অভিশপ্ত প্রাসাদ-কাজী দিশু

12 Apr 2023, 02:28 PM গল্প শেয়ার:
অভিশপ্ত প্রাসাদ-কাজী দিশু

বিষণ্ন শরতের মেঘগুলো যখন বিরক্তিকরভাবে নিচু হয়ে ঝুলে পড়েছে আকাশ থেকে, সেই সময়ে একটা গোটা একঘেয়ে চাপবাঁধা নিঃশব্দ আমি ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়িয়েছি এই গ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সন্ধ্যার অন্ধকারের পৌঁচ যখন পড়তে শুরু করেছে তখনই আমার চোখে পড়লো আশারের সেই অলৌকিক বাড়িটা। ঠিক কী রকম বলতে পারছি না, কিন্তু বাড়িটার প্রথম দর্শনেই আমার চেতনার মধ্যে অসহ্য এক নৈরাশ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। অসহ্যই মনে হচ্ছিল, কেননা, এই ধরনের একটা পরিত্যক্ত বা ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ দেখলে একজাতীয় আধা-ভালো লাগা, যে কাব্যিক অনুভূতি মনকে হালকা করে দেয়, সেরকম কিছুই আমার মনে হচ্ছিল না। সামনের সেই দৃশ্যের দিকে আমি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। জমিদারির চিহ্ন-আঁকা সমস্ত ভূচিত্রের ওপর স্থির হয়ে আছে একটি মাত্র বিরাটকায় বাড়ি। সেই ববর্ণ দেওয়াল, শূন্য কোটরের মতো জানলা, দৃষ্টিকটুভাবে বেড়ে ওঠার হোগলার জঙ্গল, আর আশেপাশে মরা গাছের কিছু গুঁড়ি। হতাশ মনের এই অবস্থা তুলনা করবার মতো পার্থিব অনুভূতি একটিই আছে- গাঁজাখোর যখন নেশার মত্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠে প্রত্যক্ষ করে প্রাত্যহিক জীবনের বিষণ্নতাকে, রহস্যময়তার মায়াজাল তখন সরে যায় !

চেতনার মধ্যে নেমে আসছিল এক হিমশৈত্য শ্বাসরুদ্ধতা হৃদয়ের অসুস্থ অনুভূতি এবং অপ্রতিরোধ্য বিষাদ। কোনোরকম কল্পনা দিয়েই এটাকে সামান্যতম উচ্চমানের অনুভূতিতে পরিণত করা সম্ভব নয়। এই অনুভূতি আসলে কী রকম ? ভাববার জন্য আমি একটু দাঁড়ালাম। আশারের অট্টালিকা সম্বন্ধে চিন্তা করার এমন কী থাকতে পারে যা আমাকে দুর্বল করে তুলছে ! এ এক দুর্বোধ্য রহস্য। যতই চিন্তা করি এই অস্পষ্ট এবং অদ্ভুত কল্পনার কিছুই মাথায় ঢোকে না। শেষ পর্যন্ত এই অস্বস্তিকর সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এমন কিছু নিছক প্রাকৃতিক বস্তু নিশ্চয়ই আছে যারা একসঙ্গে জড়ো হলে মন ও মস্তিষ্কে এইভাবে আক্রমণ করতে পারে। অবশ্য এই শক্তির উৎস যে কী তা আমাদের মনের গভীরে খুঁজে দেখলেও পাওয়া যাবে না। আমার মনে হলো, এইসব নৈসর্গিক বস্তুই একটু অন্যভাবে সাজিয়ে নিয়ে তা আমার শঙ্কা বাড়িয়েও তুলতে পারে, আবার সেটা একদম মিলিয়েও যেতে পারে। এই কথা চিন্তা করে আমি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে বাড়ির সামনের বিশ্রী, ভয়ঙ্কর সেই ছোটো পার্বত্য খাদের খাড়া পাড়ের কিনারায় এসে দাঁড়ালাম। সেই অমসৃণ কালো জলের ওপর ঝুঁকে পড়েই আমি আরো প্রচণ্ডভাবে রোমাঞ্চিত হলাম। জলের ভেতর নতুন করে তৈরি করা ওলটানো প্রতিকৃতি কাঁপছে বিবর্ণ হোগলার জঙ্গল, মরা গাছের গুঁড়ি, শূন্য অক্ষিগহ্বরের মতো জানলার সারি। 

মনে যাই হোক, এই বিষণ্ন পুরীতে আপাতত কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি সাময়িকভাবে বসবাস করতেই এসেছি। এর মালিক রডরিক আশার ছিল ছেলেবেলায় আমার অন্তরঙ্গ-ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু শেষ সেই কবে দেখা হয়েছে, খুব একটা মনে পড়ে না, -দীর্ঘকালের কথা সেসব। এখান থেকে অনেক দূরে, সামান্য কিছুদিন আগে একটি চিঠি আমার কাছে পৌঁছেছে। রডরিকের কাছ থেকেই গিয়েছে সেই চিঠি, একেবারে নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে লেখা- যাতে কেবল উত্তর লিখে দিয়েই আমি দায় না চোকাই। চিঠিতে মানসিক চাঞ্চল্যের প্রবল ছাপ ছিল। পত্রলেখক তার প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতার কথা লিখেছে, সেইসঙ্গে আছে বিরক্তিকর এক মানসিক ব্যাধি। সবচেয়ে বড়ো বন্ধু বা বলা যায় একমাত্র বন্ধু হিসেবে আমাকে দেখবার এক পরম আকুতি সে জানিয়েছে যাতে আমাদের মতো সামাজিক মানুষের আনন্দ উৎফুল্লতায় তার রোগের কিছু উপশম হয়। এসব কথা এবং আরো অনেক কথা যেভাবে সে লিখেছে তাতে তার হৃদয়ের স্পর্শ খুঁজে পেয়েছি আমি, সুতরাং ইতস্তত করবার কোনো অবকাশ ছিল না। এই অদ্ভুত ধরনের অনুরোধ পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তা রক্ষা করার জন্য বেরিয়ে পড়েছি।

বাল্যকালে যদিও আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব বেশি, কিন্তু বন্ধু রডরিক সম্মন্ধে আসলে আমি খুবই চাপা। এটা অবশ্য জানতাম যে তাদের সুপ্রাচীন বংশ স্মরণাতীতকাল থেকেই ভাবপ্রবণ মেজাজের জন্য বিখ্যাত। অতীতে বহুদিন তারা মহৎ শিল্পকলার চর্চা করেছেন এবং সম্প্রতি তা পরিবর্তিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত এক বিশাল দানশীলতায়। এর সঙ্গে আছে সংগীত-শাস্ত্রের প্রতি প্রচণ্ড আবেগ ও শ্রদ্ধা- ঠিক সহজগ্রাহ্য সৌন্দর্য বা প্রচলিত সাংগীতিক রীতি নয়, একটু জটিল ধরনের সংগীত শাস্ত্রের প্রতি ছিল বেশি ঝোঁক। এই বনেদি এবং সম্ভ্রান্ত বংশ সম্মন্ধে আর একটি কথাও আমার জানা ছিল যে, এদের আত্মীয়-স্বজন অর্থাৎ বংশ বিস্তার খুব বেশি ছিল না কখনোই। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, বংশ ক্রমেই ছোটো হয়ে আসছিল- প্রায় প্রত্যেক পুরুষেই ব্যতিক্রম ছিল খুবই নগণ্য। লোকের সাধারণ প্রবণতা এবং কয়েক শতাব্দী ধরে এই বংশ বৃদ্ধির অভাবের মধ্যে সামঞ্জস্যের কথা আমি চিন্তা করে দেখলাম,- জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর এই একান্ত অভাবের জন্যই মনে হয় ব্যতিক্রম এবং বংশের স্থাবর সম্পত্তির নাম প্রায় এক হয়ে গিয়েছে। তার ফলেই বোধহয়, বংশের খেতাব থেকে এই বাড়ির নাম দাঁড়িয়েছে ‘আশারের প্রাসাদ’। যে কৃষক সম্প্রদায় তাদের জমিজমা ও সম্পত্তি ব্যবহার করত তারাই বোধহয় বংশের খেতাব এবং এই প্রাসাদটি এক করে ফেলেছে।

ওই যে বাচ্চা ছেলের মতো হ্রদের মধ্যে দিয়ে আমি প্রাসাদটার প্রতিফলন দেখছিলাম আর প্রতিক্রিয়ায় আমার মনের সেই অদ্ভুত অনুভূতিই তীব্রতর হচ্ছিল। আমার অন্ধ সংস্কার সম্মন্ধে সচেতনতা ছাড়া এই অনুভূতিকে আর কিই-বা বলা যায়। সেই চেতনা আমার সংস্কারকেই ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছিল। তাই অবশ্য হয়- আমি জানি, সমস্ত রকম অনুভূতিরই মূলে আছে আশঙ্কা এবং শঙ্কা, শুনতে গোলমেলে লাগলেও কথাটা নির্ভেজাল সত্যি। এবং হয়ত সেই জন্যেই, হ্রদের ছায়া থেকে যখন আসল বাড়িটার দিকে আবার তাকিয়েছি- একটা অদ্ভুত কল্পনা মনে উঁকি দিল।- অত্যন্ত হাস্যকর কল্পনা, তবু বলছি, কারণ সেইসব অনুভূতি কী দুর্দান্ত তীব্রতায় আমায় বিরক্ত করে তুলেছিল সেটা বোঝা যাবে- আমার দুশ্চিন্তা এমনভাবে আমার মনে আঘাত করছিল যে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সমস্ত প্রাসাদে এবং আশেপাশের আবহাওয়া ছড়িয়ে রয়েছে তা কেবল এই জায়গাটুকুরই নিজস্ব- এই বাতাবরণকে কখনোই সুস্থ বা স্বর্গীয় বলা চলে না। মরা গাছের ডাল, ফ্যাকাশে দেওয়াল আর নিস্পন্দ হ্রদের বিষাক্ত বাষ্প থেকে গড়ে উঠেছে এই মারাত্মক রহস্যময় পরিবেশ- ভোঁতা, মন্থর অনির্দেশ্য এবং সীসার মতো ভারি।

এইসব কাল্পনিক স্বপ্ন থেকে উদ্ধার পাবার জন্য মন থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। সত্যিকারের যে প্রাসাদটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটাকেই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। প্রাসাদটার প্রধান বৈশিষ্ট্য, এটাকে দেখলে মনে হয় যেন প্রাচীন স্থাপত্যের বিরাট এক নিদর্শন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান একে বিবর্ণ করে তুলেছে। সমস্ত বাইরেটা জুড়ে ছত্রাকের বিস্তার। মাকড়সার জালের মতো তা ঘরের ছাদ থেকে যেন ঝুলে রয়েছে। এগুলো কিন্তু কোথাও প্রাসাদকে ধ্বংস করে ফেলেনি। আসলে প্রাসাদটা কোনোখানেই ভেঙে পড়েনি। প্রতিটি পাথর ধরে দেখতে গেলে সেগুলোর প্রত্যেকটার অবস্থাই সঙ্গীন কিন্তু বাইরেটা অটুট- সত্যিকারের অসংগতি এইটুকুই। দেখে মনে হয় যেন বিরাট একটা কাঠের কাজ দীর্ঘদিন ধরে পচছে, অথচ বাইরে থেকে তা নিশ্চিহ্ন করে দেবার মতো বড়ো কোনো ধাক্কা আসেনি। সমস্ত প্রাসাদের এই ধ্বংসোন্মুখ পরিণতির আভাসমাত্র পাওয়া যায়, চোখে ধ্বংসের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্য প্রায় অদৃশ্য একটি সূ² চিড় চোখে পড়তে পারে- সেটা প্রাসাদের ছাদ থেকে দেওয়ালের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে নিচে, এবং শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গিয়েছে হ্রদের কালো জলের মধ্যে।

সবকিছু ভালোভাবে দেখে হ্রদের ওপরে ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে আমি প্রাসাদের দরজায় এসে পৌঁছলাম। একটি চাকর অপেক্ষা করছিল, সে আমার ঘোড়া নিয়ে গেল- আমি প্রবেশ করলাম বিরাট খিলান দেওয়া বারান্দায়। আর একটি ভৃত্য নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে নিয়ে চলল আমাকে। নির্বাক স্তব্ধতায় একের পর এক অন্ধকার জটিল অলিগলি পেরিয়ে সে আমায় হাজির করলো তার প্রভুর স্টুডিওর সামনে। যে রাস্তা দিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হলো তাতে যেসব জিনিস চোখে পড়ল- কেমন করে জানি না, আমার সেই আগেকার আবেগ-অনুভূতিই তাতে প্রবলতর হয়ে উঠল। আমি হাঁটবার সময় যেসব জিনিস দেখেছিলাম- ছাদের অদ্ভুত বক্রতা, দেওয়ালের ওপর মলিন কাপড়ের আচ্ছাদন, আবলুশ কাঠের মতো কালো মেঝে, এমন কি কুলমর্যাদাসূচক অস্ত্রশস্ত্র আর শিকারের নিদর্শন, যেগুলো আমার পায়ের শব্দেই কেঁপে উঠেছিল- এ সমস্তই খুব শিশুকাল থেকেই আমার পরিচিত। এসব আমার মনে কেন যে, সব অদ্ভুত চিন্তা আনছে সেটাই আশ্চর্যের। একজায়গায় সিঁড়িতে দেখা হলো এই পরিবারের চিকিৎসকের সঙ্গে। তার মুখের ভাবে যেন একটা নীচ ধূর্ততা এবং জটিলতা মাখানো রয়েছে বলে আমার মনে হলো। আমার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তিনি একটু অস্থির হয়ে পড়লেন, তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ভৃত্যটি এবার একটা দরজা হাট করে খুলে দিল এবং তার প্রভুর উপস্থিতি আমাকে জানিয়ে দেয়।

দেখলাম যে ঘরে আমি এসে পড়েছি সেটা বেশ উঁচু আর বিরাট। ছোটো ছোটো লম্বা, ছুঁচলো জানালাগুলো ওকগাছের তৈরি মেঝে থেকে এত উপরে উঠে গিয়েছে যে ঘরের তলা থেকে তাদের দূরত্ব বোঝাই শক্ত। রক্তাভ আলোর আবছা রেখা ছড়িয়ে পড়ছে জানলার কাচের শার্সি দিয়ে এবং তাতে ঘরের সামনের জিনিসগুলোই মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘরের আনাচে কানাচে কিংবা ছাদের ঢেউ খেলানো অংশে লক্ষ্য করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। মোটামুটি পর্দা ঝুলছে দেওয়ালে। ঘরের আসবাবপত্র প্রচুর হলেও এত কিম্ভূতকিমাকার আর ছেঁড়াখোঁড়া যে দেখলে অস্বস্তিই লাগে। বেশ কিছু বইপত্র আর বাজনার সরঞ্জাম মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু তাতেও দৃশপট স্বস্তিকর হয়ে ওঠেনি। আমার নিঃশ্বাসে যেন এক চাপা দুঃখই আমি অনুভব করলাম। - এক গভীর ঘন বিষাদ ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র, যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই।

যে সোফায় আশার টান-টান হয়ে শুয়েছিল আমাকে আসতে দেখেই তা থেকে সে উঠে পড়ল এবং এমন এক উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমাকে গ্রহণ করল যার মধ্যে অনেক কিছুই লুকিয়ে ছিল। প্রথমে আমার মনে হলো এ যেন আন্তরিকতা দেখাবার একটা আতিশয্য- একজন ক্লান্ত মানুষের কষ্টকৃত প্রয়াস। অবশ্য তার চোখমুখের চেহারা চকিতে একবার দেখে নিয়েই তার পূর্ণ আন্তরিকতা সম্মন্ধে আমি নিঃসন্দেহ হলাম। আমরা বসলাম। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুটা করুণা আর কিছুটা বেদনা নিয়ে আমি তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। সত্যি, রডরিক আশার যেমন পালটে গেছে- কোনো মানুষ এত অল্প সময়ের মধ্যে এতখানি পালটায় না। আমার সামনে এমন একজন বসে আছে, ছেলেবেলায় যে ছিল আমার খেলার সাথি- একথা বেশ কষ্ট করেই আমার মনে করতে হচ্ছিল। তবু তার মুখ-চোখের চেহারা সবসময়ই ছিল বেশ দেখবার মতো। ফ্যাকাশে গায়ের রং, বড়ো বড়ো ঢলঢলে চোখ অথচ দারুণ ঝকমকে। ঠোঁটদুটো পাতলা, বিবর্ণ- কিন্তু কারো দেখা যায় না এমন চমৎকার বেঁকানো। ছিমছাম হিব্রæজাতীয় নাক, নাকের গঠনের তুলনায় বড়ো বড়ো নাসারন্ধ্র। চমৎকার একটি চিবুক, অথচ তাতে যেন নৈতিক উদাসীনতার অভাব মাখানো। চুলগুলো মাকড়সার জালের মতো নরম আর সরু। এইসব বৈশিষ্ট্য এবং কপালে রগের দুপাশের অস্বাভাবিক বিস্তৃতি এমন একটা মুখের গঠন তৈরি করেছে যা চট করে ভোলা মুশকিল। এখন সেইসব বৈশিষ্ট্যের এমন অদ্ভুত বিকৃতি দেখলাম এবং তার যেসব হাবভাবের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম তার এত অভাব চোখে পড়ল যে আমার সন্দেহ হলো, আমি কার সঙ্গে কথা বলছি ! বিশেষ করে তার মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে চামড়া আর অলৌকিক ঝকঝকে দুটো চোখ দেখে আমি ভীত ও বিস্মিত হয়েছিলাম। তার মসৃণ চুলও অস্বাভাবিক রকম বেড়ে উঠেছিল কেমন যেন উদ্দামভাবে আর সেগুলো মুখে চোখে পড়ছিল না বলে ভেসে বেড়াচ্ছিল বলাই ভালো হবে বোধহয়। এসব ভাবভঙ্গির কোনোটাই মানবিক বলে যেন ভাবতে পারছিলাম না।

আমার বন্ধুর শারীরিক ভাষায় একটা প্রবল অসঙ্গতিই যেন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অবশ্য কয়েক মুহূর্ত পরে এ কথাও আমি বুঝতে পারলাম আমার মনের এই আতঙ্ক জেগে উঠছে আসলে প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনা থেকে- ভয়জনিত চিত্ত বিক্ষেপ চাপা দেবার যে দুর্বল ও ব্যর্থ চেষ্টা আমি করে আসছি, এ তারই ফল। এই ধরনের একটা কিছুর জন্যে আমি নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে ছিলাম। তার চিঠি, বাল্যকালের কিছু অদ্ভুত স্মৃতি, তার দৈহিক আকৃতি এবং মেজাজের পরিবর্তন দেখে আমার সিদ্ধান্ত- সব কিছুই এর জন্য দায়ী। তার আচরণ কখনো বেশ হাসিখুশি আবার কখনো বিষণœ। রডরিকের কণ্ঠস্বরও ভীষণভাবে পালটে যাচ্ছিল। কখনো সিদ্ধান্তহীন ভীরুতায় চঞ্চল, কখনো আবার প্রাণবন্ত, উচ্ছল- সেই হঠাৎ কথা বলা, ভারি, অচঞ্চল, গম্ভীর উচ্চারণ- সেই সীসার মতো ওজনদার, আত্মসংযত, সঠিক স্বরগ্রাম ওঠানামার খড়খড়ে কণ্ঠ। এরকম গলা শোনা যায় মত্ত-মাতাল কিংবা প্রচণ্ড আফিংখোরদের কথাবার্তায়- যখন তারা নেশার একেবারে চরম উত্তেজনাকর অবস্থায় থাকে।

রডরিকের কথায় আমি বাস্তবজগতে ফিরে এলাম। সে আমাকে বোঝাচ্ছিল আমায় এখানে ডেকে পাঠাবার উদ্দেশ্য কী, আমাকে দেখবার জন্য সে কী পরিমাণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল এবং আমার কাছে কী ধরনের সান্ত¡না সে আশা করে। বেশ খানিকক্ষণ পরে নিজের অসুখটা কী ধরনের সে মনে করে শেষ পর্যন্ত সে কথায় এলো। রডরিক বললে, এটা নাকি তার শারীরিক ও মানসিক বংশগত রোগ- কুলপরম্পরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার থেকেই এটার উৎপত্তি। এর কারণটা খুঁজে তার প্রতিকার করার চেষ্টা সে করেছে, কিন্তু পারেনি। এটা যে একটা ¯œায়বিক দৌর্বল্য এবং খুব শিগ্গিরই তা কেটে যাবে, এ কথাও সে জানাল। এই দুর্বলতা ডেকে আনে কিছু অলৌকিক সংবেদন।

সে সবিস্তারেই তার মানসিক ও শারীরিক সমস্যার কথা বলল, আর তার মধ্যে কিছু জিনিস আমাকে উৎসাহিত করলেও আমাকে কেমন যেন হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল- যদিও যেভাবে যেসব শব্দ ব্যবহার করে সেসব কথা সে বলেছিল তাতে ব্যাপারটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল। সে খুব বেশি পীড়িত হয়ে পড়েছিল অনুভূতির এক অসুস্থ তীক্ষণতা নিয়ে। সবচেয়ে বিস্বাদ খাবার ছাড়া আর কিছুই তার সহ্য হতো না। বিশেষ একধরনের জামা প্যান্টই সে পরতে পারত। সমস্ত ফুলের গন্ধই তার কাছে পীড়াদায়ক। খুব মৃদু আলোও তার চোখে সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়ত। কেবলমাত্র তারের বাদ্যযন্ত্র থেকে কিছু অদ্ভুত শব্দ ছাড়া আর সব শব্দই তার কাছে ভীতিপ্রদ।

এক অপরিজ্ঞাত আতঙ্কের সঙ্গে আমি আবিষ্কার করলাম আমার বন্ধুটি এইসব অনুভূতির দাস হয়ে রয়েছে।

‘আমি শেষ হয়ে যাবো’- সে একনাগাড়ে বলেই চলল, ‘আমার এই শোচনীয় মূর্খতার জন্যেই আমি মারা পড়ব। আর কোনো কারণে নয়, কেবল এইজন্যে আমার সর্বনাশ হবে। আমি ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো ভেবে আঁৎকে উঠি, না ঘটনাগুলোর জন্যে নয়- তাদের প্রতিক্রিয়ার জন্য। যেকোনো ঘটনা, একেবারে তুচ্ছ মামুলি ঘটনা হলেও, তার কথা ভেবে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। আমার এই অসহ্য মানসিক উত্তেজনায় তারা আতঙ্ক ছড়ায়। বিপদ সম্মন্ধে আমার যে ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা আছে এমন নয়, কিন্তু এর শেষমেশ ফল যেটা- অর্থাৎ শঙ্কা, সেটাতেই আমার ঘৃণা। এই মানসিক দুর্বলতায়- এই রকম শোচনীয় অবস্থায়, আমার মনে হয় আজ না হয় কাল এই অযৌক্তিক অলৌকিক ভয়ের জন্যই আমার চিন্তাশক্তিও শেষ হয়ে যাবে, জীবনটাও শেষ হবে।’

বেশ খানিকটা পরে বন্ধুর কাটাছেঁড়া কথায় আর সন্দিগ্ধ ইঙ্গিতে তার মানসিক অবস্থার একটা প্রধান দিক আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে যেখানে বাস করছে সেখানকার সম্বন্ধে একটা প্রচণ্ড কুসংস্কারমূলক ধারণার মধ্যে সে বন্ধ হয়ে আছে। এই ছায়া ছায়া নিতান্ত অস্পষ্ট ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টাও সে এতদিনে করেনি, কিংবা করবার মতো ঝুঁকি নেয়নি। ব্যাপারটা যে কি এখন আর নতুন করে বলবার দরকার নেই, তবে দীর্ঘকাল এই প্রাসাদে বসবাসের কষ্ট সহ্য করবার জন্য তার চেতনায় এই অশুভ চিন্তা প্রভাব বিস্তার করেছে। ফ্যাকাশে দেওয়াল ও মিনার, এঁদো পার্বত্য হ্রদ মিলিয়ে সমস্ত প্রাসাদের যা চেহারা সেটা তার অস্তিত্বের সার্থকতাকেই যেন বিপন্ন করে তুলেছিল।

অবশ্য বেশ খানিকটা সঙ্কোচ নিয়ে একসময় সে স্বীকার করলো যে তার মনের এই অদ্ভুত নৈরাশ্যের মূল উৎস কোথায়, সে সম্মন্ধে একটা স্বাভাবিক আর যুক্তিসঙ্গত কথা সে বলতে পারে। এটাই বোধহয় তার দীর্ঘদিনের এই কঠিন অসুখের কারণ। এই বেড়ে ওঠা অবসাদের কারণ তার অত্যন্ত স্নেহের এক বোন- সুদীর্ঘ দিন ধরে তার একমাত্র সঙ্গী- এ পৃথিবীতে তার শেষ এবং একমাত্র আত্মীয়। ‘তার মৃত্যুর পর এই সুপ্রাচীন আশার বংশে আমিই থাকবো একমাত্র জীবিত বংশধর’- কথাটা বলবার সময় রডরিকের মুখে চোখে যে বিষণ্নতা ফুটে উঠল, জীবনে তা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

যখন সে কথা বলছিল, লেডি ম্যাডেলিন [নিজের বোনের এই নামই সে বলেছিল] তখন নিঃশব্দে একবার সেই ঘরে দূরের এক অংশ দিয়ে রডরিকের বোন হেঁটে চলে যায়। আমার উপস্থিতি একেবারেই খেয়াল না করে সে সরে গেল সেখান থেকে। তাকে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম- কিছুটা যে ভয়ও পাইনি এমন নয়, যদিও এই গা ছমছমানি ভাবটার কোনো যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহিলাটি ফিরে যাবার সময় সেদিকে চোখ পড়তে আমি যেন কেমন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। তার চলে যাওয়ার খানিক পরে যখন একটা দরজা বন্ধ হলো, তখন আমার দৃষ্টি স্বভাবতই ছিটকে এলো তার ভাইয়ের দিকে,- তার হাবভাব কেমন হয় দেখবার জন্য। কিন্তু রডরিক তখন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে ছিল এবং আমি শুধু এইটুকুই দেখতে পাচ্ছিলাম যে, মৃতের আঙুলের মতো ফ্যাকাশে বিবর্ণ আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে আবেগের অশ্রু।

লেডি ম্যাডেলিনের হরেক রকমের জটিল অসুখ দীর্ঘদিন যাবৎ তার চিকিৎসকদের বিচারবুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে আসছে। নানা রকমের অস্বাভাবিক রোগলক্ষণ ধরা পড়েছিল, তার মধ্যে- কেমন একটা অদ্ভুত উদাসীনতা, ব্যক্তিচেতনার ক্রমশ অনুপস্থিতি, ক্ষণে ক্ষণে কিরকম ভালোবাসার বোধ, যেন আংশিক পক্ষাঘাতের রোগী। এ পর্যন্ত সে অবশ্য তার অসুস্থতার বিরুদ্ধে ভালোভাবেই লড়াই করে এসেছে- কখনোই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েনি। কিন্তু যেদিন আমি গিয়ে পৌঁছলাম সেই রাত্রেই নাকি সে তার মারাত্মক অসুখের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। একথাটা দারুণ উত্তেজিতভাবে লেডি ম্যারেলিনের ভাই রডরিক সেই রাতে আমায় বলেছিল। সেই যে তাকে আমি দেখলাম, সেই আমার শেষ দেখা- জীবিত অবস্থায় তাকে আর কখনো আমি দেখতে পাইনি।

এরপর বেশ কিছুদিন আশার বা আমি কেউই তার নাম উচ্চারণ করিনি। এ সময়টা আমি আমার বন্ধুর মনের বিষণ্নতা। কি করে কাটানো যায় সেই চেষ্টাতেই নিদারুণ ব্যস্ত ছিলাম। আমরা একসঙ্গেই ছবি আঁকতাম, বই পড়তাম। অথবা, তার মায়াময় গিটার যেন কথা বলত- আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। এইভাবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে হতে তার মনের প্রকাশ অনাবৃত হয়ে এলো আমার কাছে কিন্তু আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করলাম এই মনকে হাসিখুশি রাখা অসম্ভব ব্যাপার। তার মনে অন্ধকার জগতের বিষাদ এমন দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে গেছে- তার দুঃখের আভা বারবার রডরিকের চোখে মুখে ফুটে উঠছে।

এইভাবে আশার প্রাসাদের মনিবের সঙ্গে আমি যতবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি, তার স্মৃতি চিরদিন আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তবুও যদি জিজ্ঞাসা করা যায় ঠিক কী ধরনের আলোচনা আমাদের মধ্যে হতো অথবা ঠিক কীভাবে সে আমাকে বেঁধে রেখেছিল বা কোনদিকে আমায় চালিত করতে চাইত- আমি ঠিক তা বুঝিয়ে বলতে পারবো না। অনেক উত্তেজিত এবং প্রাণবন্ত আলোচনাই শেষ পর্যন্ত নৈরাশ্যের বিষাক্ত বাষ্প ছড়িয়ে শেষ হতো। তার উন্নতমানের মৃত্যুকালীন স্ত্রোত্র উচ্চারণ চিরকাল আমার কানে বাজবে।

অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ভন ওয়েবারের সাম্প্রতিকতম নাচের বাজনা যে বন্য উদ্দামতায় বিকৃত ও বাড়াবাড়ি করে সে বাজাত- সেটাও আমার এক বিষণ্ন স্মৃতি। তার চিত্রকলায় যেন বিরাট কল্পনা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠত- দিনে দিনে তা বেড়ে উঠে ছবিগুলো এমন শূন্যতাবোধক হয়ে দাঁড়াল যে, আমি তা দেখে শিহরিত হয়ে উঠতাম। অবশ্য কেন যে আমার এমন হতো তা ঠিক বলতে পারব না। ছবিগুলো আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভাসে। সেসব ছবির বিষয়বস্তুর খুব অল্পই ভাষায় প্রকাশ করা যায়। নিপাট সারল্যে, ডিজাইনের অনাবৃত ভঙ্গিতে ছবিগুলো সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কোনো একটা চিন্তাকে যদি ছবির মাধ্যমে কোনো মানুষ ফোটাতে সমর্থ হয়, তবে সে মানুষটি হলো রডরিক আশার। যে পরিবেশে আমি তখন ছিলাম তাতে অন্তত আমার মনে হতো অর্ধ উন্মাদ এই লোকটি নিজস্ব বিমূর্ত চিন্তাই তার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চাইত। অসহ্য দুঃখের তীব্রতা তাতে যেভাবে ফুটে উঠত, তার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা খুঁজে পাওয়াই শক্ত।

আমার বন্ধুর এইসব অলৌকিক ধারণা প্রকাশে যে-সব ছবি আঁকা হয়েছিল তার মধ্যে একটা অন্তত ততখানি বিমূর্ত ছিল না, ফলে দুর্বল ভাষায় ও আবছাভাবে তা বুঝিয়ে বলা যেতে পারে। একটা মাঝারি আকারের ছবিতে দেখানো হয়েছিল বিরাট আয়তকার এক সুড়ঙ্গপথের ভেতর দিকটা। অত্যন্ত নিচু দেওয়াল, মসৃণ, সাদা- ভেতরে কোনো বাধা বা অন্য কোনো নকশা ছিল না- নিরেট শূন্যতা। ছবিতে কিছু আনুষঙ্গিক সূত্র এমনভাবে ছিল যাতে এরকম একটা ধারণা হয় যে খননকার্য চলেছে ভূপৃষ্ঠের অনেকখানি গভীরে। কোথাও কোনো ফাঁকফোকর নেই, আলোর শিখা নেই- অন্য কোনোরকম কৃত্রিম আলোর উৎসও চোখে পড়ে না। অথচ তীব্র আলোকরশ্মির বন্যাতে সমস্ত জিনিসটা এমনভাবে ভাসছে যাতে গোটা ছবিটাই এক অশরীরী ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।

আমি আগেই বলেছি, তার শ্রবণেন্দ্রিয় এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে তারের বাদ্যযন্ত্রের কিছু অদ্ভুত আওয়াজ ছাড়া সব শব্দই তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। এই সীমাবদ্ধতার জন্যেই সম্ভবত সে গিটারে মনঃসংযোগ করেছিল এবং ওই ধরনের অলৌকিক বাজনা উদ্দাম হয়ে বাজাতো। কিন্তু কেন সে অতো অসংযত হয়ে উঠত তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। সেই সুর এবং তার বাণীও বোধহয় রডরিকের বন্য অপ্রকৃতিস্থ আবেগসিক্ত কল্পনারই প্রকাশ- কারণ বাজনার মুখে সে বেশ কিছু ছড়াও বলে যেত। যে মানসিক যন্ত্রণা হিমবাহের ¯্রােতের মতো সে সর্বদা অনুভব করে সেটা কাটাবার জন্যেই বোধহয় মাঝে মাঝে কৃত্রিমভাবে সে নিজের উত্তেজনা প্রকাশ করতে চাইত। যে-সব পদ্য সে গানের সঙ্গে বলে যেত তার মধ্যে একটা সহজেই আমি মনে করতে পারি। এই গানটা গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন অনিবার্যভাবেই তার প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, কারণ, গানের কথার মধ্যে যে অতীন্দ্রিয় অর্থ সাজানো ছিল তাতে আমার মনে হয়েছিল এই প্রথম যেন আমি বুঝতে পেরেছি কেন আশার এই মনোবিকারে ভুগছে, কেন সে অলৌকিক ভাবনার সাগরে যুক্তি-বিচার বিসর্জন দিয়েছে। সেই গানটির নাম ছিল - ‘স্মৃতিমধুর প্রাসাদ।’ সেটা একেবারে সঠিক না হলেও অনেকটা এই রকম :

আমাদের সেই সবুজ - সবুজ উপত্যকা

সেখানে থাকত কেবল স্বর্গীয় দেবদূত,

একদা এক মনোরম বিশাল প্রাসাদ-

ঝকঝকে প্রাসাদ - উঁকি মারলো সেখানে।

মনন নামক স¤্রাটের সা¤্রাজ্যে-

সেখানেই সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।

মহান দেবদূতেরা পাখনা মেলেও

এর অর্ধেক সুন্দর কিছু পারে না গড়তে।

ঝকঝকে মুক্তো আর রক্তের মতো চুনি

সাজানো ছিল তার প্রবেশ দ্বারে,

সেখান দিয়ে যেন প্রবাহিত হতো

আলোকিত করে উঠত-

একগুচ্ছ প্রতিধ্বনি, এই ছিল যাদের কাজ

কেবল গানে মাতোয়ারা হওয়া,

সুন্দর, সুরেলা গলায় বন্দনা করা

তাদের রাজার শৌর্য ও জ্ঞানের।


এমনি দিনে আসে অশুভ,

দুঃখের পোশাকে মুখ ঢেকে,

সম্রাটের সাম্রাজ্য হয় লুট

তাদের স্পর্ধিত আক্রমণে।

[শোকবিহ্বল হও, আগামী দিনের প্রভাতরশ্মি 

আর পড়বেনা কখনো সেই পরিত্যক্তের ওপর।]

তার সেই সাম্রাজ্যের মহিমা আজ 

লজ্জায় মুছে গেছে, আছে শুধু-

বিষণ্ন স্মৃতিতে উজ্জ্বল সেই গাথা,

পুরানো দিনের মর্মর ফলকে।


সেই উপত্যকায় এখনো যারা যায়

রক্তাভ গবাক্ষপথে তারা দেখে

বিশাল দানবেরা ঘুরে বেড়ায় দাপটে

ছন্নছাড়া বেসুরো বেতালে ;

অতঃপর খরস্রোতা ভীষণ নদীর মতো, 

বিবর্ণ দ্বারপথ দিয়ে-

গোপন বিশাল দল সুচির কালের মতো

বার হয়ে আসে।

বীভৎস অট্টহাস্য জাগে-

শুচিস্মিত হাসি আর নেই।


আমার খুব ভালো করেই মনে আছে- এই গানটি থেকে যে সংকেত আমি পেয়েছিলাম, তা থেকে চিন্তার রাশি আমার মাথায় উদিত হয়েছিল। এ থেকেই রডরিকের একটা মন্তব্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার সেই অভিমত যে আমার মনে দোলা দিয়েছিল তা শুধু অভিনব বলে নয়, সেটাকে যত যথার্থ বলে সে বিশ্বাস করে তার জন্যেই। সাদামাটা কথায় তার বক্তব্য : উদ্ভিদের চেতনা আছে। কিন্তু তার বিশৃঙ্খল কল্পনায় এই ভাবনা আরো দুর্দান্ত আকার পেয়েছিল এবং চেতনার ব্যাপারটা জড় বস্তুর জগতেও ক্ষেত্রবিশেষে সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছিল। বিষয়টি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যের বাইরে। তার এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত ছিল পিতৃপুরুষের বাসভূমি- ধূসর পাথরের অতিকায় খণ্ড-বিখণ্ড এবং আশপাশের পরিবেশ। সে কল্পনা করতো, চেতনার ব্যাপারটা এখানেও প্রযোজ্য- রুক্ষ পাথরগুলোর মধ্যেও চেতনা আছে। যে বিশেষ সজ্জা তারা দীর্ঘদিন সহ্য করে আসছে, যে ছত্রাকগুলো তাদের ওপর জন্মেছে, যে-সব মৃত গাছ চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের সক্কলের যে প্রতিফলন পড়ছে পার্বত্যহ্রদে সব মিলিয়েই একটা সচেতন কিছু আছে। এর প্রমাণ- মানে এই সচেতনতার প্রমাণ খুঁজে নিতে হয়, সে আমায় আরো বলেছিল : ধীরে ধীরে এই জল এবং পাথর ঘিরে যে আবহাওয়া তৈরি হয়ে উঠেছে তাতেই সচেতনা অনুভব করা যায়। এটা অনুভব করতে হয় নৈঃশব্দের মধ্যে,- তার কথায়, কিন্তু এর এক অনিবার্য এবং ভয়ঙ্কর প্রভাব কয়েক শতাব্দী ধরে নেমে এসেছে তাদের বংশে এবং বংশের ভবিতব্যও তারাই ঠিক করে দিয়েছে। তাকেও তারা পরিণত করেছে এই মানুষে, সে এখন যা। এই ধরনের কথাবার্তায় কোনো মন্তব্য করা যায় না, আমিও করবো না।

এরপর আসি বইয়ের কথায়। অথর্বদের মানসিক চর্চা বজায় রাখতে বই বহুদিন ধরেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই অলৌকিক চরিত্রটির ক্ষেত্রেও তার সঠিক ভূমিকা ছিল। আমরা এইসব বই একসঙ্গে আলোচনা করতাম- গ্রেসেট-এর ‘ভীরবার এ শরত্রেউস’, মেকিয়াভেলির ‘বেলফোর’, সুইভেনবর্গের ‘দ্য হেভেন অ্যান্ড হেল’, হলবার্গের ‘সাবটেরিনিয়ান ভয়াজ অব নিকোলাস ক্লিম’, রবার্ট ফ্লাড-এর ‘কিরোম্যান্সি’, টিয়েকের ‘দ্য জার্নি ইনটু দ্য ব্লু ডিসট্যান্স’ এবং ক্যাম্প্যানেলার ‘সিটি অব দ্য সান।’ একটা বেশ প্রিয় বই ছিল ‘ডিরেকটোরিয়াম ইনকুইজিটোরাম-এর ছোটো সংস্করণ, লেখক ডমিনিকান অয়মারিক দ্য গিরোনে। এছাড়া ছিল ‘পমপেনিয়াস মেলা’-র কয়েকটি অনুচ্ছেদ যে আফ্রিকা ও মিশরের আদিম অধিবাসীদের সম্বন্ধে লেখা হয়েছে। এটা নিয়ে আশার ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেন স্বপ্নের জগতে ডুবে থাকত। তার প্রধান আনন্দ অবশ্য ছিল বিস্মৃত এক গির্জা সম্বন্ধে একটি দুষ্প্রাপ্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক বই ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখা, এটার নাম : ‘ভিজিলিএ মরতুয়োরাম কোরাম এফ্লেসিএ ম্যাগুনতিনাত্র।’

এই গ্রন্থের আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ আর আমার এই বায়ুরোগগ্রস্ত বন্ধুর ওপর তার প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা চিন্তা না করে আমি পারিনি। এমনি একটা দিনে একেবারে হঠাৎই লেডি ম্যাডেলিনের মৃত্যুসংবাদ আমায় দিয়ে আশার তার মনোগত অভিপ্রায় আমাকে জানাল। তাকে কবরস্থ করার আগে তার মৃতদেহ এই প্রাসাদের দেওয়ালে যে অসংখ্য প্রকোষ্ঠ আছে, তার একটায় দিন পনেরো রেখে দেওয়াই তার ইচ্ছে। এজন্যে যে-কারণ সে দেখিয়েছিল, আমার মনে হয়েছিল তা নিয়ে ঝগড়াঝাটি বা তর্কাতর্কি করার কোনো স্বাধীনতাই আমার নেই। সে আমায় যেরকমটি বললো, তাতে তার এধরনের ইচ্ছের কারণ হচ্ছে, বোনের অসুখটা ছিল অদ্ভুত রকমের- সুতরাং চিকিৎসকেরা কিছু কৌতূহলী পরীক্ষা চালাতে পারবেন তাহলে। তাছাড়া তাদের পরিবারের কবরস্থান একেবারে নির্জন আর খোলামেলা জায়গায়, সেটাও একটা সমস্যা। একথা অস্বীকার করবো না যে, এ বাড়িতে আসার দিনটি সিঁড়িতে যে অশুভ চিহ্ন মাখানো মুখখানা আমি দেখেছিলাম, সেই কারণেই রডরিকের কোনো কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদের ইচ্ছে আমার ছিল না। তাছাড়া যাই হোক, এ ব্যবস্থা করলে দোষের কিছু নেই- এই ধরনের সাবধানতাকে অস্বাভাবিকও বলা চলে না।

আশারের অনুরোধে আমি নিজেও অস্থায়ী কবর দেবার ব্যাপারে সাহায্য করলাম। দেহটা কফিনের মধ্যে পুরে যেখানে সেটা থাকবে, আমরা শুধু দুজনেই সেখানে সেটাকে নিয়ে এলাম। যে প্রকোষ্ঠে আমরা লাশসমেত কফিনটা রাখলাম সেটা এতদিন ধরে বন্ধ রয়েছে যে, ওই প্রকোষ্ঠের গুরুভার শ্বাসরোধকারী আবহাওয়ায় আমরা আলো থাকা সত্তে¡ও বিশেষ কিছু স্যাঁতসেঁতে ঘর, আলো আসার কোনো রাস্তাই নেই। বেশ গভীর ঘর আর আমার শোবার জন্যে যে কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, বাড়ির সেই অংশের ঠিক নিচে মনে হয় অনেক আগে সামন্ততান্ত্রিক যুগে এটা খুব ঘৃণ্য জঘন্য কাজেই ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীকালে এই জায়গায় রাখা হতো মারাত্মক বিস্ফোরক পাউডার বা অন্য জিনিস। কেননা এর মেঝে এবং খিলান ঢাকা পথে আমরা এখানে পৌঁছলাম- গোটাটাই তামার পাতে মোড়া। জং-ধরা পুরনো লোহার দরজাটার ক্ষেত্রেও এই সাবধানতা নেওয়া হয়েছে। প্রচণ্ড গুরুভার হওয়ার জন্যই এটা নাড়াবার সময় বিরক্তিকর ক্যাঁচক্যাঁচে একটা আওয়াজ হতো।

সেই ভীতিপ্রদ জায়গায় একটা বেদীর ওপর আমাদের সেই শোকসন্তপ্ত বোঝা নামিয়ে, আমরা একবার কফিনের ডালাটা খুললাম- তখনো ডালাটা বন্ধ করা হয়নি। কফিনের ভেতর যে শুয়ে আছে তার মুখের দিকে তাকালাম। ভাই ও বোনের মুখের মিল যে এত তীব্র হতে পারে এই প্রথম যেন আমি সেটা খেয়াল করলাম। সম্ভবত আমার চিন্তিত চোখ-মুখ দেখে, আশার ফিসফিস করে কয়েকটা কথা বলল, তাতে বোঝা গেল মৃতা বোন ম্যাডেলিন এবং সে ছিল যমজ এবং যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন অনেক ব্যাপারে তাদের বেশ সাদৃশ্য ছিল। খুব বেশিক্ষণ অবশ্য লাশটার মুখের পানে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, সেটা খুব সম্মানজনক হতো না। এই অসুস্থ মহিলাটিকে তার উত্তর-যৌবনেই তাকে বরণ করেছে কফিন- পক্ষাঘাতের মতো লক্ষণগুলোসহ সব রোগ-বালাই বিদায় নিয়েছে, তার বক্ষ এবং মুখাবয়বে নিষ্ঠুর বিদ্রুপের মতো সলজ্জ চিহ্ন এবং মুখে রয়ে গেছে একটুকরো সন্দিগ্ধ হাসি যা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস হয়ে পড়েছে। আমরা ডালা নামিয়ে তার চাবি এঁটে দিলাম। দরজা বন্ধ করে ক্লান্ত শরীরে এগিয়ে চললাম বাড়ির ওপরের অংশে ছায়ায় আলোয় ঘেরা ঘরে।

তারপর যখন কয়েক দিনের বিষণœ অধ্যায় কেটে গেছে, আমার বন্ধুর মানসিক অস্থিরতায় একটা বেশ চোখে পড়বার মতো পরিবর্তন দেখা গেল। তার সাধারণ আচার-আচরণ যেন উবে গেল। অস্বাভাবিকতার এক চূড়ান্ত প্রকাশ- উদ্দেশ্যহীনভাবে দ্রুত অসংবদ্ধ পায়ে সে ঘুরে বেড়ায় এ ঘর থেকে সে ঘর। তার মুখের ফ্যাকাশে ভাব যেন আরো অলৌকিক হয়ে উঠেছে, কিন্তু চোখর সেই ঝকঝকে ভাবটা একেবারে মুছে গেছে। মাঝে মাঝে তার যে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা শোনা যেত সেটা আর এখন শোনা যায় না, বরং তার বদলে যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে- এইভাবে তার গলা কাঁপতে থাকে। এরকম এক একটা সময় আসত যখন মনে হতো তার সদা উত্তেজিত চিত্ত যেন কোনো ভয়ঙ্কর গোপন তথ্য জানবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সত্য ফাঁস করে দেবার উপযুক্ত সাহস যেন সে সঞ্চয় করেছে। আবার কখনো-বা আমি মনে করতাম এ সবই পাগলের বিচিত্র খেয়াল, কারণ, আমি দেখতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে শূন্যের দিকে অখÐ মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে আছে- যেন কোনো কাল্পনিক শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে তার এই ভয়ঙ্কর অবস্থা আমাকেও খানিকটা প্রভাবিত করবে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, তার সেই বিচিত্র অথচ আকর্ষণীয় সংস্কারগুলো এক আদিম বন্যতায় ধীরে ধীরে অনিবার্য গতি থাবা বসাতে এগিয়ে আসছে আমার সত্তায়।

এর শক্তি যে কী বিশাল সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম লেডি ম্যাডেলিনকে তার অস্থায়ী কবরে রাখবার সাত কি আটদিন পরের একটা রাতে বিছানায় শুতে গিয়ে। রাত একটু বেশিই হয়েছিল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়িয়ে যায়- অথচ ঘুম আসতেই চায় না- গা ছমছম ভাবটা আমি যুক্তি দিয়ে তাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। নিজেকে বুঝালাম, মনে যত রকম অদ্ভুত ভৌতিক ভাবনা আসছে তার সমস্ত কিছু না হলেও খানিকটা দুশ্চিন্তার জন্য দায়ী ঘরের এই রদ্দি আসবাবপত্রগুলো। বিশেষ করে এই বিদঘুটে রংচটা পর্দাগুলো- বাইরে যে ঝড় উঠেছে তার জন্যে এগুলো দেয়ালে বিশ্রীভাবে এদিক সেদিক দুলতে শুরু করেছে, এমন কি বিছানাটা পর্যন্ত নষ্ট করে দিতে চাইছে, সেগুলোই এর প্রধান কারণ। কিন্তু আমার এই প্রচেষ্টায় বিশেষ লাভ হলো না। একটা অদম্য কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমার শরীরে, আর কিছুক্ষণ পরেই বুকের মধ্যে যেন এক নিশিতে পাওয়া মানুষ আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে আমায় সাবধান করতে থাকল। প্রচণ্ড প্রয়াসে, প্রায় নিজের সঙ্গে লড়াই করে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলবার মানসে আমি বালিশ থেকে মাথা তুললাম। ঘরের নিñিদ্র অন্ধকারের মধ্যে আমি চেয়ে রইলাম। জানি না কেন, হয়ত সহজাত প্রবৃত্তি বলেই হবে- আমি কান খাড়া করতেই শুনতে পেলাম দীর্ঘ সময় বাদে বাদে ঝড়ের তাÐব কমে গেলে ভেসে আসছে নিচু সুরে একটা অদ্ভুত শব্দ। ভীতিকর এক অনুভূতি আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলল ! সম্পূর্ণ যুক্তিহীন- অথচ আমি সহ্যও করতে পারছি না !

ছুঁড়ে ফেলে দিলাম গায়ের চাদর। বেশ বুঝতে পারছিলাম, এই রাতটা আমার আর একটুও ঘুমনো উচিত নয়। ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে নিজের এই শোচনীয় অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম।

কয়েক পাক মাত্র ঘুরেছি, এমন সময় ঘরের পাশের সিঁড়িতে হালকা পায়ের আওয়াজ আমার কানে এল। আমি বুঝতে পারলাম এটা আশারেরই পদশব্দ। পরমুহূর্তেই দরজায় মৃদু হাতের চাপড় শুনতে পেলাম।

রডরিক আমার ঘরে ঢুকলো, হাতে একটা বাতি। তার মুখ-চোখ মড়া-মানুষের মতো ফ্যাকাশে- তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চোখের তারায় একটা উন্মাদের ন্যায় উল্লাস। সব মিলিয়ে একটা হিস্টেরিয়া রোগীর মতোই চেহারা। তার হাবভাব আমার মোটেই ভালো লাগল না, কিন্তু এতক্ষণ একাকিত্বের যে যন্ত্রণা সহ্য করেছি তার চেয়ে যেকোনো সঙ্গই এখন বেশি কাম্য, তাই যেন আমি স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে তাকে আমন্ত্রণ জানালাম।

‘তাহলে তুমি ওটা দেখতে পাওনি ?’ কেমন হঠাৎই যেন বলে উঠল সে। চারপাশটা ভালো করে একবার তাকিয়ে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘সত্যিই তুমি ওটা দেখোনি তাহলে ? ঠিক আছে, দাঁড়াও- তুমিও দেখতে পাবে।’ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাতিটাকে আড়াল করে সে ছুটে গেল একটা জানলার কাছে, প্রবল ঝড় উপেক্ষা করে সে খুলে ফেলল জানলার কপাট।

উন্মত্ত বাতাস দুর্দান্ত আক্রোশে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে- প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের !

ভয়ঙ্করতা আর সৌন্দর্যে মেশানো বন্যতায় সেটা ছিল একটা দারুণ রাত্রি। বিক্ষুব্ধ অথচ সুন্দর ! ধারে কাছেই নিশ্চয়ই এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় ফুঁসে উঠেছিল। বারবারই দারুণ রোষে বাতাসের দিক পরিবর্তন হচ্ছিল। প্রচণ্ড ঘন কালো মেঘ এমনভাবে ঝুলছিল যেন তা চেপে ধরেছিল প্রাসাদের মিনার। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, জীবন্ত গতিতে মেঘগুলো একে অন্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে- কিন্তু দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না। আশ্চর্য এই যে, এত ঘন মেঘ থাকা সত্তে¡ও আমরা সেই মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম না- অথচ আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই, এমনকি একটিবারের জন্যে বিদ্যুতের চমকও দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু মেঘের নিচে ঘন বাষ্পের আচ্ছাদন এবং আশেপাশের সমস্ত বস্তু এক হালকা, উজ্জ্বল, অস্বাভাবিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। প্রাসাদের চারপাশে যে গ্যাসের আস্তরণ ঝুলছে- বাড়িটাকে প্রায় ঘিরে রেখেছে, সেটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

‘খুলে রেখো না- জানলাটা ওইভাবে খুলে রেখো না !’ কাঁপতে কাঁপতে আশারের কাছে গেলাম। একটা হালকা ধাক্কা দিয়ে জানলা থেকে সরিয়ে একটা চেয়ারে ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যে সব ঘটনা দেখে তুমি অবাক হয়ে গেছো সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক জিনিস নয়, একটা বৈদ্যুতিক নিয়ম মাত্র। হতে পারে এটা তৈরি হয়েছে সামনের ওই হ্রদের পচা পানি থেকে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে ওঠা বাষ্প থেকে। জানলাটা বন্ধ করে দিচ্ছি- খুবই ঠান্ডা হাওয়া, শরীরের পক্ষে সাংঘাতিক- এই তো এখানে তোমার প্রিয় একটা রোমান্টিক বই আছে- আমি পড়ি তুমি শোন। এই ভয়ঙ্কর রাতটা এইভাবেই কাটানো যাক।’

যে প্রাচীন গ্রন্থটা আমি পড়বার জন্যে হাতে নিয়েছি সেটা সার লন্সলট ক্যানিং-এর লেখা ‘ম্যাড স্ট্রিট।’ আমি বলেছি এটা আশারের পছন্দের বই, সেটা অবশ্য সত্যি সত্যি বলিনি, এক বিষণœ কৌতুকেই সে কথা বলেছিলাম। কারণ, সত্যি বলতে কি, এই বৃহৎ ক্লান্তিকর এবং অমার্জিত বইয়ে এমন কিছুই নেই যা ওর মতো আধ্যাত্মিক আর বড়ো বড়ো আদর্শের খোঁজে মত্ত মানুষকে আনন্দ দিতে পারে। হাতের কাছে আসলে ওই একটা বই-ই ছিল। মনে একটা ক্ষীণ আশা পোষণ করেছিলাম যে, এই বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটি যে মানসিক উত্তেজনায় রয়েছে তা থেকে সে হয়ত রেহাই পাবে। মূর্খতার যে চূড়ান্ত নমুনা এই বইয়ে আছে, সেটা জানা সত্তে¡ও তাই পুস্তকটা টেনে নিয়েছিলাম। রডরিক প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমার পড়া শুনছিল, অথবা শোনার ভান করছিল, তাতে আমার মতলবটা খেটে গেল ভেবে আমি নিজেকেই নিজে বাহবা দিচ্ছিলাম।

আমি তখন গল্পের সুপরিচিত সেই অংশে এসে পৌঁছেছিলাম যেখানে ইথেলরেড, মানে কাহিনির নায়ক, সহজ সন্ন্যাসীর আবাসে পৌঁছবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলপ্রয়োগ করে সেখানে ঢুকবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। এখানকার আখ্যানভাগ এইরকম :

“এবং ইথেলরেড, স্বভাবতই যে সিংহতেজা এবং যে মদ্য সে পান করেছে তার শক্তিতে যে এখন আর বেশি শক্তিশালী,- সন্ন্যাসীর কাছে অনুনয় করবার জন্য সে আর অপেক্ষা করল না। বাস্তবিক পক্ষে সন্ন্যাসী ছিল অত্যন্ত জেদী, আক্রোশপরায়ণ এবং চতুর। কিন্তু কাঁধের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে, ঝড় উঠতে পারে ভেবে সে তক্ষুণি নিজের গদা তুলে নিলো এবং আঘাতের পর আঘাতে দরজার কাঠের মধ্যে নিজের লৌহদস্তানা পরা হাত ঢোকাবার জায়গা পেয়ে গেল। এবার প্রচণ্ড জোরে দরজা টানতে শুরু করল- ফলে মড়মড়-চড়চড় করে তা ভেঙে পড়তে লাগল। শুকনো এবং ফাঁপা কাঠের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে তা সকলকে সচকিত করে তুলল।”

যে অনুচ্ছেদটা শুরু করেছিলাম সেটা শেষ হবার পর মুহূর্তের জন্য আমি থামলাম। কারণ, আমার মনে হলো- হ্যাঁ, সত্যিই আমার মনে হলো, যেন প্রাসাদের কোন দূর প্রান্ত থেকে খুবই অস্পষ্টভাবে আমার কানে এসে পৌঁছচ্ছে এই গল্পের চরিত্রের সঙ্গে বেশ সাদৃশ্য আছে এমন একটা প্রতিধ্বনি- সেই মড়মড় এবং চড়চড় শব্দ যা স্যার লন্সটন বিশেষভাবে বর্ণনা করেছেন।

সন্দেহের কোনো কারণই নেই যে, এই আকস্মিক যোগাযোগের জন্যই আমার মনোযোগ ওদিকে গিয়েছিল, নইলে জানলার সার্সির ঝনঝন শব্দ আর ক্রমশ তীব্রতরভাবে ফুঁসে ওঠা ঝড়ের আওয়াজের মধ্যে ওটুকু শব্দ কিছুই নয়। এতে আমার মন দেবার বা বাধা পাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি পড়তে থাকলাম”

“দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিন্তু বিজয়ী বীর ইথেলরেড বিমর্ষ, ক্রুদ্ধ এবং বিস্মিত হয়ে দেখল সেই জিঘাংসাপরায়ণ সন্ন্যাসীর কোনো চিহ্নই নেই- তার বদলে দাঁড়িয়ে আছে আঁশওয়ালা এক অতিকায় ড্রাগন যার জিভ দিয়ে আগুন ছুটছে। সে যে প্রাসাদের প্রহরায় দঁড়িয়ে আছে সে প্রাসাদটি সোনার, মেঝেটা রুপোর এবং দেয়ালের পেতলের একখানা ঝকঝকে ঢাল ; তার ওপর লেখা আছে এই প্রবাদবাক্য-

এখানে যে প্রবেশিবে, হে বিজয়ী বীর শুনে যাও,

ড্রাগান বধ করে এই ঢাল তুমি তুলে নাও।

ইথেলরেড তুলে নিল তার গদা, আঘাত করলো ড্রাগনের মাথায়। ড্রাগন পড়ে গেল তার সামনে, ছুঁড়ে দিল তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস আর তীব্র আওয়াজ। সে আওয়াজ এত ভয়ঙ্কর, এত কর্কশ এবং এত তীক্ষè যে ইথেলরেড দুহাতে তার কান চেপে ধরলো। ওঃ কি বীভৎস শব্দ- এমন ভয়ঙ্কর আওয়াজ জীবনে কখনো শোনা যায়নি!”

এই পর্যন্ত এসে আমি হঠাৎ থেমে গেলাম। অদ্ভুত বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করলাম এবার আর কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই- আমি সত্যিই শুনতে পাচ্ছি সেই শব্দ!

ঠিক কোন দিক থেকে শব্দটা আসছিল সেটা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু বেশ দূর থেকে একটা হালকা কর্কশ টানা শব্দ ভেসে আসছে। একটা অস্বাভাবিক আর্তস্বর কিংবা কিছু ঘষার শব্দ- গ্রন্থের লেখক ড্রাগনের চীৎকারে যে বীভৎস আওয়াজের কথা বলেছেন, অবিকল যেন ঠিক তারই মতো।

দ্বিতীয়বার এই অস্বাভাবিক কাকতালীয় যোগাযোগে আমি যে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম, সে কথা মিথ্যে নয়। অসংখ্য অনুভূতি আমায় বিভ্রান্ত করছিল যার মধ্যে মিশে আছে বিস্ময়, ভীতি আরও অনেক কিছু। কিন্তু তখনও আমার মানসিক ধৈর্য বজায় রাখবার ক্ষমতা আমার ছিল- আমি আমার উত্তেজনা চেপে রাখছিলাম, কেননা রডরিকের মানসিক বিশৃঙ্খলার কথা আমি মনে রেখেছিলাম। নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, এই শব্দ সে শুনেছে কি না, তবে কয়েক মিনিট ধরে সুনিশ্চিতভাবে তার হাবভাবে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। প্রথমে সে বসেছিল আমার মুখোমুখি, তা থেকে ক্রমশ সে ঘুরিয়ে নিয়েছে নিজের চেয়ার- এমনভাবে বসেছে যাতে তার মুখ থাকে দরজার দিকে। সেজন্য তার চেহারা আমি আংশিক দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম যে, সে যেন আপন মনে কিছু বিড়বিড় করছে- তার ঠোঁটের কাঁপুনিতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার মাথা ঝুঁকে পড়েছে প্রায় বুকের ওপর- কিন্তু আমি জানি সে ঘুমোচ্ছে না। একনজরেই তার সামগ্রিক চেহারাটা আমি দেখে নিয়েছি। তার ভয়ার্ত কঠিন বিস্ফারিত চোখ আমার নজরে পড়েছে। তার দেহের ভঙ্গিও এই কথাই সমর্থন করে,- খুব ধীরে ধীরে হলেও এক নাগাড়ে সে এপাশে-ওপাশে দুলছে। চট করে গোটা ব্যাপারটা একবার দেখে নিয়ে আমি স্যার লন্সলট-এর গল্পটা আবার ধরে ফেললাম। কাহিনি এইভাবে এগিয়েছিল :

“ড্রাগন প্রচণ্ড আক্রোশের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিজয়ী বীর সেই ঢাল এবং তার ওপর যে যাদুমন্ত্র দেওয়া ছিল তা ছিন্ন করার কথা ভাবল। পায়ের তলায় জন্তুটার মৃতদেহ পড়েছিল, সেটাকে সে সরালো এবং দুর্গের রুপোর সিঁড়ি বেয়ে যেখানে ঢালটা রাখা ছিল সেদিকে বিজয়গর্বে এগুলো। ঢালটা তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো না, তার আগেই সেটা ইথেলরেডের পায়ের কাছে রুপোর মেঝের ওপর পড়ে গেল। বিরাট এবং ভয়ঙ্কর এক ঝনঝন শব্দ উঠলো।”

অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়ে আমি লাফিয়ে উঠেছি ! কিন্তু আশারের সেই মৃদু দুলুনি তখনো ঠিক তেমনি চলেছে। যে চেয়ারে সে বসেছিল আমি ছিটকে গেলাম সেখানে। তার চোখ দুটো নিবদ্ধ ছিল নিজেরই দিকে। সমস্ত শরীরটা যে শক্ত এক পাথরের মূর্তি। কিন্তু যে-মুহূর্তে আমি আমার হাত রেখেছি কাঁধে, তার সমগ্র দেহে যেন এক প্রচণ্ড শিহরণ খেলে গেল। একটা দুর্বল হাসি তার ঠোঁটে কেঁপে উঠল। আমি দেখতে পেলাম নিচু গলায় খুব তাড়াতাড়ি যেন আপনমনেই কী ফিসফিস করে চলেছে- যেন আমার উপস্থিতি সে বুঝতেই পারছে না। তার কাছে ঝুঁকে পড়ে, বেশ খানিকটা পরে যেন নেশার মতো পান করছি- এইভাবে তার কথাগুলো খানিক পরে বুঝতে পারলাম। 

‘শুনতে পাচ্ছো না ?- হ্যাঁ, শুনতে আমি পাচ্ছি, আমি শুনেছি। অনেকক্ষণ- অনেকক্ষণ- বহুক্ষণ ধরে - অনেক মিনিট ধরে, অনেক ঘণ্টা ধরে, অনেক দিন ধরে আমি এই শব্দ শুনে আসছি। কেবল বলতে সাহস করিনি- আ ! আমায় করুণা করো- কী দুর্ভাগা আমি ! আমি সাংঘাতিক ভয় পেয়েছি- কথা বলতে সাহস হয়নি ! আমরা তাকে জীবন্ত অবস্থাতেই কবর দিয়েছি। বলিনি, আমার সংবেদন অত্যন্ত সূ² ? এখন আমি বলছি, হ্যাঁ এখন- তার প্রথম পদধ্বনি ওই ফাঁকা কফিনের মধ্যেই আমি শুনেছি। আমি শুনেছি- অনেক, অনেক দিন আগে- তবু আমি সাহস করিনি, কথাটা বলতে আমি সাহস করিনি! আর এখন, এই রাতে- ইথেলরেড- হ্যাঁ-হ্যাঁ! সন্ন্যাসীর দরজা ভাঙা, ড্রাগনের মরণ যন্ত্রণা, ঢাল পড়ে যাওয়ার শব্দ ! তার চেয়ে বলো তার কফিনের ডালা ভেঙে ফেলা, তার বন্দিশালার লোহার কব্জা ঘষে ভাঙা, তামার আবরণ দেওয়া খিলান পথে তার কষ্ট করে এগিয়ে আসা ! ওঃ - কোথায় পালাবো আমি ? খুব শিগ্গিরই কি এখানে আসবে না সে ? তাড়াহুড়ো করে কবর দেওয়ার জন্য সে কি দৌড়ে আসছে না আমাকে ভর্ৎসনা করতে ? আমি কি সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ শুনিনি ? তার হৃৎপিণ্ডের ভারি আর বীভৎস শব্দ কি আমি চিনতে পারিনি ? - পাগল-পাগল !’

অকস্মাৎ উন্মত্তের মতো সে লাফিয়ে উঠল। কথা বলতে বলতেই সে তীব্র চিৎকার করে উঠল- ‘পাগল ! আমি বলছি সে এদিকে এসে দাঁড়িয়েছে ! দরজা দিয়ে আসার তার দরকার হবে না।’

তার এই চিৎকারে যেন এক অমানুষিক শক্তি ছিল- প্রতিটি কথা প্রচণ্ড জোরে উচ্চারণ করছিল সে। প্রাচীন জানলার যে দিকে সে দেখাচ্ছিল সেই মুহূর্তে সেই জানলার আবলুশ কাঠের ফ্রেম খুলে গেল। নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ঝড়ের জন্যেই এটা সম্ভব হলো- কিন্তু তারপর দেখা গেল সত্যিই দরজা দিয়ে নয়, সেই পথেই দাঁড়িয়ে আছে শবাচ্ছাদনের কাপড়ে ঢাকা লম্বা এক মহিলা- আশারের প্রাসাদের লেডি ম্যাডেলিন!

তার সাদা কাপড়ে লেগে আছে রক্তের ছিটে ! সমস্ত দেহে টানা হ্যাঁচড়া আর ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন প্রকট !

মুহূর্তের জন্য তার কম্পিত কলেবর সামনে পেছনে দুলে উঠল। তারপর চাপা এক আর্তস্বর তুলে অকস্মাৎ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ভাইয়ের ওপর। তার প্রচণ্ড মৃত্যুযন্ত্রণা কাতর নিষ্পেষণের পর দেখা গেল আশারের মৃতদেহ মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছে। যে ভয় সে করে আসছিল, সেই ভয়েরই শিকার হলো সে শেষ পর্যন্ত।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রাণপণে দৌড়তে আরম্ভ করলাম। ছিটকে বেরিয়ে এলাম সেই ঘর থেকে, সেই প্রাসাদ থেকে !

উন্মত্ত ঝড় তখনো মত্ত আক্রোশে ফুঁসছে। তড়িৎ গতিতে উঠে এলাম বাঁধের ওপর- পেরুবার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে। অকস্মাৎ চোখ ধাঁধিয়ে এক উজ্জ্বল আলোর রশ্মি আমার সামনের পথ পরিষ্কার করে দিল। অবাক হয়ে ঘাড় ঘোরালাম, এত আলো আসছে কোথা থেকে ! সেই অভিশপ্ত প্রাসাদ আর তার ছায়া ছাড়া আমার পেছনে তো কিছু নেই। দেখলাম সেই চকিত আলো এসেছে অস্তগামী গনগনে লাল বিরাট গোল চাঁদ থেকে। আর সেই আলো দেখা যাচ্ছে প্রাসাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আঁকাবাঁকা রেখায় চিড় খাওয়া এক ফাটলের মধ্যে দিয়ে।

এই ফাটলটা অতি সূ² আকারে আমি আগেই দেখেছি। কিন্তু আমার বিহ্বল দৃষ্টির সামনেই সেই ফাটল অতি দ্রুত চওড়া হতে লাগল।

সেই মুহূর্তে ছুটে এল প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড় ! আর আমার চোখের সামনেই সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটে গেল সেই রক্ত গোলকের মধ্যে !

আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, কোন রকমে টাল সামলে দেখলাম, প্রাসাদের বিরাট বিরাট স্তম্ভ গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, শত শত নদী যেন একসঙ্গে বাঁধ ভেঙে ছুটে আসছে- এইরকম টানা এক প্রবল আলোড়নের শব্দ। আমার পায়ের তলার গভীর পার্বত্য হ্রদ যেন প্রচণ্ড হিংস্রতায় ছুটে গেল সামনে- আশারের প্রাসাদের ভগ্নস্তূপের ওপর ছড়িয়ে পড়ল সেই জলের স্রোত !  


এডগার এলান পো

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক এডগার এলান পো। মূলত কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও এলান পো কবিতা লেখার অবসরে অসাধারণ কতগুলো রোমাঞ্চকর গল্প লিখেছেন। আধুনিক কবিতার জনক শার্লে বোদলেয়ার [১৮২১-১৮৬৭] ছিলেন এলান পো’র একনিষ্ঠ ভক্ত। বোদলেয়ারের স্পর্শকাতর কবিমন নিজের মতো করে শুষে নিয়েছিল এডগার এলান পো’র কাব্য। এলান পো’র মধ্যেই দেখেছিলেন সেই আধুনিক কবিকে- ‘যিনি সর্বমানবের হয়ে দুঃখ পান।’ অর্থাৎ এলান পো ছিলেন বোদলেয়ারের বিষাদময় কাব্যজীবনের অন্তরাত্মার প্রতিবিম্ব। এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মহৎ আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইটেস [১৮৬৪-১৯৩৯] এলান পো সম্পর্কে বলেছেন : ‘Always and for all lands a great lyric poet’ কবিতা রচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি কয়েকটি বিস্ময়কর রহস্য-গল্প লিখেছেন, আজ পর্যন্ত সেইসব গল্পাবলি পৃথিবীর সাহিত্যমহলে অবিস্মরণীয় রস সঞ্চার করে। গোয়েন্দা গল্পের কিংবদন্তি পুরুষ আর্থার কোনাল ডায়েল সৃষ্ট রহস্য উপন্যাসের নায়ক শার্লক হোমস বলেছেন : ‘আমার গুরু এডগার এলান পো রচিত চরিত্র মসিয়ে দু্যঁপি।’

আজ থেকে দুশো ১৪ বছর আগে ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি এলান পো আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এবং অল্প বয়েসেই বাবা-মাকে হারান। অনাথ এডগারকে মাত্র ৬ বছর বয়েসে তার ধর্মপিতা লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ড প্রেরণ করেন। বারো বছর বয়েসে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে- ষোলো বছর বয়েসে স্কুলের পড়া শেষ করার পর তিনি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অল্প বয়েসেই ইংরেজি ভাষা এবং কবিতা লেখায় প্রচণ্ড ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মাদকাসক্তি ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন ধারণের কারণে পো বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

দু’দুবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু দু’জন স্ত্রীরই অকাল মৃত্যু হয়। প্রচণ্ড উচ্ছৃঙ্খল জীবন এবং মদ, আফিম ও অন্যান্য উচ্চমার্গের নেশায় আসক্ত অসংযমী পো বহু পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। 

সংক্ষিপ্ত জীবনে তাকে পার হতে হয়েছে- দারিদ্র্য, দুঃখ, দৈন্য, স্নেহবর্জিত, যন্ত্রণায় দীর্ণ অনেক কণ্টক পথ। তাই তিনি লিখেছেন : I became insane, with long inervals of horrible society. During these fits of unconsciusness, I dring... my enemies reffered the insanity to the drink, rather than the drink to insanity.

মাত্র ৪০ বছর বয়েসে অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবরে এডগার এলান পো পরলোক গমন করেন। এলান পো’র মরদেহ তার প্রথম স্ত্রীর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।


** প্রখ্যাত মার্কিন কবি, গল্পকার এবং সাংবাদিক এডগার এলান পো [১৮০৯-১৮৪৯] রচিত Fall of the House of usher. 

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ