নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে
ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। যদিও খরায় পুড়ছে পুরোদেশ। বৃষ্টিবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এখনও প্রবেশ করেনি। তাই বর্ষার মুসলধারার বর্ষণ এখনও শুরু হয়নি।
তৃষাকাতর বিশ্বজগৎ বর্ষার বারিধারায় সিক্ত হয়ে ফিরে পায় প্রাণের স্পন্দন। গ্রীষ্মের রুক্ষ খরতাপে ওষ্ঠাগত প্রাণ-মন সিক্ত করতে আগমন ঘটে বর্ষার। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড খরতাপে রুক্ষ প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে বর্ষার ভালোবাসার ছোঁয়ায় ; পুরো প্রকৃতি তার রূপ ও রং বদলে ফেলে।
কদমফুল বর্ষার অঙ্গশোভা। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে গাছে গাছে কদমের সজ্জা জানান দেয় প্রকৃতির দুয়ারে আষাঢ় এসেছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় স্নাত কদমফুলের শোভা চোখের তৃষ্ণা মেটায়। বর্ষায় প্রিয় মিলনের জন্য আকুল হয়ে ওঠে নারীমন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে বর্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পরম যত্নে ও ভালোবাসায়। বর্ষার অন্তরের যে রূপ, যে আকৃতি, যে বৈচিত্র্য, যে ছন্দ, যে লয় সবই রবীন্দ্রনাথ অবলোকন করেছেন পরম মমতায় এবং তাঁর সাহিত্যে নানা ভঙ্গিতে বর্ষার রূপ ও অনিবার্যতা তুলে ধরেছেন।
বর্ষা ঋতু ফসল ফলানোর ঋতু। জ্যৈষ্ঠের নিষ্ঠুর তাপদাহের পর বর্ষার বারিধারা কৃষিভূমিকে শিতল ও কোমল করে। সেই কোমল মাটিতে লাঙল দিয়ে কৃষক তাতে বীজ বোনে। চার থেকে পাঁচ মাস পর কার্তিক, অগ্রাহায়ণে সেই ফসল ঘরে তোলে।
বাঙালির কাছে বর্ষার আরেকটি অন্যতম আগ্রহের ফসল হলো জলের রুপালি শস্য- ইলিশ মাছ। বর্ষার মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের নদ-নদী ও সাগরের উপকূলে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। বাঙালি হেঁসেল থেকে এ সময়ে ইলিশ ভাজার সুঘ্রাণ পুরো পাড়াকে আমোদিত করে রাখে। তাই বুঝি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘ইলিশ’ শীর্ষক কবিতায় বলেছেন :
আকাশে আষাঢ় এল, বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল : পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
...
রত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলতাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এল বর্ষা, ইলিশ উৎসব।