জ্যোতিময় জ্যোতি

23 Oct 2023, 01:04 PM মুভিমেলা শেয়ার:
জ্যোতিময় জ্যোতি

বর্তমান সময়ে অনেক গ্ল্যামার নায়িকার আবির্ভাব হচ্ছে, তাদের ঝলকে অভিনয়শিল্পীরা যেন প্রায় হারিয়েই যাচ্ছেন। তবুও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগ্রাম করে অভিনয় ভালোবাসেন বলে শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেক অভিনয়শিল্পী প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। এদেরই একজন জ্যোতিকা জ্যোতি। ময়মনসিংহের ‘বহুরূপী থিয়েটার’ দিয়ে অভিনয়ের পাঠ শুরু অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতির। মঞ্চে না উঠলেও প্রথম সুযোগ পান কবরী সারোয়ার পরিচালিত ‘আয়না’ ছবিতে। প্রথম ছবিতেই পাশ করেন তিনি। এরপর কাজ করেন নাটক, টেলিফিল্ম, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রসহ নানা শাখায়। বর্তমানে একাধিক সিনেমায় ব্যস্ত এই অভিনেত্রী। পাশাপাশি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক (গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা হয় বর্তমান সময়ে শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে। কথা বলেন আনন্দভুবন সম্পাদক ইকবাল খোরশেদ। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন শেখ সেলিম...

যারা জানে জীবন থেকে তারা কী চায় এবং সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাদের জন্য এই পৃথিবী খুবই সুন্দর। আমরা সবচেয়ে সুখী, যখন আমরা কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সংগ্রাম করি। যখন আমরা একটা গন্তব্যে পৌঁছে যাই, তখনই অন্য একটি বড়ো গন্তব্য ঠিক করা খুবই প্রয়োজন। না হলে একধরনের অবসাদ ঘিরে ধরতে পারে। ডব্লিউ ক্লিমেন্ট স্টোন এটাকে ইনস্পিরেশনাল ডিসস্যাটিসফেকশন [inspirational dissatisfaction] বলেছেন। সেই লক্ষ্য নিয়েই অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতির মিডিয়ায় পথচলা।

ছেলেবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল জ্যোতির। স্বপ্ন বুনতেন, দেখতেন একদিন তাকেও পর্দায় দেখা যাবে। কিন্তু মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ভর্তি হলেন স্থানীয় ‘বহুরূপী থিয়েটারে’। পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমিতে চার বছরের অভিনয়ের কোর্স সম্পন্ন করেন। সেইসঙ্গে ময়মনসিংহে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন তিনি।

আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইংরেজিতে ¯œাতকোত্তর করার পর যেখানে চাকরির পেছনে ছুটবেন, তা না করে জ্যোতি বেছে নিলেন অভিনয়কে। অনেকে হয়ত বিষয়টা নিয়ে নাক ছিটকাতেন, কিন্তু জ্যোতি সেই দিকে না তাকিয়ে কীভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হবেন তা নিয়েই সাজাতেন তার রোজনামচা। জ্যোতি জানতেন ভালো অভিনয়শিল্পী হতে হলে তাকে আগে অভিনয় শিখতে হবে। অভিনয় শেখার মনোভাব নিয়ে যোগ দেন ময়মনসিংহের ‘বহুরূপী থিয়েটারে’। তবে এ নাট্যদলের হয়ে মঞ্চে ওঠার সুযোগ হয়নি তার। এর মধ্যেই সুখবর এলো জ্যোতির। ময়মনসিংহে একটি শুটিং ইউনিট যায়। সেখানে জ্যোতি একটি চরিত্রে কাজের সুযোগ পান। জ্যোতির অভিনয় দক্ষতা দেখে ওই দলের একজন জ্যোতিকে জানান, কবরী আপা নতুন একটি ছবি শুরু করতে যাচ্ছেন ; তুমি চাইলে ছবি পাঠাতে পার। অনেক ভেবে একবুক স্বপ্ন নিয়ে ছবি পাঠালেন ; এবং নির্বাচিতও হলেন। একেই বলে ভাগ্য। অর্থাৎ প্রথম অভিযানটাই হয়ে গেল ইতিহাস। সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন জ্যোতি। প্রথম ছবিতেই পাস করলেন তিনি। প্রশংসা কুড়ালেন সকলের।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জ্যোতি ‘আয়না’ ছবির পর সুযোগ পান বেলাল আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ এবং তানভীর মোকাম্মেলের ‘রাবেয়া’, ‘জীবনঢুলি’ ও আজাদ কালামের ‘বেদেনী’ ‘অনিল বাগচির একদিন’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ কলকাতার ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।

সবশেষ ৮ আগস্ট মুক্তি পায় জ্যোতি অভিনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বঙ্গমাতা’। এর আগে বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন জ্যোতি। এবার দেখা গেল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চরিত্রে।

বঙ্গমাতার চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে জ্যোতি বলেন, ‘এটা আমার সৌভাগ্য, একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জিংও। একধরনের চাপ ছিল এত বড়ো একজন মানুষের চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার। এর জন্য অনেক প্রস্তুতিও নিয়েছি।’

ছবিতে তার সাবলীল অভিনয় নজর কাড়ে অনেকের। সুযোগ আসে ছোটোপর্দায়। ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছোটোপর্দায়। কাজ করেন নূরুল আলম আতিক, অনিমেষ আইচ, সালাউদ্দিন লাভলুসহ মেধাবী পরিচালকের। অভিনয়ের পাশাপাশি সুযোগ আসে উপস্থাপনার, সেখানেও সফল হন এই অভিনেত্রী।

জ্যোতিকা জ্যোতি ছোটো ও বড়োপর্দার অভিনয় ছাড়াও তিনি উপস্থাপনা করেও বেশ প্রশংসিত হন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে লাক্স-আনন্দধারা ফটোজেনিক প্রতিযোগিতায় সেরা দশে স্থান করে নিয়েছিলেন।

এতদিন অভিনয়েই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন জ্যোতিকা জ্যোতি। কিন্তু ইদানীং পছন্দসই গল্প পাচ্ছিলেন না। তাই বেশ কিছুদিন ধরেই অভিনয়ের বাইরে একটা কিছু করার কথা ভাবছিলেন। তাছাড়া বাড়তি উপার্জনেরও দরকার ছিল। এর মধ্যেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ পেলেন এই অভিনেত্রী। দুই বছর মেয়াদে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

আপনার অভিষেকটা হলো বড়োপর্দার কাজের মাধ্যমে, প্রথম কাজের গল্পটা জানতে চাইলে জ্যোতি বলেন আমি তখন শিক্ষকতাও করতাম, হঠাৎ ক্লাশের মধ্যে ফোন এলো, আমি পিক করলাম, ভারি কণ্ঠে জানতে চাইলাম, আপনি কে ? অপরপ্রান্ত থেকে বললেন, আমি কবরী, নামটি শুনেই আমি ছাত্রদের ইশারা করে বের হয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা শুরু হলো, তিনি জানালেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আমাদের একজন অভিনয়শিল্পী প্রয়োজন, নায়ক ফেরদৌস। এখনো অন্যান্য শিল্পী ঠিক হয় নি, তুমি ঢাকা এসো, কথা বলি। ফেরদৌস ভাইয়ের কথা শুনে তো আমি আরো উচ্ছ্বসিত, কারণ ফেরদৌস ভাই ছিল আমার প্রিয় নায়ক। যদিও আমি কখনো কোনো বিষয় নিয়ে এতটা উচ্ছ্বসিত হই না, কারণ আমি এসএসসিতে সব বিষয়ে লেটারমার্কসসহ ৮৮৭ নম্বর পাই, তখনও আমি এতটা উচ্ছ্বসিত হইনি, যতটা হয়েছি ফেরদৌস ভাইয়ের বিপরীত কাজ করব শুনে। এরপর কোনো রকমে ক্লাশটা শেষ করে বাড়ি ফিরি, ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিই, শঙ্কিত মনে ঢাকায় এলাম, ভেতরে প্রবল শক্তি ও আত্মবিশ^াস ছিল, আমি নির্বাচিত হব। নির্বাচিত হলাম, সেই সময়ের স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। কাজ যখন শুরু হলো, একটু ভয় কাজ করছিল, কিন্তু আত্মবিশ^াসের কাছে ভয়কে জয় করে নিই।

ছবিতে যখন কাজ করছিলেন সেই সময়ে লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলছিল, সেখানেও অংশ নেন জ্যোতি। সেখানে টপটেনে আসায় আরো পরিচিতি পান জ্যোতি, সেই সূত্র ধরে নির্মাতা অনন্ত হীরা তাকে একটি মেগাসিরিয়ালের জন্য নির্বাচিত করেন। মূলত এই মেগাসিরিয়ালই তাকে পরিচিতি এনে দেন। আয়না ছবির সহযোগী পরিচালক ছিলেন বেলাল আহমেদ, জ্যোতির অভিনয় দেখে বেলাল আহমেদ তাকে ‘নন্দিত নরকে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত করেন।

‘আয়না’ থেকে বঙ্গমাতা ক্যারিয়ারের দীর্ঘ যাত্রা- এর মাঝে আরো কয়েকটি সিনেমায় কাজ করেছেন, প্রত্যেকটি সিনেমাই ভিন্ন ট্র্যাকের এই বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যোতি বলেন, নতুন মুখ নিয়ে কাজ করতে নির্মাতারাও আগ্রহ দেখান, আমি যখন ‘আয়না’ ছবির শুটিং করছিলাম, সেসময়ে অনেক নির্মাতার সঙ্গে বাণিজ্যিক ধারার ছবি নিয়ে কথা হয়েছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারিনি, তাই কাজগুলো করা হয়ে ওঠেনি।

আমরা চলচ্চিত্রকে ভাগ করতে চাইছি না, চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রই, ক্ষেত্র আলাদা হতে পারে জ্যোতি বলেন, সেসময়ে অনেকে আমাকে সাজেশন দিয়েছিলেন, তোমার ফেস ছবির ফেস, তুমি সব ধরনের ছবিতেই কাজ করো, কিন্তু আমি সাহস পাইনি গল্প ও ছবির নাম শুনে। সেই সময়ে আমাদের ইন্ডস্ট্রির সবচেয়ে খারাপ সময়ে গেছে। সেই সময়ে আমি প্রচুুর নাটকে কাজ করি। আর অপেক্ষায় থাকি ভালো সিনেমার জন্য। যখনই ভালো গল্প পেতাম কাজ করতাম।

বঙ্গমাতা ছবিতে কাজ করা প্রসঙ্গে জ্যোতি বলেন, ‘মুজিব : একটি দেশের রূপকার’ ছবিতে বঙ্গমাতা চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলাম, সেখানে করতে পারিনি। এটা নিয়ে অনেকে আপশোসও করেছিলেন। যাই হোক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে কাজ করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য অনেক বড়ো প্রাপ্তি। যেহেতু মুজিব ছবিতে বঙ্গমাতা করতে পারিনি, এটা ছিল আমার জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জিং। কাজটি শেষ করলাম এরপর প্রহর গুনতে শুরু করলাম, কখন ছবিটি মুক্তি পাবে। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ৮ আগস্ট। মুক্তি পেল ছবিটি। ছবিটি যারা দেখেছেন অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, এটাই আমার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া।

আপনার কাছে জানতে চাই, নাটক ও সিনেমার মধ্যে পার্থক্য কী, জ্যোতি বলেন, নাটক ও সিনেমা দুই জায়গায়ই অভিনয় করতে হয়, নাটকে বাজেট কম থাকায় একটু তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে হয় সিনেমায় একটু সময় নিয়ে বুঝেশুনে শট দিতে হয়। তবে একজন ভালো অভিনয়শিল্পী তার সেরাটা দিয়েই দুই মাধ্যমে কাজ করেন। সেখানে অভিনয়ই মুখ্য বিষয়।

অভিনয়শিল্পী না হলে কী হতেন, জ্যোতি বলেন, রাজনীতিবিদ অথবা সাংবাদিক। পারিপাশির্^কতার কারণে সেটা সম্ভব হতো কিনা জানি না, হয়ত ৯-৫টা অফিস করতে হতো।