাড়া করতে করতে মেডিক্যাল হোষ্টেলের ভেতর ঢুকে পড়ল। হোষ্টেল প্রাঙ্গণের ভেতরে ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয়ে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। একদিকে ইট-পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে। পুলিশ তখন দিগবিদিকজ্ঞান শূন্য হয়ে ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আব্দুল জব্বার আর রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন। আর ১৭ জনের মতো গুরুতরভাবে আহত হয়। তাদের হাসপাতালে সরানো হয়। তাদের মধ্যে রাত আটটার সময় আবুল বরকত শহীদ হন।” [একুশের ঘটনাপঞ্জী, কবির উদ্দিন আহমদ ; একুশে ফেব্রুয়ারি, সম্পাদনা হাসান হাফিজুর রহমান, পৃ. ১৪২-১৪৩] অথচ শ্যাম বেনেগালের ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ ছবিতে দেখিয়েছেন গেট দিয়ে বের হওয়া মিছিলেই গুলি হয়।
শ্যাম বেনেগালের মুজিব : একটি জাতির রূপকার চলচ্চিত্রে যুবক মুজিব ও কিশোরী রেণুর জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজন দেখানো হয়েছে। কিন্তু মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যখন তার বিয়ে হয় তখন বয়স বার তের হতে পারে। রেণুর বয়স তখন তিন বছর হবে। “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের হতে পারে।... মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৭] তবে, নিতান্ত বালক বেলায় বিয়ে হলেও মুজিবদম্পতির ফুলশয্যা হয় মুজিবের বয়স তখন ২২ বছর। “যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।” [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১]
মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ধানমন্ডির একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। শ্যাম বেনেগালের চলচ্চিত্রে দেখা গেল ঝকঝকে তকতকে প্রায় নতুন একটি বাড়িতে তারা রয়েছেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করলেও ফজিলাতুন্নেসা মুজিবরা ছিলেন অবরুদ্ধ। ১৭ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় সৈন্যরা তাঁদের উদ্ধার করতে যায় তখন সৈন্যরা পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে। শ্যাম বেনেগাল দেখান ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর অশোক তারা একাই তাদের উদ্ধার করতে যান এবং পাকিস্তানি একজন সৈনিক তার বুকে রাইফেলের বেয়েনেট দিয়ে খোঁচা দেন। তার আগে ওই বাড়িতে একজন বিদেশি সাংবাদিক এলে সৈন্যরা তাকে গুলি করে মারে। বান্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন কথাই বলে। শেখ হাসিনা তাঁর শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থে লিখেছেন, “আজ ১৭ ডিসেম্বর। সারারাত গুলি চালাবার পর একটু বিরতি। রমা এসে বলল, গেটে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক এসেছিল, পাকসেনারা ওদের ঢুকতে দেয়নি। হাবিলদারটা ঘুমুচ্ছে তাই রক্ষে, নইলে ঠিক গুলি চালিয়ে দিত।
এর মধ্যেই দেখলাম ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে এবং পাকসেনাদের সারেন্ডার করবার জন্য চাপ দিচ্ছে।” [পৃ. ৫২]
‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রের একটি বড়ো দুর্বলতার দিক এর ভাষা। পাত্র-পাত্রীরা যে বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেছেন তা বোঝা যায়নি। যে যেমন পেরেছেন তেমন বলেছেন। এরচেয়ে পুরো চলচ্চিত্রে সবাই প্রমিত বাংলায় সংলাপ উচ্চারণ করলে তা সমীচীন হতো।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য আরিফিন শুভ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। অমন একটি চরিত্র ধারণ করা এবং সেটিকে ফুটিয়ে তোলা সত্যি দুঃসাধ্য। তবে, তাকে যে পরচুলা পরানো হয়েছে সেটি স্পষ্ট বোঝা গেছে। এখানে মেক-আপ আর্টিস্টের আরো যতœবান হওয়া উচিত ছিল। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা উৎরে গেছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী লাল মাওলানার চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। মানিয়ে গেছে বৃদ্ধ বয়সের শেখ লুৎফর রহমান চরিত্রে খায়রুল আলম সবুজকেও। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শেখ লুৎফর রহমানের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী ভীষণ ফ্লপ। চরিত্রের ভেতরেই প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকায় তৌকির আহমেদ এবং তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকায় রিয়াজ প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন। সায়েরা খাতুনের চরিত্রে সংগীতা চৌধুরী [অল্প বয়স] এবং দিলারা জামান [পরিণত বয়স] সুন্দর অভিনয় করেছেন।
মুজিব : একটি জাতির রূপকার
কুশিলববৃন্দ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে নির্মিত ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ ১৩ অক্টোবর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রযোজনায় সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন ভারতের স্বনামধন্য নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। ছবিটির নির্মাণ ব্যয় ৮৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মোট অর্থের ৫০ কোটি ও ভারত ৩৩ কোটি টাকা দিয়েছে। সিনেমাটিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। খন্দকার মোশতাক আহমদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, কিশোর শেখ মুজিব চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্য জ্যোতি। রেণু [শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব] চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, শেখ হাসিনা চরিত্রে নুসরাত ফারিয়া, শেখ রেহানা চরিত্রে সাবিলা নূর, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে রিয়াজ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকির আহমেদ, এ কে ফজলুল হক চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু, টিক্কা খান চরিত্রে জায়েদ খান। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন খায়রুল আলম সবুজ [লুৎফর রহমান], দিলারা জামান [সাহেরা খাতুন], সায়েম সামাদ [সৈয়দ নজরুল ইসলাম], প্রার্থনা ফারদিন দীঘি [ছোটো রেণু], গাজী রাকায়েত [আবদুল হামিদ], সিয়াম আহমেদ [শওকত মিয়া], মিশা সওদাগর [জেনারেল আইয়ুব খান] ও এলিনা [বেগম খালেদা জিয়া]। সিনেমাটিতে ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীজা ভট্টাচার্য, রাজেন মোদি, দেবাশীষ নাহা, সোমনাথ, কৃষ্ণকলি গাঙ্গুলি, আবির সুফি, অরুণাংশু রায় প্রমুখ।