লিপিটিপি -ঈমাম হোসাইন

12 Apr 2023, 02:58 PM গল্প শেয়ার:
লিপিটিপি -ঈমাম হোসাইন


দুপুরের লাঞ্চ বলতে আমরা সাধারণ ছাত্ররা তখন ডিম খিচুড়ি বুঝি। তার ওপর যাওয়ার সামর্থ্য অনেকের থাকে না। আমি নিজেও ক্ষধার্ত। তার ওপর, সকাল দশটা থেকে একটানা তিনটি ক্লাস করেছি। আমার সহপাঠী টিপু সুলতান ফতো নবাব না হলেও বোলচালে কিছুটা সুলতানের মতো। সকাল বেলা লাঞ্চের দাওয়াতখানা এমন ভঙ্গিতে দিলো যেন লঙ্গরখানায় হাজারখানেক মানুষের জেয়াফতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দূর ছাই! ডিম খিচুড়িও জুটছে না।

হাকিম চত্বরের খোলা মাঠে উল্টো পীঠ করে এক জোড়া কপোত-কপোতী গাছের গুঁড়িতে বসে কিছু খাচ্ছে। 

আহা! এ কী কাণ্ড! আমার আন্দাজ তো সঠিক। টিপুসাহেব যথারীতি সহপাঠিনীকে নিয়ে গোগ্রাসে গিলছেন। মনে হলো নিজেই মুফতো জেয়াফত খাচ্ছেন।

কিরে তুই না আমাকে দুপুরে খাওয়ানোর কথা ?

কাল তোর বাবা তিন হাজার টাকার মনি অর্ডার পাঠিয়েছে।

পকেট গরম তো। তাই এত রসিক ভোজন চালাচ্ছ।

আর বলিস না, দোস্ত, আমার পাশের এ পেতনীর যন্ত্রণায় নিজ বাবাকে যে কত কষ্ট দিচ্ছি! প্রতিমাসে বইকেনা, ফরম ফিলআপ, পিকনিক, ভর্তি, ডাইনিং বিল কত কিছু দিয়ে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে টাকা আদায় করতে হয় ! আল্লাহ মাফ করুন।

আরে আমি ফেতনি ! তোমাকে মিথ্যা কথা বলতে বলি ? ঠিক আছে- এ নাও তোমার খাওয়ার। আমি চললাম।

আরে লিপি, সুলতানা লিপি। একটু থামো। খাওয়াটা অন্তত শেষ করো।

ইংরেজি বিভাগের পুরো পাঁচ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা মিলে দুজনের নাম দিয়েছে লিপি-টিপি। এ লিপি-টিপি গত চার বছরে এমন কোনো পার্ক বাদ নেই যেখানে তারা ডেট করেনি। মাঝে মাঝে হাকিম চত্বর, আম তলা, টিএসসির বারান্দা, মল চত্বর, ফুলার রোড, কার্জন হল এমন সব জায়গায় তাদের দেখা মিলত। দূর থেকে অনেকে মন্তব্য ছুড়তো- ঐ দেখ লিপি-টিপি।

কিছুক্ষণ পর (চাঁদ) সুলতানা লিপি বলল, ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিতে বাড়িতে যাব। ততদিন এ পাগলকে সামলে রাখিস।

তা রাখবো। তবে তুমি বাড়িতে সপ্তাহখানেক থাকতে পার কি না দেখ ? এত গাল মেরো না।

২০১০ কক্ষে চতুর্থ বর্ষের ভাইভা চলছে। লিপি-টিপিসহ সবাই দাঁড়িয়ে আছে ডাকের অপেক্ষায়। কাল সকালে বাবা মুরাদপুর থেকে হলে আসবে। আমি বাবার সাথে বাড়ি যাব। দুই সপ্তাহ পর হলে ফিরব। লিপি বলল।

ঐদিকে টিপু সুলতান মুখখানা কালো বর্ণ করে বলল, তার বাবার শরীর ভালো নেই। তাকেও কাল বাড়ি যেতে হবে। সম্ভবত ঢাকায় এনে বাবাকে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হবে।

আমি টিউশনি আর বাংলাবাজারে গাইড লেখার খণ্ডকালীন চাকরি করি। তাই ঈদ ছাড়া বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

যাও. তোমরা বাড়ি যাও। তবে বিয়ের কথা পাকা হলে দাওয়াত দিতে ভুলিস না।

দুজনে মুচকি হাসলেন।

নারে, বাবার কথা শুনে মন খারাপ।

চিন্তা করিস না। কাল চাচাকে ঢাকায় নিয়ে আয়। আমরা তো আছি।

সবার ভাইভা শেষ হলো। যে যার হলে চলে গেলাম।

সপ্তাহ তিনেক পর টিপুর সাথে পাবলিক লাইব্রেরির সামনের রাস্তায় দেখা। তার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ওপারেশন, রেডিও ও কেমো থেরাপি দেওয়া লাগবে। প্রায় আট লাখের মতো খরচ হবে।

এত টাকা কোথায় পাই, বল ?

দোস্ত, এত চিন্তা করিস না। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কাজ কর।

আর লিপির কি অবস্থা ? ও ঢাকায় ফিরেছে ?

না, তার কোনো খবর নেই। তার হ্যান্ডফোনও বন্ধ। মনে হয়, গ্রামের বাড়িতে নেটওয়ার্ক নেই।

গত ছয়মাস ধরে চাচার চিকিৎসা চলছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে শেষ কয়টি কেমো দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, চাচার বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। টিপুকে মনোবল শক্ত রাখার পরামর্শ দিয়ে হলের দিকে রওয়ানা হলাম।

সম্মান শ্রেণির ফলাফল প্রকাশিত হলো। এম এ শ্রিণিতে ভর্তি হলাম। ক্লাস শুরুর নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো হলো।

এমএ ক্লাসের প্রথম পাঠ। এসএমআই স্যার ক্লাশ নিবেন। বিষয় : পোস্ট মর্ডানিজম।

সহপাঠী সাবিহা ইসলাম পাখির সাথে বারান্দায় দেখা।

মতিন, শুনেছ ? লিপির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। আগামী মাসে চলে যাবে বরের সাথে।

আমিতো স্তম্ভিত। কী বলো তুমি ? ইয়ার্কি মার নাকি ?

ওকে। মোবাইলে পাঠানো ছবিগুলো দেখ।

সত্যিই তো। বিশ্বাস করতেই হলো।

ওইদিন বিকেলে পিজি হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে গেলাম। নার্স পথরোধ করে জানালেন, গত রাতে ওই লোক মারা গেছেন। তার পরিবার লাশ নিয়ে গেছে। আমি হলে ফিরলাম। বন্ধুসহপাঠীদের সাথে খবরটি শেয়ার করলাম।

এমএ ক্লাসে এক বছর পার করলাম। পরীক্ষায় পর্বও শেষ হলো। এবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি টানার পালা। কিন্তু টিপু সুলতানের সাথে আর দেখা হলো না কোনো খবরও পেলাম না।

২০২১ সাল। পেশাগত কারণে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারি গিয়েছিলাম। সঙ্গতকারণে মীর সুলতান বাড়িতে ঢুঁ মারলাম বন্ধু টিপুর খোঁজে।

তার তো মাথায় গোলমাল দেখা দিছে। কোথায় কোথায় থাকে, জানি না। তার এক বোন আছে। স্বামীর বাড়ি থাকে। ঘর সংসার করে। বয়স্কা মহিলার এমন কথা শুনে জীর্ণ ঘরের মাটির বারান্দায় বসে পড়লাম। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ