গানের লাইভ অনুষ্ঠান এবং উপস্থাপকের কথকতা

21 Aug 2023, 12:52 PM আকাশলীনা শেয়ার:
গানের লাইভ অনুষ্ঠান এবং উপস্থাপকের কথকতা

বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ঝুঁকছেন টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়। অনেকেই উপস্থাপনায় ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছেন। প্রতিদিন রেকর্ডেট অনুষ্ঠানের পাশাপাশি টেলিভিশনগুলো লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এর মধ্যে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মিউজিক্যাল অনুষ্ঠান। উপস্থাপক শাকিলা মতিন মৃদুলা এবং নাহিদা আফরোজ সুমির উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শসহ উপস্থাপনার জন্য কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়েজোন এই প্রতিবেদন বিস্তারিত জানিয়েছেন শেখ সেলিম...

উপস্থাপনার জন্য যে বিষয়গুলো সবার আগে চলে আসে, সেই বিষয়গুলো হচ্ছে শুদ্ধ উচ্চারণ, সাবলীল বাচনভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস প্রভৃতি। উপস্থাপক বোদ্ধাদের মতে, একজন উপস্থাপকের কাজ হলো টুু ইনফর্ম, টু এডুকেট, টু এন্টারটেইন। উপস্থাপনায় কয়েকজন প্রশিক্ষকের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার আলোকে ভালো উপস্থাপনায় করণীয় কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।

শুদ্ধ উচ্চারণ : একজন উপস্থাপকের শুদ্ধভাবে একেকটি শব্দ উচ্চারণ করা বাঞ্ছনীয়।

সাবলীল বাচনভঙ্গি : যে কথাই বলি, সেটা যেন সাবলীল হয়। কথায় যেন কোনো জড়তা না থাকে।

আত্মবিশ্বাস : আত্মবিশ্বাস খুবই জরুরি। যা-ই বলি না কেন, সেটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে হবে। তাহলে উপস্থাপনা প্রাণবন্ত হবে।

সাম্প্রতিক জ্ঞান : একজন উপস্থাপকের সাম্প্রতিক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক জ্ঞান থাকা জরুরি। না হলে উপস্থাপনা মানসম্পন্ন হবে না।

উপস্থিত বুদ্ধি : অবশ্যই একজন ভালো উপস্থাপক হতে হলে তার উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো বিষয়ে কথা বলার ক্ষমতা থাকতে হবে।

উপস্থাপনা প্রসঙ্গে উপস্থাপক আনজাম মাসুদ বলেন, সবার আগে জানতে হবে অনুষ্ঠানের সময় কতটুকু ? এর মধ্যে কী কী বলা যেতে পারে, কতটা সময় সেক্ষেত্রে ব্যয় হবে, অতিথিকে কতটা সময় দেব, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানো উচিত। তাতে পরিবেশ ও অতিথি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। অতিরিক্ত প্রশংসা না করাই ভালো। সামগ্রিক বিষয়ে একটা পরিমিতিবোধ থাকতে হবে। একজন উপস্থাপকের ‘সেন্স অব হিউমার’ বা হাস্যকৌতুকবোধ থাকা জরুরি। ব্যক্তিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমি যে অনুষ্ঠানটিই উপস্থাপনা করছি, সেটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্ব সাদৃশ্যপূর্ণ কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। অল্প শব্দে বেশি কথা বলতে হবে। অর্থাৎ বক্তব্য যেন অর্থবহ হয়।

বর্তমান সময়ে উপস্থাপক হিসেবে আলোচনায় আছেন শাহরিয়ার নাজিম জয়। একজন উপস্থাপক হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে জয় বলেন, নিজে নিজে চোখ বন্ধ করে পুরো অনুষ্ঠানটি কল্পনা করতে হবে। কী হতে পারে, নতুন কী করা যেতে পারেÑ সব ঠিক করতে হবে। চোখের ব্যায়াম করতে হবে। চোখ যেন বেশি পিটপিট না করে। ‘চোখ যে মনের কথা বলে।’ চোখের কাজ খুব জরুরি। যিনি আপনার অতিথি কিংবা ক্যামেরায় দর্শকের উদ্দেশে কিছু বলছেন। তখন যেন আই কন্টাক্ট ঠিক থাকে, সেটি মাথায় রাখতে হবে। অযথা হাত নাড়া, জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজানোÑ এগুলো করা যাবে না। একটি বাক্য বলার সময় কোন শব্দের পরে একটু থামলে ভালো শোনাবে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে উপস্থাপনা করে সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক সাকিলা মতিন মৃদুলা ও কণ্ঠশিল্পী ও উপস্থাপক নাহিদা আফরোজ সুমি। তাদের উপস্থাপনায় আসা, সাফল্যের গল্প ও অন্যন্য বিষয় জেনে নেওয়া যাক...

সাকিলা মতিন মৃদুলা

উপস্থাপক

সাকিলা মতিন মৃদুলা মূলত একজন আবৃত্তিশিল্পী। আবৃত্তি করতে করতে উপস্থাপনায় আসা। উপস্থাপনার জন্যে যে বিষয়গুলো জরুরি সবই রয়েছে তার মধ্যে। বিটিভিসহ বেসরকারি বেশকিছু টিভি চ্যানেলে উপস্থাপনা করে বেশ প্রশংসা প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। নিয়মিত উপস্থাপনা করছেন বিটিভিতে প্রচারিত ছুটির দিন সকালের মিউজিক্যাল লাইভ অনুষ্ঠান ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’।

আবৃত্তিশিল্পী হয়ে উপস্থাপনা করতে কেমন লাগে জানতে চাইলে মৃদুলা বলেন, যেকোনো কাজই ভালো লাগা থেকে করা, ভালো না লাগলে কোনো কাজই করা হয় না। উপস্থাপনা ভালো লাগে বলেই এই মাধ্যমটিতে কাজ করছি। তবে বেশি ভালো লাগে আবৃত্তি করতে। একজন উপস্থাপক কখনো রেকর্ডিং আবার কখনো লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেন, দু’টির মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করা। এই প্রসঙ্গে মৃদুলা বলেন, যেকোনো কাজেই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, কমিটমেন্ট থাকতে হবে, তাহলেই কাজটি সহজ হয়ে যাবে। রেকর্ডেট অনুষ্ঠানগুলোতে ভুল করলে, আবার ট্যাক নিয়ে সংশোধন করা যায়। কিন্তু লাইভ অনুষ্ঠানে এই সুযোগ থাকে না। ভুল বললে, ভুলটাই প্রচার হবে। লাইভ অনুষ্ঠানে চ্যালেঞ্জ থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে নানা মন-মানসিকতার মানুষ ফোন কল করে থাকেন। অনেক সময় বিব্রত হতে হয়, যদিও আমি এসবের মধ্যে এখনো পড়িনি। এককথায় যে-পরিস্থিতি হোক, সেটি উতরে যাওয়াই হচ্ছে একজন উপস্থাপকের প্রধান যোগ্যতা। এই জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। একজন দর্শক যখন ফোন কল করেন, তার অভিব্যক্তি প্রথমে বুঝতে হবে, সেইভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে ; শুধু তাই নয়, একজন উপস্থাপককে অনেক বিষয়ে জানতে হয় আবার একজন উপস্থাপকের সব অনুষ্ঠান করাও ঠিক নয়। ধরুন, আমাকে হঠাৎ করে একটি ক্রীড়া অনুষ্ঠানে উপস্থানার জন্য ডাকা হলো, অথচ আমি তেমন একটা ক্রীড়া বিষয়ে জানি না, তাহলে সেখানে আমি কীভাবে উপস্থাপনা করব। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। যে বিষয়ে যিনি দক্ষ সেই বিষয়ে তিনি উপস্থাপনা করলে ভালো করবেন।

নতুনদের উদ্দেশ্যে মৃদুলা বলেন, এটা একটা শিল্প, নতুনদের প্রথমেই এটা স্মরণ রেখে এই মাধ্যমে আসা উচিত। উপস্থাপনাকে ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই, উপস্থাপনা সম্মানের এই মনোভাব থাকতে হবে। সুন্দর চেহারা, সুন্দরভাবে কথা বলতে পারলেই উপস্থাপনা করা যায় না। উপস্থাপনার জন্য অনেক জানতে হবে। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হতে হবে। পোশাকের ব্যাপারেও খুব সতর্ক থাকতে হবে। টিকে থাকার জন্য যা ইচ্ছে তা পোশাক পরলে হবে না। পোশাক যেন অনুষ্ঠানের সঙ্গে মানানসই হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমি সবসময় শাড়ি পরি। শাড়িতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।


নাহিদা আফরোজ সুমি

উপস্থাপক নাহিদা আফরোজ সুমির গানের সঙ্গে বসবাস সেই শৈশব থেকে। পুরো পরিবারই সংস্কৃতিমনা। তাই পড়াশোনাও করেছেন গান বিষয়ে। গান নিয়ে এমফিল করেছেন। স্বপ্ন ছিল গানের ভুবনে কোনো একদিন রাজত্ব করার। কিন্তু ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে অনার্স পড়াকালীন সুমির বাবা আলাউদ্দিন আহমেদ মারা যান। বাবাকে হারিয়ে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েন সুমি। সেই সময় সুমি জয়ধ্বনি সাংস্কৃতিক সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়ে সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করেন। একসময় ঢাকা এফএম-এ উপস্থাপনা করার সুযোগ পান। উপস্থাপনায় বেশ প্রশংসা কুড়ান সুমি। এরপর কাজ শুরু করেন কালারস রেডিওতে। উপস্থাপনায় নিজেকে সুমি এমনভাবে জড়ালেন, উপস্থাপনায়ই হয়ে উঠল তার ধ্যান, জ্ঞান। উপস্থাপনা পেশা হিসেবে নেওয়ায় গান থেকে দূরে সরে গেলেন, তবে এখনো গানের চর্চা করেন, গান করেন নিজের পরিবার ও নিজের জন্য। বেতারের পর প্রথম টেলিভিশনে উপস্থাপনা করেন মাছরাঙা টেলিভিশন আয়োজিত রিয়েলিটি শো ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানায়’।

রেকর্ডিং ও লাইভ মিলিয়ে একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করছেন সুমি। এরমধ্যে এনটিভিতে মিউজিক্যাল অনুষ্ঠান ‘এ লগন গান শোনাবার’, নাগরিক টিভির ‘বাংলা বাউল’, ‘ছুটির দিনে গান’, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, একুশে টেলিভিশনে ‘ফনো লাইভ স্টুডিও কনসার্ট’ প্রভৃতি।

উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সুমি বলেন, দুই ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকি, একটি লাইভ অন্যটি রেকর্ডেট অনুষ্ঠান। রেকর্ডেট অনুষ্ঠান হলেও আমি চেষ্টা করি এক ট্যাকে শেষ করতে। যেহেতু লাইভে ভুল করলে সংশোধন করার কোনো সুযোগ থাকে না, তাই সবসময় চেষ্টা করি এবং মনে রাখি লাইভ অনুষ্ঠানেই উপস্থাপনা করছি, তাই রেকর্ডেট অনুষ্ঠানেও ভুল কম হয়। তবে লাইভে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়। অনুষ্ঠানে অনেক অতিথি থাকেন, সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, সবাই কিন্তু একরকম নন, কেউ একটু ভালো কথা বলতে পারেন আবার কেউ একটুু কম, সবদিক মাথায় রেখে অনুষ্ঠানটি আমাকে শেষ করতে হয়। তাছাড়া দর্শকের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হয়, দর্শক একটি অনুষ্ঠানের প্রাণ। মাঝে মাঝে লাইভে এমন কিছু কল আসে, সেগুলোও উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে ম্যানেজ করে নিতে হয়। সুমির কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনার বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই দেখা যায়, অতিথিদের কাছ থেকে এমন কিছু তথ্য বের করে আনেন, যেটা অনেকেই জানে না, যেমন সম্প্রতি এনটিভিতে প্রচারিত ‘এ লগন গান শোনাবার’ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন শিল্পী শাহনাজ বেলি, সেই অনুষ্ঠানে শিল্পী আপনার প্রশ্নগুলো পেয়ে খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘এই তথ্য কেউ জানে না, আপনি কৌশল করে কথাগুলো বের করে নিলেন।’ এই প্রসঙ্গে সুমি বলেন, ‘এটা আসলে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, আমি যখন কারো সঙ্গে কথা বলি, তখন একটি কথার পিঠে আরেকটি কারণ খুঁজি, সেখান থেকেই হয়ত তার না বলা কথাগুলো বের হয়ে আসে।

উপস্থাপনা প্রসঙ্গে সুমি আরো বলেন, অনেকে মনে করেন একটা বয়েসর পর আর উপস্থাপনা করা যায় না। আমি বলতে চাই, যেকোনো কাজেই বয়েস ব্যাপার নয়। আপনি যদি সুন্দরভাবে সেই কাজটি করতে পারেন, তাহলে এখানে বয়েসের বিষয়টা আসবে না। আমি এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছি। পাশাপাশি দুইবন্ধু মিলে একটি অনলাইন ব্যবসা করছি। বেশ ভালো আছি। উপস্থাপনা বিষয়ে সুমি আরো বলেন, যারা উপস্থাপক নির্বাচন করে থাকেন তাদের অনুরোধ করব, যার যেখানে দরকার তাকে সেখানে রাখুন।

একজন উপস্থাপকের কোন বিষয়গুলো জরুরি, সুমি বলেন, উপস্থাপনায় আসার আগে তাকে তৈরি হয়ে আসতে হবে, প্রচুর সাহস রাখতে হবে, জড়তা থাকা যাবে না, পেশার প্রতি সম্মান থাকতে হবে। ভাষার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হবে, প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, শ্রদ্ধা সহকারে কথা বলতে হবে, সর্বোপরি কাজটাকে ভালোবাসতে হবে।