ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

21 Nov 2023, 03:26 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আমাদের দুই দিনের অসলো ভ্রমণের আজ শেষ দিন, আসলে অসলোতে আমরা কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক ঘুরতে আসিনি। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বার্গেন থেকে অসলো অথবা অসলো থেকে বার্গেন যাই বলি না কেন এই পথে ট্রেন জার্নি। আমরা যাত্রাপথে দিন এবং রাত এই দুই সময়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চেয়েছিলাম, বাড়তি পাওনা হিসেবে অসলোর কিছু বিশেষ জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ হলো আর ফারজানার জন্য পোয়াবারো ছিল তার পুরোনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ। আজ সকালের শুরু থেকে শেষ বিকেল পর্যন্ত সময়ে আমরা মোটামুটি অলস সময় কাটিয়েছি অর্থাৎ প্রায় উদ্দেশ্যহীনভাবেই ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন এই শেষ বিকেলে এসে কী করবো ভাবতে ভাবতে একটি শপিং মলে ঢুকে পড়লাম। গতদিন বেশ করে উইন্ডো শপিং হলেও আজ কিছু সত্যিকার শপিং হোক। আমাদের ইউরোপে থাকার সীমা ফুরিয়ে আসছে, জানুয়ারিতে আমরা দেশে ফিরে যাবো, প্রিয়জনদের জন্য ইউরোপ থেকে স্যুভেনির হিসেবে কিছু তো নেওয়া উচিত তাই না ? তাই সুযোগ পেলেই টুকটাক শপিং করে নিচ্ছি। এখানেও এই ভেবে ঢুঁ মারা, যদিও পরিকল্পনামাফিক শপিং আমি কোনো কালেই করতে পারি না এবারেও তাই হলো, গেলাম স্যুভেনির টাইপ কিছু টোকেন গিফট কিনবো বলে, গিয়ে পছন্দ করে ফেললাম শীতের পোশাক। আসলে অসলোতে যে শীত, শীতের পোশাকের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা বা টান তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর যাদি দোকানের সামনে বিশাল করে লেখা থাকে সেলের খবর তাহলে তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে আমার নিজেকে সেলহোলিক মনে হয়। যাই হোক, সেল থেকে টুকটাক কেনাকাটা সেরে আমরা অসলো সেন্ট্রালের দিকে রওনা হলাম।

আগেই বলেছি, ইউরোপজুড়ে ইতোমধ্যে ক্রিসমাসের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে, প্রায় প্রতিটা শহরের ঠিক মাঝখানে একটি করে কার্নিভালের আয়োজন যেন থাকতেই হবে। কোথাও ছোটো পরিসরে কোথাও বা বিশাল আয়োজনে। অসলো যেহেতু নরওয়ের রাজধানী, স্বাভাবিকভাবে এখানকার আয়োজন জমকালো হবে। আর আমাদের হাতে যেহেতু এখনো কয়েক ঘন্টা সময় আছে তাই জমকালো কার্নিভাল দেখার এ সুয়োগটি হাতছাড়া করার কোনো কারণই নেই। আমরা কার্নিভালেই চলে গেলাম। ইউরোপে এই প্রথম আমি কোনো কার্নিভালে এলাম। আমাদের দেশে এক্সিবিশনগুলো যেমন হয় কার্নিভালের সাজসজ্জা অনেকটা সে রকমই। পুরো এলাকা আলোক সজ্জায় সজ্জিত, রয়েছে বিনোদনের বাহারি আয়োজন, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খাবারের দোকান আর আছে বাহারি পণ্যের পসরা। যেহেতু কেনাকাটা করার আর কোনো সুযোগ (অর্থ-কড়ি) বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই তাই শুধু ঘুরেফিরে দেখাই মূল কাজ। যদিও পেট কিছু খেতে চাচ্ছিল কিন্তু সেই পুরোনো সমস্যা হালাল-হারামের বাছ-বিচারে সে ইচ্ছেকেও পাত্তা দেওয়া গেল না। তবে, খালিমুখে ঘুরতেও খারাপ লাগছিল না। কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ, চারদিকে লোকজনের আনাগোনা, হৈচৈ আর এরই মাঝে মাঝারি ভল্যুমে মিউজিক।

সন্ধেটা এই চমৎকার এক আয়োজনের মাঝে বেশ কাটলো, ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে রাত ; আমরা আবার বাসে চড়ে বসলাম, এবার গন্তব্য রিংকুর বাড়ি। সারাদিন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরিতে শরীরে যে ক্লান্তি ভর করেছে তা এখন টের পাচ্ছি, আসলে এতক্ষণ তো টের পাওয়ার সুয়োগই হয়নি, ঘুরে বেড়ানোতে এতই মশগুল ছিলাম এমনকি সারাদিন যে পেটে ভারি কিছু পড়েনি তাও মনে ছিল না। এখন ফ্রেশ হয়ে চা-নাশতার সাথে ক্ষানিকক্ষণ আড্ডা চলল এরপর গোছগাছের তোড়জোড়। কারণ, রাতের খাবার খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়বো। অবশ্য গোছগাছের তেমন কিছু নেইও, কেননা আমরা ব্যাকপ্যাক নিয়েই বেরিয়ে ছিলাম, তাও যতটুকু না হলেই নয় ।

খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা হাতে কিছুটা সময় নিয়েই বের হলাম। কারণ রিংকুর বাড়ি অসলোতে হলেও এলাকাটা শহরতলীতেই পড়ে। বেশ নিরিবিলি একটা গ্রাম্যভাবও আছে। এখান থেকে ট্রেন স্টেশন যেতে মিনিট পঁচিশেক সময় লাগবে, শহরতলী হওয়ায় এখানে বাসের আনাগোনা খুব বেশি না, একটা বাসের পর আরেকটি বাস আসতে সময় নেয় প্রায় বিশ মিনিট, তাই বাস মিস করলে ওদিকে ট্রেন মিসের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই রিস্ক না নিয়ে একটু আগেভাগেই বেরিয়ে পড়া। পথে বের হতেই শীতের দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার হলাম। একে তো নভেম্বরের শেষ, শীত যে জাঁকিয়ে বসবে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু সাথে তুষারপাত, একে তুষারপাত না বলে তুষার বৃষ্টি বলা ভালো। সাথে ছাতা থাকাতেও রক্ষা নেই। বাস স্টপে ছাউনি বলতে টেলিফোনবুথের আদলে একটি কাচের ঘর, যেখানে পাশাপাশি দু’জন মানুষের দাঁড়িয়ে থাকাও দুরূহ বলা যায়। প্রায় মিনিট বিশেকের মতো অপেক্ষার পর বাসের দেখা মিলল। আবহাওয়া খারাপ বলে হয়ত সময় বেশি লেগেছে। এরপর রাতের একটুকরো অসলো দেখতে দেখতে স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া। এরপর শুধু ট্রেনের অপেক্ষা। স্টেশনে পৌঁছে বেশ স্বস্তি লাগছিল, ট্রেন ছাড়তে আর পনের মিনিট বাকি, এদিকে ঠান্ডা থেকেও বাঁচা। এই পনের মিনিট স্টেশনের দোকান-পাট দেখতে দেখতেই কেটে গেল।

নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়লো এখনো রীতিমতো ফাঁকা কম্পার্টমেন্ট আমি আর ফারজানা মুখোমুখি চারটি সিট দখল করে বসেছি। অন্যেরাও তাই, অনেকেই ঘুমানোর তোড়জোড় করছে আমরাও কাঁথা কম্বল গুছিয়ে নিয়ে বসেছি, ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়ব। সারারাত অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য কতটাই বা দৃশ্যমান হবে নিশ্চয়ই একঘেয়ে লাগবে, এমন সন্দেহ তো ছিলই। যা হোক, ট্রেনের গতি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরাও শহর ছাড়িয়ে গেলাম। ঘুম চোখে বাইরের চরাচর দেখার চেষ্টা। না চেষ্টা বৃথা না, সাদা শুভ্র তুষারে ছাওয়া চরাচর খুবই দৃশ্যমান। চাঁদের একটা মায়াবী আলোয় চারিপাশ কেমন মায়াময়, স্বপ্ন স্বপ্ন আবহের রূপ নিয়েছে। বিস্তীর্ণ তুষার ছাওয়া পথ পেরিয়ে মাঝে মাঝেই দেখা মিলছে ছোটোখাটো জনপদের। কোনো কোনো বাড়ির আঙিনায় মিটমিট করে আলো জ¦লছে। মাঝে সাঝেই ছোটো-বড়ো স্টেশনের দেখা মিলছে। না সবকটিতে কিন্তু ট্রেন থামছে না। দু’একটিতে অল্প সময়ের জন্য থামছে, হয়ত কেউ নামছে আথবা উঠছে ; যেহেতু আমাদের কম্পার্টমেন্ট থেকে কেউই নামেনি বা ওঠেনি তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।

ভেবেছিলাম হয়তো ট্রেন চলতে শুরু করলেই ঘুম দেবো, ফারজানা কিছুটা চেষ্টাও করেছিল, আমি আর সে পথে যাইনি ; এমনিতেই আমি জার্নিতে ঘুমুতে পারি না আর সেখানে প্রকৃতির এই আপরূপ শোভা উপভোগ করার সুবর্ণ সুযোগ বাদ দিয়ে ঘুমানো তো রীতিমতো অপরাধ। শীতের দীর্ঘ একটা নির্ঘুম রাত পথপাড়ি দিয়ে আমরা ভোরবেলায় আমাদের পুরোনো গন্তব্যে ফিরে এলাম। বার্গেনের সকাল তখনো কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। সূর্যও আলস্য ছেড়ে ওঠেনি, আগেই বলেছি, ইউরোপে শীতের সূর্য সকাল নয়টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।

স্টেশনের ঠিক উল্টো পাশেই লাইট ট্রেন বা বিবানের স্টপেজ, আমরা প্রিয় বিবানে চড়ে ফিরে এলাম আমাদের প্রিয় ফ্যান্টপে, আমাদের স্টুডেন্ট হাউজে। আগেই বলেছিলাম, আমরা অনেকটা চুপিসারেই হুট করে অসলোতে চলে গিয়েছিলাম। চুপিসারে যাওয়ার কারণ আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল চলছে, দুই পরীক্ষার মাঝের গ্যাপে আমাদের এই ট্যুর, আমরা বুঝে-শুনেই গিয়েছি কিন্তু আমাদের সহপাঠী যারা পড়া শোনার ব্যাপারে খুব বেশি সিরিয়াস তাদের কাছে আমাদের এ আচরণ পাগলমি বলেই মনে হবে, কে চায় বলেন সেধে পড়ে অন্যের কাছে নিজেকে পাগল বলে উপস্থাপন করতে। দুই পরীক্ষার মধ্যবর্তী সময়টা আমরা অসলোতে যাওয়ার জন্য বেছে নেওয়ার একাধিক কারণও ছিল ; এক. আমাদের বার্গেনে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল, এরপর হয়ত আর অসলো যাওয়ার সুযোগ হতো না, দুই. সে সময় ট্রেনের টিকেটে বিশেষ ছাড় চলছিল। এছাড়া দুই পরীক্ষার মাঝে দিন পাঁচেকের এই লম্বা বিরতি আসলেই দরকার ছিল না, তাই আমরা সময়টা কাজে লাগালাম। পরীক্ষার প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন এ নিয়ে কিছু না বললেই নয় , বলেছি বোধহয় প্রথম পরীক্ষাটা ছিল হোম এক্সাম, ঘরে বসে তিনদিন ধরে মোটে তিনটে প্রশ্নের উত্তর লেখা। অবশ্য শুনতে যতটা সহজ আদতে কিন্তু হোম পরীক্ষা অতটা সহজ নয় ; এটা বুঝতে পেরেছি দ্বিতীয় পরীক্ষা যেটা পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দিতে হয়েছে তা দেওয়ার পরে। সে কথায় পরে আসছি, এখন বাড়িতে বসে পরীক্ষা দেওয়ার বিড়ম্বনার কথা বলি। এ যেন কলেজে পড়া “ঞযব অহপরবহঃ গধৎরহবৎ”-এর সেই বিখ্যাত উক্তির মতো “ধিঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎু যিবৎব, হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ”. ভেবেছিলাম রুমে বসে তিনদিন ধরে পরীক্ষা দেবো, এ আর এমনকি, আসলে এ ছিল ঢাল-তলোয়ারসমেত নিধিরাম সরদারের অবস্থা, অর্থাৎ আমার কাছে সবই আছে কিন্তু শর্তের বেড়াজালে এগুলো আমার তেমন কাজেই এলো না।  [চলবে]