ইউরোপের ১৫০ দিন সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

26 Sep 2023, 03:32 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


দুপুর অনেক আগেই ফুরিয়েছে, এখন বিকেলও তার ঝাঁপি গুছাচ্ছে ; সন্ধের মুখোমুখি সময়টা আমরা পায়ে হেঁটেই এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। চলতি পথে ঝাঁ চকচকে শপিংমল দেখে থমকালেও থামলাম না পথ চলতে চলতে উইন্ডো শপিং করেই সন্তষ্ট থাকতে হলো। আসলে আমাদের তখনকার গন্তব্য ছিল নোবেল পিস সেন্টার, ভাবলাম অসলো এলামই যখন তখন শান্তিতে নোবেল পাওয়ার জন্য একটু তদ্বির করে যাই, কী বলেন ? অপেরা হাউজ থেকে নোবেল পিস সেন্টার পায়ে হেঁটে বিশ মিনিটের মতো পথ, তবে পথ না চেনার কারণে সময় বেশিই লেগে গেল। এখানে একটি বিষয় খুব অবাক করা ছিল, বারগেনে যদি কাউকে কোনো ঠিকানা জিজ্ঞেস করা হয় অথবা কারো কাছে কোনো ধরনের সাহায্য চাওয়া হয় তারা যতটা সম্ভব বিনয়ের সাথে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে, না পারলেও মুচকি হেঁসে বিনয়ের সাথে তা জানায়। এখানে ঠিক যেন উল্টো, চলতি পথে কাউকে তো থামানোই যায় না আর যে দু’একজন পথচারীকে প্রশ্ন করার ফুসরত হলো তারা যেন খুবই বিরক্ত। যেহেতু গুগল ম্যাপ সব-সময়ই একবারে সঠিক পথ দেখায় না তাই পথচারীদের কাছে থেকে পথের হদিস জেনে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। শেষ পর্যন্ত গুগল মামার উপর ভরসা করেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্র খাড়ি ঘেঁষে বেশ জমজমাট এলাকা, খাঁড়ির পাশ ঘেঁষে বোটের সারি, তারপাশে আবার স্ট্রিট ফুডের দোকান, যদিও তখন পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি তবে খাঁড়ি এলাকা কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করছিল। ইৎুহলঁষভ ইঁষষং ঢ়ষধংং এখানেই মূলত নোবেল পিস সেন্টারের অবস্থান অথচ আমরা বারকয়েক পুরো চত্বরটা ঘুরেও কেন যে তার হদিস পেলাম না শেষমেশ দ্রুত ধাবমান এক নরওয়েজিয়ান রমণীর পথ রোধ করতে বাধ্য হলাম। একেতে আমরা তার ব্যস্ত সময়ে ভাগ বসিয়েছি তার উপর তাকে এমন এক বিষয়ে প্রশ্ন করছি আদতে তার অবস্থান ঠিক আমাদের মুখোমুখি, অর্থাৎ আমরা তখন পিস সেন্টারের অপজিটে দাঁড়িয়ে। সে প্রচ- বিরক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো যেন আমাদের মতো গ-মূর্খ সে তার জীবনে এই প্রথম দেখলো। তবু দয়া করে যে সে আমাদের পিস সেন্টার চিনিয়ে দিল এতেই আমরা ধন্য, অবশ্য যাওয়ার আগে সে তার বিষদৃষ্টি দিয়ে আমাদের বিদ্ধ করতে ভোলেনি।

নোবেল পিস সেন্টার চোখের সামনে থাকার পরও চিনতে না পারা আর সুন্দরী তরুণীর কটাক্ষ সব কিছু মিলে আমরা ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল ছিলাম। নোবেল পিস সেন্টার নিয়ে আমাদের যে ধারণা বা প্রত্যাশা ছিল বাস্তবে আমরা আসলেই হতাশ। ভেবেছিলাম, কম করে হলেও এটি পাঁচ তারার আদলে তৈরি কোনো স্থাপনা হবে, কিন্তু এত সাদামাটা যে, নজর এড়িয়ে যাবে তা একেবারে চিন্তার অতীত ছিল। একেবারে রাস্তা ঘেঁষে সাদা রঙের একটি বিল্ডিং, ভেতরে আলো জ্বলছে তবে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত তাই ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই বাইরে থেকেই যতটুকু সম্ভব দেখে নেওয়া। এরপর আবার আমরা উদ্দেশ্যহীন। এর আগে অবশ্য আমরা পথে একটি দুর্গের দেখা পেয়েছিলাম তাই এখন উদ্দেশ্যহীন পথ চলাটাকে দুর্গের পথেই উদ্দেশ করলাম। দুর্গটির নাম আকেশুস দুর্গ, এটি মূলত নরওয়ের রাজধানী অসলোর সুরক্ষাদানকারী দুর্গ হিসেবে পরিচিত। তেরশো শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত এ দুর্গটি তৎকালীন বিভিন্ন্ যুদ্ধে সামরিক ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে এটি কারাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। আর এ সময় যখন আমরা দুর্গটিতে দাঁড়িয়ে তখন এটি নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীর অসস্থায়ী কার্যালয়।

আকেশুস দুর্গটির কিছু অংশ সংরক্ষিত আর বেশ কিছু অংশ বিশেষ করে খোলা চত্বর, দুর্গের ছাদ এগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সময় আর তখন দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তবে কেন যেন একটা হালকা আলো ছিল, যদিও তখন রীতিমতো অন্ধকার থাকার কথা, সে যাই হোক, এই স্বল্প আলোতে যতটুকু ঘুরে দেখা সম্ভব আমরা তাই করলাম, অর্থাৎ সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার আরকি। সন্ধে আর রাতের এই ক্ষণটুকু আমরা দুর্গের এক সময়ের ছাদের কার্নিশে বসে কাটিয়ে দিলাম, আসলে আমরা একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার কলিগ ফারজানার বন্ধু যে কি না অসলোর বাসিন্দা। আমাদের রাতের আবাস তার বাসা, যেহেতু বাসাটি অসলোর এক প্রান্তে এবং আমাদের এমনকি হোস্টেরও আশংকা ছিল যে, আমরা হয়তো ঠিকঠাক বাসে চড়ে তার বাসা সহজে খুঁজে নিতে পারবো না। তাই আমরাই বলেছিলাম দিনের এই সময়টুকু আমরা নিজেদের মতো করে অসলো ঘুরে বেড়াবো। এটা আমাদের একটা ব্যাক-প্যাক ট্যুর ছিল এবং প্রথম থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল, সকালের ট্রেনে গিয়ে রাতের ট্রেনে বারগেন ফিরে আসার ; অনেকটা ডে-ট্যুরের মতো। তবে, আমাদের অসলো যাওয়ার পরিকল্পনা জেনে ফারজানার বন্ধু রিংকু তাদের বাসায় যাওয়ার এবং সেখানে থাকার আমন্ত্রণ জানাতে আমরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। যেহেতু স্বল্প সময়ের ভ্রমণ তাই যতটা সম্ভব অসলো দেখে নেওয়াটাও জরুরি, তাই এমন পরিকল্পনা।

ঘড়ির কাঁটা ছ’টা আতিক্রম করতেই আমাদের হোস্ট মানে ফারজানার বন্ধু রিংকুর ফোন এলো, এরপর লোকেশন জেনে নিয়ে সে আমাদের কাছে পৌঁছে গেল। বাস ধরবো বলে আমরা অসলো সেন্ট্রাল বাসস্টপের পথে চলছিলাম, পথে একটি সুপার শপে ক্ষণিকের জন্য থামা, এরপর আবার পায়ে হেঁটে চলা। সেন্ট্রাল বাসস্টপের কাছাকাছি আসতেই রিংকু আমাদের সাবধান করলো আমাদের ব্যাগ আর মোবাইল যেন সাবধানে রাখি এখানে পকেটমার এবং ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। রিংকুর এই সাধানবাণীতে আমি যারপর নাই অবাক, নরওয়ে আসা অবদি শুনেছি এখানে কোনো কিছু হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়ার মতো কোনো ব্যাপারই নেই। কোথাও কোনো কিছু ভুলে ফেলে গেলে আবার যখন মনে পড়বে সেখানে গিয়ে খোঁজ করলে ঠিক ফেলে যাওয়া জায়গাতেই পাওয়া যাবে। এখানে যখন এমনটা শুনছি, শুধু যে শুনছি তাই নয়, অনুধাবনও করছি তখন অবাক হওয়ারই কথা। অসলোর সেন্ট্রাল বাসস্টপেজটা যেন আনেকটাই আমাদের ফার্মগেট বা গুলিস্তানের মতো। অতো নোংরা বা এলোমেলো না তবে নরওয়ের অন্যান্য জায়গার সাথে এর তফাৎ সুস্পষ্ট। বাসগুলোতেও এ সময় প্রচ- ভীড়, আসলে বারগেনে লাইট ট্রেনে ভিড় থাকলেও বাসগুলো অধিকাংশ সময়ই বেশ ফাঁকা পাওয়া যেত, তাই অসলোর এই চিত্র আমাকে বারবার ঢাকার ফার্মগেটের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তবে, সারকথা এই যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আর শহরের মধ্যে যেমন চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি একই দেশের ভিন্ন ভিন্ন শহরের মধ্যে এই ভিন্নতা বিদ্যমান।

আমরা যখন রিংকুর বাড়ি পৌঁছি তখন সময় বোধকরি রাত আটটা হবে, রিংকুর স্ত্রী তুলি আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল। আসলে প্রবাস জীবনে দেশি মানুষ খুব আপনার বলে মনে হয়। সারাদিনের এলোমেলো পথচলায় ক্লান্তি এখন টের পাচ্ছি ; ফারজানা আর আমি দু’জনেই গোসল সেরে নিলাম, এরপর কিছুটা প্রশান্তি। সকাল সকাল হোস্টেল থেকে নাশতা করে বের হওয়ার পর সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি হালকা ¯েœক্স ছাড়া তাই খাওয়াটাই এখন মুখ্য, রাতের খাওয়া শেষে চলল এক প্রস্থ আড্ডা। ভোরবেলা থেকে যাত্রার প্রস্তুতি ; তারপর আধাবেলা পায়ে হেঁটে বেড়ানো, চোখ দুটো যেন বড়োই ত্যাক্ত তাই আমরা একটু আগেভাগেই ঘুমুতে চলে গেলাম।

পরদিন মনে হলো সকাল সকালই ঘুম ভেঙে গেল, কিন্তু না ততক্ষণে রিংকু কাজে বেরিয়ে গেছে। আমি আর ফারজানা মোটামুটি সারাদিন টৈ টৈ করবো বলে সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হলাম, একসাথে নাশতা করবে বলে তুলি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। নাশতা করতে করতে আড্ডা চললো খানিকক্ষণ, তুলিকে আমাদের সাথে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারলে আমাদের ভালো লাগত। সে সন্তানসম্ভবা হওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, আমরা কোথায় কোথায় যাবো তার একটা খসড়া ছক মোটামুটি আঁটা হয়ে গেছে। এখন প্রথম গন্তব্য সেন্ট্রল বাসস্টপ, কারণ, আমাদের ২৪ ঘণ্টার জন্য নির্ধারিত ট্রান্সপোর্ট টিকেট কিনতে হবে, নতুবা সারাদিনের পথখরচ অনেক বেশি হয়ে যাবে। গতরাতে এ কাজটি করে নিতে পারলে ভালো হতো। তাহলে এখন আর উল্টোপথে ছুটতে হতো না।  [চলবে]