একটি লাল গোলাপ -বুদ্ধদেব বসু

12 Apr 2023, 02:52 PM গল্প শেয়ার:
একটি লাল গোলাপ -বুদ্ধদেব বসু


পুনশ্চ

[বাংলা সাহিত্য জগতে এক বিস্ময়ের নাম বুদ্ধদেব বসু। কী কবিতা কী গদ্য রচনা সব ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যসাধারণ। ‘পুনশ্চ’ বিভাগে বুদ্ধদেব বসুর গল্প ‘একটি লাল গোলাপ’ আধুনিককালের পাঠককে গল্প পাঠের ভিন্ন এক স্বাদ ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করবে। -সম্পাদক]


প্রথমে কোট খুলল, তারপর নেকটাই শার্ট, তারপর মোজা, পাৎলুন। আয়নার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ধুতিটা পরে নিলো তাড়াতাড়ি- তাড়া থাকলেই দেরি হয় তার, একবার কোঁচা ছোটো, একবার কাছা আঁটো, পাঁচ-সাত মিনিট লেগে যায় এক-এক সময়, ঘেমে যায়, কান্না পায়- কিন্তু মনে-মনে যদিও তা-ই ভয় করেছিল, কী আশ্চর্য যে সে-রকম কিছুই হলো না, একটুও কষ্ট দিলো না ধুতিটা, একবারও অবাধ্যতা করল না, ঠিকঠাক পরা হয়ে গেল একবারেই। সুলক্ষণ ! প্রতাপ খুশি হয়ে বেসিনের ধারে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলো, চুলে জলের ছিটে ; রুমালে হাত মুছে তুলে নিলো অ্যাটাশে-কেস থেকে সিল্কের পাঞ্জাবিটা, মাথা গলিয়ে দিয়ে পরিত্যক্ত কোটের পকেট থেকে চিরুনি বের করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। ঠিক যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল তা নয় ; হাঁটু দুটো ‘দ’-এর মতো বেঁকিয়ে দিয়ে, বাচ্চাদের ছবির বইয়ে ব্যাং যে-রকম আঁকা হয়, সেইরকম ভঙ্গি ধরে তবে সে নিজের মুখ দেখতে পেলো, কেননা, ঘোষ-সাহেব বেঁটে মানুষ, আর তাঁর বাথরুমে আয়না তাঁরই মাপমতো বসানো। ও-রকম অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না, তবু শরীরের কষ্ট একটু সহ্য করেও বাজে আয়নায় মিনমিনে আলোয় নিজের মুখখানা যেন মন দিয়েই দেখল সে, আর হাজার বারের বার, লক্ষ বারের বার মনে-মনে বলতে চেষ্টা করল, ‘দেখতে আমি এমন মন্দ কী। কিন্তু মনে-মনেও কথাটা বেধে গেল তার-হাজার বারের বার, লক্ষ বারের বার বেধে গেল। কিছুই বদলায়নি- আজ তার মায়া-বৌদির জন্মদিন বলে, আর-উপলক্ষে সে নিমন্ত্রিত বলে, একটু বদলায়নি আর চেহারা ; সেই হাড়-উঁচু কপাল, গর্তে-বসা গাল, থ্যাবড়া নাক, এবড়ো-থেবড়ো ব্রন, আর সেই চিমসে ছাড়া ছাড়া মরা-মরা চুল। তার চুল কে যেন খাবলা মেরে-মেরে উপড়ে নিলো- সাতাশ বছর বয়স হতে-না-হতেই। তা কী আর করা যাবে- ওষুধ-টষুধ বুজরুকি, যে যাবার তাকে রোখা যায় না কিছুতেই- এখন চটপট পরিষ্কার টাক পড়ে গেলেই বাঁচা যায়। বেশ ভদ্র দেখাবে, রীতিমতো ভদ্রলোক, যাকে বলে সম্ভ্রান্ত। দোকানে ঢুকলে দাঁড় করিয়ে রাখবে না, হয়ত ট্র্যামেও দাঁড়াবার জায়গা ছেড়ে দেবে কলেজের ছোকরারা। কেমন একটা আশা মাঝে-মাঝে ঝিরঝির করে তার মনে ; টাক পড়লে হয়ত একটু ভালোই দেখাবে তাকে। - কিন্তু গাল তো সেই গর্তেই থাকবে ? আর ব্রনগুলো জীবনে মিলোবে না ? দুটোর কী দরকার ছিল ? যেকোনো একটা যদি হতো, হয় ভাঙা গাল, নয় ব্রন তাহলে সে কোনোরকমে সামলে সুমলে চলতে পারত, টাক পড়লে ভদ্রলোক সাজাতে পারত, কিন্তু একে ব্রন, তার উপর ভাঙা গাল- নাঃ ।

নিশ্বাস ফেলে সোজা হলো প্রতাপ। এবার আয়নায় ছায়া ফেলল তার সরু রগ-তোলা গলা, সরু কোণ-উঁচু কাঁধ, সরু কবুতর-বুক আর সরু লম্বা-লম্বা পা দুটো। মুখটা যে-রকম না-হয় সে-রকমই আছে, শরীরটা একটু...একটু আর পাঁচজনের মতো হতে কি পারতো না ? “সাবধানে থেকো। যা টি-বি আজকাল কলকাতায় !” কতবার কত লোকের মুখে এ-কথা শুনলো সে ! এক্ষুনি বুঝি য²া হবে- তাকে দেখে এছাড়া আর কোনো কথাই মনে হয় না কারো। নিজেরও ভয় লাগে তার ; এক-এক রাত্রে শুয়ে-শুয়ে য²ার ভয়ে আধ-মরা হ’য়ে গেছে ; তিন-তিনবার এক্স-রে করল কত কষ্টের পয়সা খরচ করে- কই, কিচ্ছু না ! তবু- ওষুধ, ইনজেকশন, ভিটামিন, ক্যালশিয়ম, ক্যালোরি-নিয়ম করে খাওয়া, কম করে খাটা- সবই করে দেখেছে- কই, কিচ্ছু না ! একটু ওজন বাড়ল না, একটু রকম ফিরলো না চেহারার। এই চেহারার সঙ্গে দোস্তালি পাতিয়েই তাকে থাকতে হবে- সারাজীবন, সারা জীবন !

আয়নার কাছ থেকে সরে এসে জানলার তাকে রাখা অ্যাটাশে কেস-এ ভাঁজ করে-করে ভরতে লাগল কোট, শার্ট, মোজা, নেকটাই, পাৎলুন। যদিও যুদ্ধের ধাক্কায় পোশাকের কড়াক্কড় আর নেই, বুশ-শার্টই রেওয়াজ, শার্টের হাতা ঘোষ-সাহেবের কনুইয়ের নিচে নামে না, প্রতাপ তবু পুরোনো নিয়মই মেনে চলে, টাই ভোলে না একদিনও, মোজাও না, ফিতেওলা জুতো পরে, যদিও দাম এখন তার পক্ষে অসম্ভব- এমনিতেই বিলেতি পোশাকে শরীরের সমস্ত খুঁত অসভ্যের মতো বেরিয়ে পড়ে, তার উপর সে কি পাগল নাকি যে হাত, গলা কি পা ঢাকতে পারলেও ঢাকবে না ! নিজের চোখেই নিজেকে যখন এত খারাপ লাগে তার, তখন অন্যের চোখে- না, না, মিথ্যে নিজেকে ভুলিয়ে কী হবে, আশা নেই তার, কোনো আশা নেই। মিছিমিছি সে এত ছটফট করল মায়া-বৌদির জন্মদিন নিয়ে, তিনগুণ দামে এক বেলায় ধুতি কাচিয়ে আনল, সিল্কের পাঞ্জাবিটির একটা কোণ স্যুটকেসের ডলার চাপে এতখানি কুঁচকে গিয়েছিল বলে আবার ইস্ত্রি করালো, মামার কাছে অ্যাটাশে-কেস ধার করলো আপিশের কাজে আসানসোল যাচ্ছে বলে, তার ঘরে আর যে-দু’ভাই শোয়, কাল রাত্রে তারা ঘুমোবার পর ধুতি, পাঞ্জাবি আর খবরকাগজ-জড়ানো স্যান্ডেল ভরে লুকিয়ে রাখলো তক্তাপোশের তলায় আর বোঝা বয়ে নিয়ে এলো আপিশে- পাছে বাড়ি হয়ে যেতে দেরি হয়। মিছিমিছি ! মিছিমিছি! পোশাক বদল নিয়েই হাঙ্গামা কি কম ! ঘোষ-সাহেব নেমে গেলেন, তারপর একটু ঘুরঘুর করে, তাঁর বেয়ারাকে আট আনা দিয়ে খোশমেজাজে এনে ক-মিনিটের জন্য সাহেবের বাথরুমে- আরে! অনেকক্ষণ হয়ে গেল না তো ? আবার গজর-গজর করবে না তো কার্তিক ?

ইংরেজি জুতোজোড়া ভিতরে ঢুকল না ; একহাতে অ্যাটাশে-কেস, আর-এক হাতে কাগজে-জড়ানো জুতো, স্যান্ডেল-পরা লম্বা পা ফেলে প্রতাপ বেরিয়ে এলো ধুতি-পাঞ্জাবিতে। কার্তিক বসে ছিল সাহেবের ঘরের সামনে টুলে, তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো না সত্য, কিন্তু মুখে-চোখে কর্তামিও ফলালো না। তার কাছে এসে দু-হাতের দুই বোঝা মেঝেতে নামিয়ে প্রতাপ বলল, ‘এগুলো রেখে গেলাম আজ- একটু দেখো।’

কার্তিক অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘নিশ্চিন্ত থাকেন।’

কিন্তু প্রতাপ নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। হারিয়ে যাবে না তো ? চুরি হবে না তো ? তার তিরিশ টাকার জুতো ! মাত্র তিন-শীত-পরা ছাইরঙের চেক-স্যুট, যা দূর থেকে গরম কাপড়ের মতো দেখায় ! হঠাৎ হাত দিলো পকেটে, ব্যাগের মুখ খুলে তুলে আনলো একটা আধুলি, মাত্র একমুহূর্ত চিন্তা করে কার্তিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘দেখো কিন্তু -’

কার্তিক টুল ছেড়ে উঠলো এবার, কপালে একবার দ্রæত হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘সাহেবের আলমারিতেই রেখে দিচ্ছি, আপনি কাল একটু সকাল-সকাল-’

প্রতাপ সব শোনার জন্য দাঁড়ালো না। তার মনের পালে হঠাৎ হাওয়া লাগল ; সে-হাওয়া তাকে রাজার মতো পার করে দিলো আপিশের মস্ত শূন্য হলঘর, যেখানে এক কোণে বসে রোজ আট ঘণ্টা ধরে সে হিশেব কষে ; ঠেলে নামিয়ে দিলো সিঁড়ি দিয়ে, যে-সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে নিজের ভাগ্যকে সে রোজ ধিক্কার দেয় ; উড়িয়ে নিয়ে গেল রাস্তায়। আর যা-ই হোক, সে লম্বা তো প্রায় ছ-ফুট, অত লম্বা বাঙালির মধ্যে কজন ? ষোলো শো টাকা মাইনেওলা ঘোষ-সাহেব পড়ে থাকেন তার বুকের কাছে, রাস্তার যত লোক হাঁটছে সক্কলেকে ছাড়িয়ে উঠেছে তার মাথা। ঐ বেয়াদব কার্তিকটা, ক্যাশিয়ারের মুখে-মুখেও যে তর্ক করে, সেও শেষ পর্যন্ত সেলাম না-ঠুকে পারলো না তো !

বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে চারদিকে তাকালো সে। শীতবিকেল শিরশির করছিল একটু আগে ; এর মধ্যে রীতিমতো রাত। সামনে দপদপ করছে ওয়েস্ট-এন্ডের ঘড়ি, ছ-টা বাজতে কুড়ি ; সাড়ে-ছ’টার সময় ওখানে ; তার মায়া-বৌদির এলগিন রোডের ফ্ল্যাটে ট্র্যামে করে পৌঁছতে বড়ো জোর কুড়ি মিনিট, আর তাছাড়া একটু দেরি করে যাওয়াই তো ভালো, ভালো দেখায় ? ভিড়ে-বোঝাই বাড়িমুখো ট্র্যামগুলোকে এমন একটা ভাব দেখালে যেন সে ট্যাক্সি ছাড়া চড়ে না, এখন শখ করে একটু হাঁটছে। লম্বা পায়ে উঁচু মাথায় হাঁটতে-হাঁটতে ভাবতে লাগল কী কিনবে জন্মদিনের উপহার। পনেরো টাকা পর্যন্ত খরচ করবে, মাসের বাকি দশদিনের জন্য পাঁচটি মাত্র হাতে থাকবে তারপর- কিন্তু তার আজকের সুখ যত বড়ো, তার কাছে ক’টা দিনের একটু টানাটানির কষ্ট কি কিছু ? কিছু না, কিছুই না ! মায়া-বৌদির ড্রয়িংরুমে সেই সুন্দর বিলাসিতার মধ্যে গিয়ে বসা, মায়া-বৌদির চলাফেরার সুন্দর ভঙ্গিগুলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা, সমী-দার সুন্দর কথা শোনা- যেকোনোদিনই সুন্দর, কিন্তু আজ এই উৎসবের সন্ধ্যায় না জানি আরো কত ! কথাটা ভাবতেই সুখ তাকে জড়িয়ে ধরলো, উষ্ণ নরম বিলাসিতা তাকে ঘিরে ফেলল মেঘ-রঙের মতো ; আর সেই রং গ’লে-গ’লে দপ ক’রে জ্ব’লে উঠল আলো, অত সুন্দরের মধ্যে সবচেয়ে যা সুন্দর। তার মুখ, তার চোখ, তার চুল প্রতাপ এমন পরিষ্কার দেখতে পেলো চোখের সামনে যে দেখতে- দেখতে আর বুকের ভিতরটা ব্যথা করে উঠল। নাম তার ছায়া ; কী সুন্দর নাম !

এসপ্লানেডের মোড়ে এসে প্রতাপ একটু দাঁড়ালো। কার্জন পার্ক পার হয়ে তার চোখ গেল চৌরঙ্গিতে, নানারঙের আলো-গাঁথা মালা, যুদ্ধের পরে জেল্লা ফিরেছে, ডাকছে ঝলমল করে এসো এসো, এসো এসো- নেশার মতো লাগলো প্রতাপের। দ্রæত পা চালিয়ে দু-মিনিটে চৌরঙ্গিতে এসে পড়ল। একশো-আলো-জ্বলা মেট্রো-সিনেমার তলায় আশ্চর্য ভিড়। তিনটের শো ভাঙলো, ছ-টার শো আরম্ভ হবে। আশ্চর্য চেহারা, আশ্চর্য সাজ, আশ্চর্য বড়ো-বড়ো গাড়ি। এই তো জীবন... আনন্দই জীবন। আর কীসের জন্য মানুষ বাঁচে, যদি না আনন্দের জন্য ? হাজার গাড়ি ছুটছে পথজুড়ে আনন্দের খোঁজে ; হাজার দোকানে আনন্দের পশরা সাজানো। এসো। এসো, এসো। ডাক পৌঁছলো প্রতাপের কানে ; তীব্র, তীব্র জীবন-ক্ষুধা তাকে জাগিয়ে দিলো, জাগিয়ে তুলল তার ভিতরে অন্য একজনকে, সকলের মধ্যে যে-একজন আছে সেই একজনকে, তার যৌবনকে, তার জীবনকে। আছে, সে-ও আছে, তারও আছে, এই আনন্দ তারও, একশো-আলো-জ্বালা সিনেমা-তলার মতো উজ্জ্বল জীবন-এও তার ।

এই প্রথম প্রতাপ বুঝলো বাঁচার অর্থ, বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। কিছুটা এই উপলব্ধির চমকে আর কিছুটা ফুটপাথের ঘেঁষাঘেষিতে পা ফেলা তার মৃদু হ’লো ; সিনেমার ভিড়ে মিশে গিয়ে নিশ্বাসে নিতে লাগল সুখের আদর, আমোদের আতর। কিন্তু সুখের হাওয়া তো শুধু নয়, সমস্ত সুখটাকেই চাই,- শরীর চাই, স্পর্শ চাই, তাপ চাই, তৃপ্তি চাই। অস্পষ্ট, অসীম জীবন-ক্ষুধা সেই মুহূর্তে মূর্ত হলো পাশাপাশি তিনটে রেস্তোরাঁর ধোঁয়াগন্ধে, খাদ্যের ক্ষুধা হয়ে তার জঠরের মধ্যে চাবুক মারল।

ঢুকবে একটায় ?... কিছু খেয়ে নেয়াই তো ভালো, নয়ত আপিশ-ফেরতা খিদের মুখে ওখানে গিয়ে হাম-হাম করে রাক্ষস-মতো খাবে নাকি ?...দেরি ? ভালো তো ! মায়া-বৌদি কোণ-ঠোঁটে হেসে বলবেন, ‘কী, এত দেরি ?’ আর খাবার-থালা হাতে নিয়ে আর একজন-

একটা প্রন-কাটলেটে আর-একটার ইচ্ছে লুকিয়ে থাকে-না, থাক। ওখানে গিয়ে কিছু তো খেতে হবে। যদি কাছে এসে বলে, “খাচ্ছেন না যে ?” যদি বলে, ‘ঐ সন্দেশটা-’ প্রতাপের স্নায়ুতন্ত্রী ঝংকার দিয়ে উঠল সেতারের তারের মতো। কী সুন্দর গলা ! কী সুন্দর বলা ! একজন মানুষের সবই কি সুন্দর ? ঈশ্বর সবই দিয়েছেন একজনকে ? আর আমাকে কিছুই দেননি ?...কিছু দেননি মানে ? যাকে সব দিয়েছেন তাকেই তো দিয়েছেন আমাকে।

চায়ের পেয়ালার দু-তিন চুমুক দিয়ে, চেয়ারে হেলান দিয়ে, একটি সিগারেট ধরিয়ে, একটু লাল না হয়ে, ¤øান না-হয়ে প্রতাপ ভাবলো এই কথা : ঈশ্বর যাকে সব দিয়েছেন, সেই তাকেই তো দিয়েছেন আমাকে। ছায়ার কথা ভাবতেও তার যে-লজ্জা, সে-লজ্জা ঝরে পড়ল শীতশেষের মরা চামড়ার মতো ; এই প্রথম সে নিজেকে ছেড়ে দিলো নিজের সেই মনের হাতে, যে-মনের উঁকিঝুঁকিতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে তার ভয় করে। এই প্রথম সে ছায়াকে মনে আনতে পারল উত্তেজনায় অস্থির না হয়ে। তাকে দেখতে পেলো বসে থাকতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, হাসতে, কথা বলতে, মায়া-বৌদি তার মতো অনেকটা, কিন্তু সে কারো মতোই নয়। আজ দিদির জন্মদিনে সকাল থেকেই আছে হয়তো ; সমী-দা স্টুডিওতে চলে যাবার পর নিরিবিলি দুপুরে কত গল্প দু-বোনে, কত কথা দু-জনে ! সে-কথাই তো সবচেয়ে ভালো যে-কথা শুধু দু-জনের, দু-জনের, দু-জনে...

তার সঙ্গে অবশ্য এ সাত মাসে সাতটা কথাও বলেনি- কিন্তু তাতে কী ? ভালো করে তাকায়ও না তার দিকে- কিন্তু তাতেই বা কী এসে যায়। কোনো একদিন দেখবে না তা কে জানে, কে জানে তাকে দেখতে পাবে না কোনো একদিন। নামজাদা ফিল্মডিরেক্টর সমীরণ সান্যালের ড্রয়িংরুমে তার জায়গা হবে, তাঁর স্ত্রীকে বৌদি বলে ডাকবে, আর সেই বৌদির জন্মদিনে নিমন্ত্রিত হবে, এমন অসম্ভও যদি সম্ভব হয়, তাহলে এর চেয়েও অসম্ভব এর চেয়েও সম্ভব হ’তে কি পারে না ?...অবশ্য দৈবাৎ যদি গিয়ে না-পড়ত ঠিক সময়টিতে রোববার সকালে, তাহলে হয়ত এই নিমন্ত্রণ সে পেতো না, কিন্তু মানুষের জীবনে ভাগ্যের একটা হাত তো আছেই, আর ভাগ্য তাকে এত দয়া করছে হয়ত-বা আরো দয়া করবে বলেই। রোববার সে যখন গেল, অমর মিত্তির তখন বিদায় নিচ্ছেন, আর সমী-দা বলছেন : “পরশু ভুলো না কিন্তু।” “না, না, ভুলবো কেন- মায়ার জন্মদিন !” আর অমরবাবু চলে যাবার মিনিট দুই পরে সিগারেট ধরাতে ধরাতে সমী-দা বললেন, ‘প্রতাপ, তুমি এসো পরশু সন্ধেবেলা- কেমন ?’ কথাটা সে শুনে ফেলেছিল, তাই তাকেও বললেন- কী ভদ্র !

এমন ভদ্রতা কখনো দ্যাখেনি প্রতাপ, এমন ব্যবহার। তার বাবা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করেন, মা গ্রীষ্মকালে শেমিজটা পর্যন্ত পরেন না, ভাইগুলির পেশা পানদোকানে গুলতানি ওঁদের ওখান থেকে ফিরে এসে এক-একদিন অসহ্য লাগে- বাড়ি না, অসহ্য কীসের, তবু তো বিশ্রী আপিশ আর আরো-বিশ্রী বাড়ির বাইরেও আরো-কিছু আছে তার জন্য! এই আশ্চর্য আরো-কিছু তার কপালে সেজে আছে, কে তা ভাবতে পেরেছিল সাত মাস আগে সেই শনিবারে, যেদিন তাদের আপিশের সুবোধ বাগচির সঙ্গে সে ফিল্মের শুটিং দেখতে গিয়েছিল টালিগঞ্জে। বিশেষ কিছু ব্যাপার ছিলো সেদিন, বাইরের ক’জন ভদ্রলোক ছিলেন সস্ত্রীক, মায়া-বৌদি ছিলেন, আর ছিল- মনে-মনে সে স্পষ্ট উচ্চারণ করে ফেলল নামটা- আর ছিল ছায়া। সুবোধ কী-রকম আত্মীয় ওঁদের, এক ফাঁকে বলল, ‘মায়া-বৌদি, এ আমার বন্ধু...‘আর কত লোকজন, গোলমালের মধ্যেও মিসেস সান্যাল আলাদা করে দুটো কথা বললেন তার সঙ্গে। ভদ্রতায় মুগ্ধ হলো প্রতাপ, আর আত্মহারা হলো সুবোধদের সঙ্গে প্রথম দিন ওঁদের বাড়ি গিয়ে। দ্বিতীয় দিনেই মিসেস সান্যালকে বৌদি ডাকল সুবোধের সুবাদে, আর দু-মাস পরে সুবোধ যখন আরো ভালো একটা চাকরি নিয়ে বম্বাই চলে গেল, তখন প্রথম একা গেল একটু ভয়ে ভয়ে, কিন্তু মায়া-বৌদির ব্যবহারে আশ্বস্ত হয়ে মাঝে-মাঝে যেতেই লাগল।

সমী-দা দিলদরিয়া মানুষ, আর মায়া-বৌদি তো মায়া-বৌদি ; ওঁদের ওখানে তাই আড্ডা জমে প্রায়ই সন্ধেবেলা ; কেউ বই লেখেন, কেউ ছবি আঁকেন, কেউ বা ক্যামেরায় ওস্তাদ- এলাহি কাÐ ! ফিল্মের কোনো অভিনেতাও আসেন কোনো-কোনো দিন, যদিও অভিনেত্রীরা কখনো না- কিন্তু অভিনেত্রীদের বিষয়ে আর তো কোনো মোহ নেই প্রতাপের। এমন কোনো অভিনেত্রী আছে, তার-তার সঙ্গে যার তুলনা হয়, ছবি-পর্দার কোনো তারার সঙ্গে আকাশ-তারার তুলনা !

বেশি ঘন-ঘন যায় না সে ; কোনো সপ্তাহে একবার, কোনো সপ্তাহে দু-বার পাছে... কেউ বিরক্ত হয় ! অত সব বড়ো দরের ভিড়ে সে-একটু বেখাপ্পা বইকি। কিছুই তো বলে না, চুপ করে দ্যাখে, শোনে ; কোনো কথায় হাসি যখন ফেটে পড়ে, সে গলা ছেড়ে হাসেও না, মুখে হাত-চাপা দেয়, মুখ ফিরিয়ে নেয়। এঁদের সঙ্গে সমানে-সমানে হাসতে পারে তার কি এতই যোগ্যতা ! তাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না ঐ বই-লিখিয়ে ছবি-আঁকিয়ে ওস্তাদরা- কেনই বা করবে, তবু প্রথম-প্রথম একটু যেন লাগত কোথায়, একবার মাস-মাইনে পেয়েই রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ কিনেছিল, অনেকগুলি কবিতা পড়ে নিয়ে কোমর বেঁধে লেগেছিল কবিতা লিখতে, প্রায় লিখেও উঠেছিল একটা, ‘ওরে আকাশ, ওরে আকাশ, আমার পানে কেন তাকাস’ এই রকম দশ-বারো লাইন- কিন্তু তার পরেই ঘেন্টুটা হঠাৎ জেগে উঠে জানোয়ারের মতো ডাক ছাড়লো, ‘আলো নেবাও !’ পরের রাত্তিরে বসেছিল আবার সেদিন ফোশ করলো ভেন্টু... নাঃ, দু-দুটো বনবেড়াল- ভাই নিয়ে এক ঘরে শুতে হলে কি আর কবিতা লেখা যায়। আর চেষ্টা করেনি, তারপর থেকে নিশ্চিন্তে মেনে নিয়েছে নিজের তুচ্ছতা, তাতেই শান্তি পেয়েছে।

শেষপেয়ালার চা-টুকু খেতে-খেতে আর হাসি পেলো সেই কবিতা লেখার চেষ্টার কথা ভেবে। কত যেন ছেলেমানুষ ছিল এই সেদিনও, কালও, একটু আগেও। হঠাৎ কী হলো, পৃথিবীর সব দরজা খুলে গেছে, ঘরে-ঘরে থরে-থরে উপহার সাজানো তারও জন্য, তারই জন্য।... কবিতা লিখে যোগ্য হতে গিয়েছিল ? মায়া-বৌদি কি কবিতা লেখেন, না ছবি আঁকেন ? অবশ্য রূপ আছে তাঁর, গুণও অনেক, কিন্তু তাঁর বাড়িতেই এমন অনেক মহিলা আসেন যাঁদের রূপ আরো কড়া, গুণ আরো চড়া। কিন্তু তাঁর মতো কি আর কেউ ? রূপ না, গুণ না, তিনি এত ভালো বলেই তো ভালো লাগে এত ? তিনিই সময় করে নিয়ে কথাবার্তা বলেন তার সঙ্গে, ঠিক সেই-সেই কথাই, যাতে সে আরাম পায়। ক্বচিৎ কখনো তাঁর সঙ্গে যদি পাঁচ মিনিট একা কাটাতে পারে, মনের উপর যেন বৃষ্টি হয়ে যায় এক পশলা। এত ভালো- সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা তো এইটেই। আর-চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে প্রায় শব্দ করে সে বলে ফেলল- এ যোগ্যতা তো আমারও ; আমি ভালো। ভালোর একটা প্রকাÐ ঢেউয়ের ধাক্কায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল সে, কর্পোরেশন স্ট্রিটের মোড়ে, চৌরঙ্গির ডিসেম্বরি সন্ধ্যাভিড়ে, হঠাৎ।

ক্রিসমাস সামনে, মার্কেট জমজমাট। ফিরিঙ্গি বাঙালি পার্শি কাফ্রি চীনে- মুখে ফেনা উঠছে দোকানির, দোকানের। বেশ তো-তার ছোটো সরু ফাঁপা বুকটাকেই বেশ একটু চেতিয়ে দিয়ে প্রতাপ এগিয়ে গেল- সেও কিনবে। কী না ? বার্ট্রাম স্ট্রিমের মাঝ-গেট দিয়ে ঢুকে এই প্রশ্নের সে উত্তর খুঁজলো চোখ দিয়ে মন দিয়ে, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিতে বজায় রাখল নির্দিষ্ট কোনো দোকানে নির্দিষ্ট কোনো জিনিশ কিনতে যাবার ঋজুতা। ক্রিশমাস- কার্ড, শায়া-শেমিজ, শীতকাপড়, বেগুনি গোলাপি চোখামুখের কাঁচুলি, এ-সব পার হয়ে মার্কেটের মাঝখানকার ওজন নেবার কল-বসানো চত্বরে এসে সে ঘুরলো ডানদিকে ; রূপো, রেশম, রং-বেরঙের পাথরের গয়না, হাতির দাঁতের পুতুল, টুকটুকে লাল গালার টেবিল। চোখের লোভ সামলে নিলে সে ; এর কোনোটাই টাকায় কুলোবে না, কিন্তু কোনটা কুলোবে তাও ভাবতে পারল না, সোজা হেঁটে-হেঁটে চলে এলো মার্কেটের লিনজে স্ট্রিটের মুখে- আর তক্ষুনি তার চোখ কাড়লো বাঁ দিকে সারি-সারি ফুল। - হ্যাঁ, ফুল। একটু থামলো, তারপর মোড় নিলো সব-কাছের ফুল-দোকানে, এক দঙ্গল ফিরিঙ্গি মেয়ে জুড়ে আছে- কী কলকলানি জিভের ! একটু উদাসভাবে প্রতাপ দাঁড়িয়ে রইল পিছনে তার প্রায় ছ-ফুটের গৌরব নিয়ে। ...গোলাপ, লাল গোলাপ। আঙুল কেটে গেলে প্রথম যখন রক্ত বেরোয়, সে-রকম। আবার একটু পরে তাতে যখন কালচে সে-রকমও। ইলেকট্রিক বাবের মতো বড়ো এক-একটা, পাপড়ির ভাঁজে-ভাঁজে আলো, পিলসুজটা আবার সবুজ, আলো করে আছে আলো জ্বলা মার্কেট, শহর, কলকাতার শীতরাত ।

ফুল সম্বন্ধে কথা হচ্ছিল একদিন, প্রতাপের মনে পড়ল। সমী-দা ভোট দিলেন চাঁপাকে। অনঙ্গ নাগ-ছবি আঁকেন তিনি- হেসে বলেন, “চাপা ? বড্ড মাংসালো, যেন ফল হতে-হতে ফুলই থেকে গেল ভুল করে!” “ফুল বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে জুঁই”, বললেন সাহিত্যিক অমর মিত্র, “আর বাংলাদেশ ভরা আছে ওর ভিতরে।” “তা হতে পারে, ‘মায়া-বৌদি মত দিলেন, “কিন্তু জুঁই ছুঁতে-না-ছুঁতেই ম’রে যায়, আর একমুঠো বকুল গন্ধ দেয় একমাস ভরে।” ‘ও-’ জবাব দিলেন সাহিত্যিক, ‘ফুলের মধ্যেও আপনি বুঝি ট্যাকসই পছন্দ করেন, বেশ শক্তপোক্ত ?’ এ-কথায় সবাই হাসল আর হাসি যখন থামল, ছায়া বলল আস্তে-আস্তে : “আমার কিন্তু গোলাপই সবচেয়ে ভালো লাগে।” ...প্রতাপ কান দিয়ে দেখলো কথাটার উষ্ণ লাল রং, চোখ দিয়ে শুনলো গোলাপের গান। হ্যাঁ, একতোড়া গোলাপ-দশটা, পনেরোটা-কুড়িটা-যে-ক’টা হয়।

ফিরিঙ্গি মেয়ের দল কিছুই কিনল না, আর পিছন থেকে যুবতী মনে হলেও মুখগুলি তাদের বুড়ি-বুড়ি। এ-দুটোতেই উৎসাহ আরো বেড়ে গেল প্রতাপের। কাছে গিয়ে, “গোলাপ কত করে-ঐ বড়ো-বড়োগুলো ?” আঙুল দিয়ে জ্বলজ্বল একটি তোড়া দেখিয়ে সে জিগ্যেস করল।

‘পঁচিশ টাকা।’

‘ঐ ক-টা ফুল পঁচিশ টাকা !’ অভিজ্ঞ ধরনে ভুরু কুঁচকোলো প্রতাপ। “ঐ ক-টা নয়- একটা।”

‘একটা !’ চিৎকারের মতো শোনালো কথাটা, আর্তনাদের মতো।

‘একটা ফুল পঁচিশ টাকা’, হৃদয়হীন শৈত্য দোকানির ঘোষণায়।

আকাশ ভেঙে পড়ল প্রতাপের মাথায়। যুদ্ধের ক-বছরে অনেক আজগুবি দাম শোনা গেছে : একটা আদ্দির পাঞ্জাবি আটচল্লিশ টাকা, এক টিন গোল্ড ফ্লেক বারো টাকা, আড়াইশো টাকায় চায়ের সেট- কিন্তু তা বলে একটা ফুল পঁচিশ টাকা ! ফুল ! একটা ! পঁচিশ ! একবার দেখেছিল একটা কুকুরছানা ফুর্তিসে নেচে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, হঠাৎ গাড়িচাপা পড়ল কী চীৎকার ! কিন্তু সে তো মানুষ, সে তো কুঁইকুঁই করতে পারে না।

একযুগল এসে দাঁড়ালো দোকানে। ইংরেজ নয়, বাঙালিও মনে হয় না, কিন্তু হতেও পারে আজকাল। নাবিক-নীল ¯ø্যাক্স-এর উপর লাল জাম্পার পরা কোঁকড়া খাটো চুলের স্ত্রীলোকটি দশটা গোলাপ নিলে, আর পুরুষটি একবার চোখের পলক না ফেলে বের করে দিলে দুখানা একশো টাকার নোট, তারপর কেউ কারো দিকে না-তাকিয়ে চলে গেল।

“দশটা দু-শো টাকা হলে একটা তো কুড়ি টাকা হয়,” দোকানির চোখ এগিয়ে হঠাৎ বলে ফেলল প্রতাপ ।

উত্তর হলো : ‘একটা নিলে পঁচিশ টাকা।’

‘কুড়ি টাকায় হয় না ?’

‘না।’

কয়েকবার জোরে-জোরে নিশ্বাস নিয়ে প্রতাপ বলল, “দিন না- দেখুন, ঠিক কুড়ি টাকাই আছে- বড়ো দরকার-”

এতক্ষণে দোকানি একবার দৃষ্টিপাত করলো তার দিকে। একটু পরে বলল : “ক-টা নেবেন ?”

‘একটাই-’ দোকানির চোখে দয়ার আভাস লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি জুড়ে দিলো, “বড়ো দেখে একটা দেবেন- ঐ-ঐটে।”

পাৎলা কাগজে জড়ানো রক্তরঙের গোলাপটি হাতে করে রাস্তায় নামল তাড়াতাড়ি। ঢংঢং করে বাজল মার্কেটের চুড়ো-ঘড়ি- পৌনে সাত! দেরি হয়ে গেছে, বড্ড দেরি। সে গিয়ে দেখবে, ঘর ভর্তি ; চা অর্ধেক হয়ে গেছে, কথার তুবড়িতে, হাসির হাউইতে নিশ্বাস নেবার সময় নেই ; অনঙ্গ নাগ, অমর মিত্র ; সুরেশ্বের বাড়–য্যে, অ্যাক্টর ; নরেন চন্দ, ক্যামেরার কারিগর ; ইন্দু দাস, কিছু-একটা-কী, তা আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারেনি প্রতাপ ; আর লতিকা দেবী, সুনন্দা দেবী, অনুরাধা দেবী- স্ত্রীলোক মাত্রেই দেবী, সমী-দার ড্রয়িংরুমে- আরো কে-কে ? আরো অনেকে। এই ঝকঝকে ঝলমলে দলের মধ্যে হঠাৎ হাজির হবে সে, লম্বা রোগা, ল্যাগবেগে ; বাছা-বাছা দামি-দামি উপহারের পরে একটি গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে কেউ তাকাবে না তার দিকে, কি প্রত্যেকে তাকাবে, বসতে গিয়ে মাড়িয়ে দেবে কোনো ভদ্রমহিলার জুতো কেশে উঠবে নরেন চন্দর কড়া পাইপের ধোঁয়ায়, একটা কথা বলবে না, তবু বসে থাকবে, থাকতেই হবে, কেননা, অন্যদের আগে স্বাধীনভাবে বিদায় নিতে হয় কেমন করে, তাও সে জানে না।

ট্র্যামের দিকে যেতে-যেতে প্রতাপ কেঁপে উঠল। সাত বছরের পুরোনো তার আলোয়ান, রং-চটা, ফুটোওলা, - তবু এখন মনে হচ্ছে আনলেই হতো। চোখ পড়ত কারই বা ? যদি পড়ত ? তাকে যদিও চোখে দ্যাখে না কেউ, তার আলোয়ানের ফুটোগুলো হয়ত... কিন্তু তাতে কী ? সে যে গরিব তা কি লুকোতে পারে ? সে যে কুচ্ছিৎ? তা কি ঢাকতে পারে ? জীবনের যে-আশা, যৌবনের যে-আনন্দ, ভালোর যে-তরঙ্গ একটু আগে তাকে পাগল করেছিল, জ্বরের মতো ছেড়ে গেল তা ; তিন থাপ্পড়ে তার বেয়াদবির দাঁত ভেঙে দিয়ে উত্তুরে হাওয়া তার মগজে সেঁধিয়ে দিলো এই সত্য যে সে প্রতাপ, সেই প্রতাপ, ডিয়ার্নেস অ্যালাউয়েন্স নিয়ে একশো দশ টাকা যার মাইনে, যার মুখ গাল-ভাঙা আবার ব্রনের ভরা, ছ-ফুটের কাছাকাছি লম্বা হয়েও কারো চোখেই যে পড়ে না, আর চোখে পড়লে যাকে য²ারোগী দেখায়। সমীরণ সান্যালের স্ত্রীকে বৌদি ডাকে বলে অন্য কেউ হয়ে যায়নি সে ; ফাঁকতালে দায়-সারা নেমন্তন্ন পেয়েছে বলে নতুন করে জন্মায়নি- না, না, না, না-আঁ-আঁ শব্দে ট্র্যাম থামল। দাঁড়াবার জায়গা পেল ঠিক ইলেকট্রিক পাখার তলায়, সোজা হলে মাথা যায় ঠুকে, আবার গোলাপটিকে বাঁচাতে হবে- তবু ভাগ্যিশ ধরবার কড়া আছে এটাতে। সে যে এত লম্বা, এটাও তাকে নিয়ে অদৃষ্টের একটা ঠাট্টাই তো : আর- কোনো দিকে কিছু না, হঠাৎ মাঝখান থেকে ঢ্যাঙা হয়ে উঠল বিদঘুটেরকম ; ধুতি পরলে আর্ধেক পা বেরিয়ে থাকে- আর পায়ের যা বাহার ! অনেক ভালো ছিল সে যদি ছোটোখাটো হতো, অমন কাঁকলাসের মতো দেখাতো না তাহলে, মানিয়েও যেত অবস্থার সঙ্গে, পৃথিবীর ভিড়ের মধ্যে এক ফাঁকে লুকিয়ে থেকে আরাম পেত।

ট্র্যাম যত গন্তব্যের কাছে এল, তত কমে এল তার পৌঁছবার গরজ। এই জন্মদিনের ব্যাপারটা নিয়ে এত ছটফটানির দরকার ছিল না কিছুই। সেই তো দেরিই হলো : বাড়ি গিয়ে, বরাদ্দ চা-রুটি খেয়ে, কাপড় বদলে ধীরে-সুস্থে এলেই পারত। পাড়ার দোকান থেকে কিনে নিতে পারত দু-চার টাকার মধ্যে একটা পাউডার-কেস, কি কোনো সেন্ট, কি একখানা কবিতার বই।... অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার আস্পর্ধায় কাপড়ের বস্তা বয়ে নিয়ে গেল আপিশে : একটাকায় কিনল আধখানা সেলাম, কুড়ি টাকায় একটি গোলাপ ; খেয়ে ফেলল বারো আনার ; এখন কয়েক আনা খুচরো আছে পকেটে ; কালই ভাবতে হবে পাঁচটা টাকা ধার মিলবে কোথায়। কী বোকা ; কী বোকামি- ছি ! নিজের বোকামির বহর স্পষ্ট বুঝতে পেরে তার ইচ্ছে হলো ট্রাম থেকে লাফিয়ে পড়ে।

নিমন্ত্রণ না-নিলেই হতো ; তা-ই তো উচিত ছিল তার। প্রথমত, সত্যি-সত্যি সে নিমন্ত্রিত নয়, শুধু ঐ সময়ে গিয়ে পড়েছিল বলেই মুখের একটা কথা বলেছিলেন সমী-দা। দ্বিতীয়ত, অন্য দিন যেমনই হোক, আজ ওখানে বড়োই বেখাপ্পা সে, যেন বাঘ আর চিতাবাঘ আর ময়ূরের মেলায় রোঁয়া-ওঠা শেয়ালটা। আর তৃতীয়ত, সে কি দুটো টাকাও কারো জন্য খরচ করতে পারে ? সত্তর টাকা তো বাবাই নিয়ে নেন, আর চল্লিশ টাকায় তার নিজেরই চলে না ; শেষ মাসে টিফিন বাদ, কত ভালো ফিল্ম এসে এসে চলে যায়, দুটো পাঞ্জাবি করাবে ভাবতে-ভাবতে কেটে গেল ছ-মাস। সত্যি, যেকোনো ছুতোয় তখনই কেন কেটে দিলে না নেমন্তন্নটা ? কিন্তু সমী-দার মুখের উপর, মায়া-বৌদির সামনে সে আবার অত কথাও বলবে। তা বলতে পারলে তো মানুষই হতো একটা। সে-ই যদি ও-কথা বলতে পারবে, তাহলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে মনে-মনে ডিগবাজি খাবে কে ?

থিয়েটার রোড পার হলো। থিয়েটার রোড, সার্কুলার রোড, এলগিন রোড। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে নামতে হবে তাকে। শরীরটাকে বেঁকিয়ে-বেঁকিয়ে পাখার তলা থেকে সরে এলো মিনিটখানেকের চেষ্টায়, দরজার হাতল ধরে দাঁড়ালো, চোখ দিয়ে আঁচ করতে লাগল ব্যূহভেদের কৌশল। খুব সাবধান, নামতে গিয়ে ফুলটি না পড়ে যায়। কিন্তু গেলই-বা। না-ই বা গেল সে ওখানে, সোজা চলে যাক-না বাড়ি। এতক্ষণের কণ্টকিত উৎকণ্ঠার পর হঠাৎ এ-কথা ভেবে সে যেন শান্তি পেল যে ইচ্ছে করলে এখনো সে না-গিয়ে পারে। এ-পর্যন্ত যত বোকামি তা তো হয়েই গেছে, এখনো না-গেলে শেষ বোকামিটা বাঁচে তবু। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। আনন্দ একতিল কমবে না সে না-গেলে। কারো মনে হবে না তার কথা। তাহলে যাওয়া কেন ? সে একাই জানে তার অন্য সব বোকামির খবর ; কেন একঘর লোক দেখিয়ে সব-বড়ো বোকামিটি করা ?

বুকে ঠেকিয়ে সোজা করে ধরা গোলাপটির দিকে শোকের চোখে সে তাকালো। পাৎলা সাদা কাগজের গা ফুটে বেরোচ্ছে লালরঙের আভা ; গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল মুখের উপর, দম আটকে গেল মুহূর্তের জন্য। কাছাকাছি দু-তিনজন, প্রতাপ লক্ষ্য করল, আড়চোখে দেখছে ফুলটিকে, গন্ধটা ভোগ করে নিচ্ছে যতক্ষণ আছে এখানে।... ফুলটা তাহলে ভালোই ? কিন্তু আরো কত ভালো, আরো কত জমকালো আজ সাজানো আছে মায়া-বৌদির ঘরে, তার পাশে এই ফুল, একটি ফুল, একটিমাত্র ! ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসবো না নরেন চন্দ, আর অনঙ্গ নাগ চোখ টান করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়বে না উপর দিকে !

‘নামবেন নাকি মশাই ?’

‘নামতে হয় নামুন, নয়তো সরে দাঁড়ান, পথ ছাড়–ন !’

... কী অসভ্য হয়েছে আজকাল কলকাতার লোক ! ধাক্কা খেয়ে নেমেই পড়তে হলো। রাস্তা পার হতে গিয়ে থমকালো দু-বার- এই মোড়টা বিশ্রী ! তারপর টিপিটিপি পায়ে ঢুকলো এলগিন রোডে বাঁ দিকের ফুটপাত ধরে। এক, দুই, তিন, চার... তার হৃৎপিÐ তার পায়ের শব্দ শুনতে লাগল।

তাহলে সেই গেলই ! না-গিয়ে পারলে না !

একতলা...দোতলা...তেতলার সিঁড়ির মোড় ঘুরতেই চোখ পড়ল ব্রাউন রঙের দরজাটা ভেজানো, তবু ভিতরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকেই। কাছে আসতে তাকে অভ্যর্থনা করলো হাসির ঢেউ। একটু দাঁড়ালো দরজার বাইরে, নিশ্বাস নিলো জোরে-জোরে, কিন্তু সাহস ফেল পড়ল শেষ মুহূর্তে তবু আবছা একটা ইচ্ছে রইল ; কাগজে জড়ানো ফুলটি হাত থেকে ফেলে দিয়ে আস্তে ঠেলা দিলো দরজায়, ঢুকে পড়লো ভিতর।

* * *

যে-রকম সে ভেবেছিলে, ঠিক সেই রকমই হলো সব। মায়া-বৌদি বললেন, ‘এসো, প্রতাপ,’ বলে একটি সাজানো থালা দিলেন তার হাতে। বসতে হলো মস্ত মোটা এক ভদ্রলোকের পাশে- ঠিক পাশে নয়, পিছনে- এঁকে আগে কখনো দ্যাখেনি, কথায় কথায় জানলো মায়া-বৌদির মামা, দিল্লির বড়ো চাকুরে-ভদ্রলোক যতবার হেসে ওঠেন, ততবার একটু পিছনে সরতে হয় প্রতাপকে, সরতে সরতে প্রায় দেয়ালে মিশে গেল, তবু হাসতে... হাসতে আরো পেছোন মামাবাবু, আর তাঁর পাট-করা শালের ধারটা প্রতাপের নাকে শুড়শুড়ি দেয়। এত হাসির খোরাক জোগাচ্ছিলেন সুরেশ্বর বাঁড়ুয্যে, থিয়েটারের পুরোনো অ্যাক্টরদের মুদ্রাদোষ নকল করে ; এক ফাঁকে সমী-দা বললেন, “তা যা-ই বলো, ওঁদের মতো আর হলো না এখনো। শিশির ভাদুড়ীর সেই সীতা ডাক-’ অনঙ্গ নাগ বললেন, “হতে পারত তপনকিরণ- যদি বেঁচে থাকত।” “সত্যি!” অনুরাধা দেবী পাখির মতো গলায় ব’লে উঠলেন, ‘কী-রকম হঠাৎ মরে গেল, আর কী অল্প বয়সে !” ‘ছাব্বিশ।’ ‘না তো,’ অমর মিত্র প্রতিবাদ করলেন, “ঊনতিরিশ।’ এ নিয়ে তর্ক চলল খানিকক্ষণ, তারপর আটাশে মীমাংসা হলো। ক্যামেরাম্যান কথা বলেন কম, এতক্ষণে আওয়াজ দিলেন, ‘এই সেদিনও দেখলাম তপনকিরণকে-’ একটা আপসোসের আওয়াজ করলেন দু-ঠোঁট দিয়ে- ‘আর কাল তার দাদার সঙ্গে দেখা হলো। চেহারায় এমন মিল- যদি কলকাতার রাস্তা আর দিন-দুপুর না হতো, তাহলে নিশ্চয়ই ভাবতুম ভূত।’ “কলকাতায় দিন-দুপুরে বুঝি ভূত বেরোয় না ?” বলে উঠলেন ইন্দু দাশ, “তাহলে শুনুন-” “না, না,” সুনন্দা দেবী দু-হাত তুলে চি-চিঁ করলে, “রক্ষে করুন ইন্দুবাবু, ভূতের গল্প বলবেন না !” এই উৎসাহ পেয়ে ইন্দু দাশ বেশ গুছিয়ে আরম্ভ করলেন ভূতের গল্প, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জমলো না দেখে গল্পকে ঘুমিয়ে নিয়ে গেলেন গবেষণায়, পেতিœ আর শাঁকচুন্নিতে তফাৎ কী, মামদো ভূত আর ব্রহ্মদৈত্যের মধ্যে বড়ো কে, জানোয়ার মরলেও কি ভূত হয়, না শুধু মানুষই। মামাবাবু হঠাৎ বললেন, “একটা আশ্চর্য ঘটনা কি জানেন আপনারা ? নাইন্টিন টোয়েনটিসিক্স-এ অরোরা নামে এক ঘোড়া ভাইসরয়জ কাপের বাজি জিতেছিল।” বলেই চুপ করলেন, দু-তিনজন বলে উঠল, “আশ্চর্য কেন ?” ‘অরোরা মারা গিয়েছিল সেদিনই সকালে !” ...এ থেকে ঘোড়দৌড়ের গল্প উঠল, লতিকা দেবী যোগ দিলেন তাতে, সুনন্দা দেবীও, কিন্তু এই প্রসঙ্গটিতে সকলের উপর টেক্কা দিলেন সুনন্দা দেবীর স্বামী, অর্থাৎ সাহিত্যিক অমর মিত্র।... ন-টা বাজাল, সাড়ে-ন’টা, প্রায় দশটা। হঠাৎ একবার সবাই যখন চুপ, ‘উঠলে হয়, এবার’ প্রস্তাব করলেন নরেন চন্দ। ‘হ্যাঁ, উঠি-’ নড়াচড়ায় ঝিরিঝিরি লাগল, শাড়ির খসখসানি।...আর তারপর সবাই এক সময় উঠে দাঁড়াল, এতক্ষণ ধরে রীতিমতো দুমড়োনো শরীরটাকে দু-পায়ের উপর সোজা করতে পেরে কৃতজ্ঞ হলো প্রতাপ।

পারলে অনেক আগেই সে উঠে আসত, কিন্তু তা যে পারবে না তা তো আগে থেকেই তার জানা। কেমন-একটা ঝিমুনির মধ্যে সে কাটিয়ে দিলো সময়টা, কি খেলো লক্ষ্য করল না, কথাবার্তার অর্ধেকটা মোটে শুনলো, একবার চা-পেয়ালা মুখে তুলতে গিয়ে দ্যাখো, ঠান্ডা হয়ে সর পড়ে আছে। মাঝে-মাঝে তার চোখ ঘুরে বেড়ালো এদিক-ওদিক ; মায়া-বৌদি বসে আছেন মাঝখানকার বড়ো সোফায় লতিকা দেবী আর অনুরাধা দেবীর মাঝখানে- রোজই হাসিখুশি, আজ যেন সুখের প্রতিমা- আর একটু দূরে, দুই দেয়ালের কোণে জানলার তলায় ছোটো একটি চেয়ারে কচিপাতা রঙের শাড়িতে সেজে আছে সে, ছায়া ; সকলের মধ্যে থেকেও যেন একলা ; সব কথাই শুনছে, বলছেও মাঝে-মাঝে, কিন্তু মন যেন তার অন্য কোথাও কোথায় ? - দেয়ালের ঐ ছবিতে, নাকি, জানলার বাইরে আকাশে ? প্রতাপ বেশিবার তাকায়নি তার দিকে পাছে চোখাচোখি হয়ে যায়, পাছে এমন ধারণা ভুলেও তার মনে বাসা নেয় যে, ছায়া কোনো-এক অন্যমনস্ক মুহূর্তেও তার দিকে তাকিয়েছিল। সত্যি বলতে, ছায়ার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারেনি একবারও, পাতা-সবুজ শাড়ির ঘনসবুজ পাড়টিকেই পায়ের কাছে দেখেছে বারবার। আর সকলের সঙ্গে-সঙ্গে সেও যখন উঠে দাঁড়ালো, তখন হঠাৎ যেন একটা পাতাভরা গাছের ঝিরিঝিরি হাওয়া লাগল প্রতাপের গায়ে।

কথা বলতে-বলতে দরজার কাছে এলো সবাই। সুনন্দা দেবী বেরোলেন, বেরিয়েই হোঁচট খেলেন উঁচু হিলে। চট করে তাঁর হাত ধরে ফেললেন অনঙ্গ নাগ।

“কী হলো ?”

“কী যেন একটা পড়লো পায়ের তলায়।”

“কী, দেখি-” সমীরণ সান্যাল নিচু হলেন, হাতে করে তুললেন বান্ধবীর পদস্খলনের কারণটিকে- “আরে, একটা গোলাপ ! একবারে কাগজে মোড়া !” আস্তে খুলে ফেললেন মোড়ক ; হেসে মুখ দেখাল সম্পূর্ণ ফোটা রক্ত-লাল গোলাপ, সমীরণের হাতের মুঠোর মতো মস্ত, হেসে তাকিয়ে রইল, গন্ধ ছিটিয়ে দিলো গায়ে গায়ে, তারপর এত জোড়া চোখের তলায় হঠাৎ যেন শিউরে উঠে ঝরিয়ে দিলো একটি, দুটি, তিনটি জুতো-চাপা পাপড়ি।

“এঃ-ফুল মাড়িয়ে দিলে জুতোর তলায় !” সাহিত্যিক ঠাট্টা করলেন স্ত্রীকে।

“আমি কি জানি যে-”

“তা আর কী হয়েছে”, অনঙ্গ নাগ তাড়াতাড়ি বান্ধবীকে উদ্ধার করলেন, “সেকালে রূপসীদের লাথি না-খেলে অশোক ফুটতো না, একালের গোলাপও দেখছি একটুও বিমর্ষ নয়, বরং খুশি !” “কী সুন্দর।” বললেন মায়া দেবী! “কী গন্ধ, অঃ !” লতিকা দেবী জোরে নিশ্বাস নিলেন।

“দামি গোলাপ!” সমজদারি ঢঙে চোখ বাঁকালেন সুরেশ্বর বাড়–য্যে। “পঁচিশ টাকার কম তো না !”

“বলো কী!” ক্যামেরাম্যান হতভম্ব।

“তবে আবার কী। গোলাপ কি ছোঁয়া যায় আজকাল !”

এত দাম শুনে গোলাপটির মূল্য বেড়ে গেল সকলের মনে। এখানে এলো কেমন করে ? কেউ ভুল করে ফেলে গেছে ? না, ইচ্ছে করে রেখে গেছে ? আপনারাই কেউ আনেননি তো ? কী আশ্চর্য, আমরা আনবো কেন- আর আনলে তো আপনার হাতেই দিতুম। আজকের শুভদিনে এ-রকম একটি ফুল আপনার হাতে দিতে পারা কি কম ভাগ্য ! মামাবাবু বলেন, ‘তোর কোনো ভক্ত তোকেই দিয়ে গেছে, মায়া- অনিমন্ত্রিতের নীরব নিবেদন !”

‘মায়াকে-না আমাদের ছায়াকে ?’ অনঙ্গ নাগ চোখ দিয়ে হাসলেন ছায়ার দিকে। ‘হ্যাঁ- ঠিক ! ঠিক! ছায়াকেই দিয়েছে। হাসির রোল উঠল মহিলাদের।

“তবে আমাকেই দাও-” বলার সঙ্গে-সঙ্গে ছায়া এগিয়ে এসে ফুলটি তুলে নিলো জামাইবাবুর হাত থেকে, ডান হাতের ঝলক তুলে পরে নিলো খোঁপায়। কালো চুল আলো হলো।

সকলের পিছনে দাঁড়িয়েও সকলের মাথার উপর দিয়ে প্রতাপ সব শুনলো, সব দেখলো। ছায়া সরে দাঁড়ালো এবার, আবার ঝিরিঝিরি হাওয়া দিলো পাতাভরা গাছ, সে-গাছে ফুল ফুটলো এইমাত্র, লাল ফুল, লাল গোলাপ আলো করে আছে, আলো হয়ে আছে, কালো চুল আলো হলো, কালো হলো আলো, সারাদিনের, সারাজীবনের, হাজার জীবনের সকল কালো আলো হয়ে গেল একটি মুহূর্তে, একটি লাল গোলাপে।

...তিনটি গাড়ির কোনটিতে কে যাবে তা নিয়ে জটলা শুরু হলো রাস্তায় নেমে, কিন্তু প্রতাপ আলগোছে সরে পড়েছে তার আগেই, নিরিবিলি ফুটপাতে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলেছে একা, লম্বা কাঁপা-কাঁপা। কিন্তু শীতে না, শীতের হাওয়ায় না, সে কাঁপছে পাতাভরা গাছের ঝিরঝির হাওয়ায়, যে-গাছে ফুল ফুটলো এই মাত্র, লাল ফুল, তার ফুল, তার রক্ত-রাঙা গোলাপ, তার রক্ত-ভরা হৃৎপিÐ। হ

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ