সব বাধা পেরিয়ে

01 Jan 2021, 01:05 PM আকাশলীনা শেয়ার:
সব বাধা পেরিয়ে

পুরো নাম মুশফিক আর ফারহান। আরজে হিসেবে মিডিয়ায় যাত্রা শুরু। আকর্ষণীয় কণ্ঠ আর চমৎকার উপস্থাপনার শৈলীতে রেডিও জকি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। পরবর্তীসময়ে তিনি অভিনয়েই বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। টিভি নাটকে কাজ করতে করতে হয়ে উঠেছেন ছোটোপর্দার জনপ্রিয় মুখ। তবে করোনার সময়টাতে এখনও শুটিংয়ের কাজ বন্ধ রেখ বাসাতেই সময় কাটাচ্ছেন ফারহান। এই তরুণ অভিনেতার বিস্তারিত জানাচ্ছেন নিথর মাহবুব...


রেডিও জকি হিসেবে মিডিয়ার পথচলা শুরু করেন মুশফিক আর ফারহান। সেই গল্পটা দিয়েই আলাপ শুরু হলো। ফারহান বলেন, ‘গ্রামীণফোনের কলসেন্টারে কাজ করতাম। ‘রেডিও নেক্সট’-এর জন্য আরজে নিয়োগ হচ্ছিল। অডিশন হচ্ছিল আমার অফিসের বিল্ডিংয়েই। আমার এক বন্ধু আবেদন করবে। আমাকেও আবেদন করতে বলল। আমি ভরসা পাচ্ছিলাম না। মজার ছলে সেই বন্ধু তার সিভির সঙ্গে আমার একটা সিভিও জমা দেয়। বন্ধুর চাকরিটা না হলেও আমার চাকরিটা হয়ে যায় সেই এফএম রেডিওতে।’

রেডিওতে কাজ করার সুবাদেই ফারহানের পরিচয় হয় পরিচালক মাবরুর রশীদ বান্নাহর সঙ্গে। বান্নাহ একদিন বললেন- তুমি তো অভিনয় করতে পারো। কিন্তু অভিনয়টা কঠিন ভেবে আগ্রহ পাচ্ছিলেন না ফারহান। তবে অফিসের সহকর্মীরা সাহস যোগাতে থাকলেন। বান্নাহ শুটিংয়ে ডাকলেন ফারহানকে। তার পরিচালনায় ‘একটি তিন মাসের গল্প’ নাটকে অভিনয় করলেন। শুরু হয় ফারহানের অভিনয়ের ক্যারিয়ার।

ক্যারিয়ারের টানিং পয়েন্টটা নিয়ে এই অভিনেতা বলেন, “আমার টার্নিংটা আসে ‘দেয়ালের ওপারে তুমি’ নাটক দিয়ে। নাটকটির পরিচালক তৌহিদ আশরাফ। আর অভিনয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাই বান্নাহ ভাইয়ের পরিচালনায় ‘বাদলা’ নাটকের মাধ্যমে। এছাড়াও ভালো কিছু কাজ আছে। করোনায় শুটিং বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত অনেক কজ করেছি। এগুলোই এখন প্রচারে আসছে। তবে গত ঈদ থেকে টুকটাক কাজ শুরু করেছি।”

ফারহান অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে আছে, মেহেদি হাসান হৃদয়ের পরিচালনায় ‘ক্রাশ’, শাহ মোহাম্মদ রাকিবের পরিচালনায় ‘জল্লাদ’ ‘চরিত্র’ ও ‘প্যারা আন লিমিটেড’, এসএম রুবেল রানার পরিচালনায় ‘চল পালাই’, হাসিব হোসেন রাখির ‘পেইন-ড্রাইভ’, পনির খানের ‘মিস্টার ট্যাম্পার’ ও ওইস লিস্ট, হাবিবুর রহমানের ‘প্রেমের অভিনয়’ ও ‘লজ্জা’, রাইসুল ইসলাম অনিকের ‘লিমিটলেস’, রিফাত আদনান পাপনের ‘ভালবাসা তারপর’, শাহি দুন নবির ‘কুফা’, মাহমুদ মাহিনের ‘ডিয়ার এক্স’, নাজমুল হাসানের পরিচালনায় ‘কিং অব সূত্রাপুর’ ইত্যাদি।

নিজের অবস্থান এখন যেখানে আছে তা নিয়ে যথেষ্ট খুশি এই স্বপ্নবাজ তরুণ। তবে যেতে চান আরো অনেক দূর। আজকের অবস্থানে আসতে এই অভিনেতাকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক কঠিন পথ। সব বাধা পেরিয়ে হয়েছেন আজকের ফারহান। পেছনের দিনগুলো মনে করে ফারহান বলেন, ‘২৮আগস্ট বরিশালে গ্রামের বাড়িতে আমার জন্ম। খুব ছোটোবেলা কেটেছে গ্রামেই। বাবা আর্মি ছিলেন। বাবার বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং হতো। বাবা যেখানেই যেতেন আমাদের পরিবার সেখানেই থাকত। বাবা রিটায়র্ড করলে আমাদের পরিবার গ্রামে চলে আসে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবা মারা গেলেন। তারপর একটা কঠিন অবস্থায় পড়ে আমাদের পরিবার। একটা পরিবার যখন সংকটে পড়ে তখন আসলে আত্মীয় স্বজন কাছের মানুষগুলোর সহযোগিতা খুব বেশি দরকার। কিন্তু ওই সময়টাতে আমার বাবার বাড়ির দিক থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা তো দূরের কথা নিজেদের অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। ঠিকমতো আমাদের সঙ্গে অনেকে কথাও বলত না। তবে এখন তারা আমার বসায় আসে। খোঁজখবর নেয়। অন্যদের কাছে বলে এটা আমার ভাইয়ের ছেলে, এটা আমার চাচাত ভাই। কিন্তু কষ্টের দিনগুলোতে তাদের সহযোগিতা আমরা পাইনি।

না পাওয়ার সেই দিনগুলো এখনো ভাবিয়ে তোলে ফারহানকে। তাইত সাফল্যের এই সময়ে এসে তার ভাবনা জুড়ে থাকে বাবা-মা হারা এতিমদের কথা। ফারহান বলেন, ‘আমার সাধ্যের ভেতরে যতটুকু সম্ভব সেই অনুসারে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আমার অবস্থার উন্নতি হলে আরো করব, আমার আত্মীয় স্বজনদের জন্যও করব। বর্তমানে মিরপুরে একটি এতিম খানার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছি। সেখানে আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করছি। আমি এখনো অনেক বড়ো কিছু হতে পারিনি। তবে বাবা বেঁচে থাকলে এইটুকু দেখলেই অবাক হতেন। কারণ আমি ছোটোবেলায় তোতলা ছিলাম। স্কুলে টিচাররা কিছু বলতে বললে সবাই আমার কথা শুনে হাসত। ছোটোবেলায় আমি লম্বাও হচ্ছিলাম না। একমাত্র ছেলে খাটো এবং তোতলা বলে বাবা অনেক আফসোস করতেন। কিন্তু বাবা দেখে যেতে পারলেন না তার খাটো ছেলেটা এখন যথেষ্ট লম্বা হয়েছে, নাটকে নায়কের অভিনয় করছে, শুধু তাই নয়; তার সেই তোতলা ছেলেটা ভয়েজের মাধ্যমেই জয় করে নিয়েছে এই দেশের হাজার হাজার তরুণ- তরুণীর হৃদয়। আজকে বেঁচে থাকলে এসব দেখে অনেক খুশি হতেন আমার বাবা।”

বাবার স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে তার ছেলে ফারহান নটরডেম কলেজে পড়বে। তাই গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর ফারহান সিদ্ধান্ত নিলেন বাবার স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। কিন্তু পিতৃহীন একমাত্র ছেলেকে ঢাকায় রাখতে মায়ের মন শায় দিচ্ছিল না। তাই মায়ের সঙ্গে রাগ করে মাকে না জানিয়ে ঢাকায় বড়ো খালার বাসায় চলে আসে ফারহান। শুরু হয় ঢাকায় নতুন করে পথচলা। ফারহানের কথায়- ‘নটরডেম কলেজে ইন্টারভিউ দিলাম। ইন্টারভিউতে পাশ করলাম। মা তখন বললেনÑ ঠিক আছে তুমি যখন টিকে গেছ তাহলে খালার বাসায় থেকেই পড়াশোনাটা করো। আর অভিনয়ের শখটা আসলে ছোটোবেলা থেকে না থাকলেও ছোটবেলায় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ফানি ক্যারেক্টারগুলোকে অনুকরণ করতাম। যেমন, পরিবারে সবাই যখন একত্র হতো তখন আমার মামা কীভাবে খেত তা দেখাতাম, আমার খুব রাগী চাচা কীভাবে ঝাড়ি দিতেন সেটা দেখাতাম। গ্রামীণফোন কলসেন্টারে যখন কাজ শুরু করলাম আমার কলিগরা সবসময় বলত তোমার ভয়েজটা ভালো আরজের জন্য ট্রাই কর। ট্রাই করলাম। আমার জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে দিল আরজে।’


আরজে হতে কী কী গুণ থাকা দরকার

নিজের সিমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে জীবনে সাফল্য বয়ে আনা এই তরুণ এমন প্রশ্নের জবাবে এবার বলেন, ‘আমাদের সবার মাঝেই একটা ধারণা আছে, যে সুন্দর ভয়েজ থাকলেই আরজে হওয়া যায়। এটা ভুল। সুন্দর ভয়েজ হয়তো একটা গ্রেড বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সুন্দর ভয়েজ থাকলেই সে আরজে হতে পারবে না। আরজে হতে হলে তাকে স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে হবে। সাবলীল ভাষায় কথা বলতে হবে। নিয়মিত হতে হবে। মানুষকে আনন্দ দিতে হবে। একজন সাধারণ মানুষ সব কথা বলবে, কিন্তু একজন আরজে সব কথা বলবে না। সে ‘ফিল্টার’ করে কথা বলবে। তো ওই ‘ফিল্টার’ করে কথা বলাটা তাকে জানতে হবে। তারপর হচ্ছে মানুষকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। একজন আরজের ক্যারিয়ারটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জের। তিনি একটি কক্ষে বসে মাইক্রফোনে কথা বলছেন, লাখ লাখ মানুষ তাকে শুনছে। ওই কথাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেমন শুনছে, তেমনি একজন পোশাককর্মীও শুনছেন। তাই তাকে বুঝেশুনে কথা বলতে হবে। তাকে এমনভাবে কথা বলতে হবে যেন সেটা সবার কাছে গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। সাধারণ জ্ঞান থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এবং উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। তবেই আসবে আরজের সাফল্য। আসলে যেকোনো ক্ষেত্রেই সাফল্যের জন্য নিজের ইচ্ছা থাকতে হয় পরিশ্রম করতে হয়। আমার মনে হয় নিজের মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে হতাশ হয়ে যেতে নেই, হাল ছাড়তে নেই, এমনো হতে পারে ওখানেই রয়েছে জীবনের বড়ো সাফল্য। প্রত্যেকটা মানুষের নিজেকে প্রæভ করার একটা সময় থাকে, ওই সময়টা পার হয়ে গেলে তারপর হাজারো চেষ্টা করলেও আর কিছু করার থাকে না। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের তরুণেরা বেশি সময় নষ্ট করছে। তাই আমি বলব ফেসবুক, টুইটার সবকিছুই একটা রুটিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।’

ফারহানের মনোযোগটা এখন শুধু অভিনয়কে ঘিরে। রেডিও নেক্সট বন্ধ হওয়ার পর আরজে পেশায় আর নিজেকে যুক্ত করেননি। অভিনয়ই এখন তার নেশা এবং পেশা। এই গুণী তরুণ অভিনেতা বলেন, ‘আমি বড়ো অভিনেতা হতে চাই। তবে এখানো আমি শিখছি। আশা করছি সামনে ভালো কিছু হবে। অভিনয় শিখতে মুম্বাইয়ের অ্যাক্টিং স্কুলে এক বছর ছিলাম। সবধরনের চরিত্রেই অভিনয় করতে আগ্রহী আমি। চলচ্চিত্রে অভিনয় করার স্বপ্নও দেখি, তবে আরো শিখে তারপরেই চলচ্চিত্রে যেতে চাই। সবার ইচ্ছে থাকে নায়ক হওয়ার। কিন্তু আমি একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা হতে চাই। একজন পাকা অভিনেতা হয়ে অভিনয় দিয়ে সব মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকতে চাই।’