ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

11 Apr 2023, 03:07 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


ছবি তোলা শেষ হলে আমরা আবার পথে নামলাম, আজ আমরা যখন যেখানে যেমন- সেই উপায়ে পথ চলছি, যেখানে পায়ে চলা পথে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় সেখানে হাঁটছি, যেখানে বাস আছে, বাসে উঠে বসছি, আবার যেখানে ট্রাম রয়েছে সেখানে ট্রামে চড়ছি। বেশ একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব, কোনো তাড়া নেই যেখানে ভালো লাগছে কিছুক্ষণ বসছি আবার হাঁটছি। এমনি করে আমরা পৌছে গেলাম শহরের একেবারে কেন্দ্রে, ওয়াকস্ট্রিটে। ওয়াকস্ট্রিট মূলত বাজার এলাকা, বেশ কিছু খাবারের দোকান আর ছোটোবড়ো স্যুভেনির দোকান দিয়েই সাজনো থাকে, এখানে সেখানে বসে গল্প-গুজব করার জন্য রয়েছে কাঠ বা স্টিলের বেঞ্চি। কমবয়সীদের জন্য ওয়াকস্ট্রিট খুব পছন্দের জায়গা। অল্প খরচে ভালো আর আনন্দময় সময় কাটাতে ওয়াকস্ট্রিটের বিকল্প নেই, বিনোদন বলতে এখানে খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া, স্ট্রিট সিংগারদের গান শোনা বা ম্যাজিশিয়ানদের ম্যাজিক দেখা, মোট কথা স্বল্প খরচে নিজের মতো করে সময় কাটানোর একটি ভালো জায়গা। আর পর্যটকদের কাছে এটি খুব জনপ্রিয়, যেমন আমারও। অবশ্য এর আগে ওয়াকস্ট্রিট সম্পর্কে আমার ধারণা তেমন ছিল না, কোপেনহেগেনের ওয়াকস্ট্রিটে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমার মনে হলো এ পথে আমি আগেও হেঁটেছি বন্ধু বাবুকে এ কথা বলতেই সে জানালো ইউরোপের প্রতিটি শহরেই এ রকম এক বা একাধিক ওয়াকস্ট্রিট রয়েছে, যার প্রতিটির আদল মোটামুটি একই রকম ; যে কারণে এ পথ আগে দেখেছি বলে আমার মনে হচ্ছিল। বাবুর কথা শুনে মনে হলো এরকম আমি রোম বা প্রাগেও দেখেছি, একটা গোল চত্বরকে ঘিরে গোটা এলাকাটা সাজানো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গোল চত্বরটিতে একটি ফোয়ারা থাকে। যাই হোক, এখানে সারি সারি স্যুভেনির দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দোকানে না ঢুকে পারা গেল না ; এত চমৎকার চমৎকার সব শো-পিস চোখ আটকাবেই, সাথে রয়েছে ছোটো বড়ো পাথরের বর্ণিল গয়নার পসরা। মেয়েরা গয়না দেখলে থমকাবে না, একটু দর-দাম করবে না, তাই কি হয় ? আমি আমার কথাই বলছি, গয়নার দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম পছন্দও হলো টুকটাক, এতো দেখি আমার লাভের পোয়াবারো, পছন্দ করা জিনিসগুলো বন্ধু বাবুর কাছে থেকে উপহারস্বরূপ পেলাম। একটু বিব্রত হলেও উপহার পেতে সবারই ভালো লাগে আমিই ব্যতিক্রম কোথায়। এরপর আবার হাঁটছি আরো কিছু টুকটাক কেনাকাটা শেষে ওয়াকস্ট্রিট ছেড়ে চলে এলাম নদীর ধারে।

আসলে এটা নদী না লেক এর সঠিক পরিচয় আমার জানা ছিল না, ধারণা করছি নদী, যদিও নাম জানা হয়নি। কেন ধারণা করলাম- ইউরোপের প্রতিটি শহরে অন্তত একটি নদীর দেখা মেলে, আসলে নামেই নদী, আমার কাছে মনে হয়, ঘটি ডোবে না, নামে তাল পুকুর গোছের কিছু। যাই হোক বলছিলাম কেন ভেবে নিলাম নদী- যেমন দেখেছি প্যারিসে বা প্রাগে যে, শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা শীর্ণকায় নদী, যার উপর পায়ে চলা সেতু আর সেতুর রেলিঙে অসংখ্য তালা ঝুলানো, যাকে বলা হয় লাভ লক। কেন বলা হয় তা আগে বলেছি, এখন আর সে গল্পে যাচ্ছি না। এখানেও সেতুর রেলিং-এ অসংখ্য বর্ণিল তালা ঝোলানো। নদীর ধার ঘেঁষে কাঠের পাটাতন তার উপর সার দিয়ে সাজানো চেয়ার-টেবিল, এগুলো আসলে ওপেন এয়ার রেঁস্তোরা, অন্য পাশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ের বাড়িগুলো ছবির মতো যেন সাজানো। আমার মনে হলো যেন, হঠাৎ করেই যেন পুরোনো দিনের ইংলিশ মুভির কোনো প্লটে ঢুকে পড়েছি। তা এই ছবির মতো জায়গায় এসে ছবি না তুললে হয় ! তাই দু’-একটা ছবি তুলে আমরা দুপুরে কোথায় খাওয়া যায় তার সন্ধানে চললাম। কেননা সময় ততক্ষণে দুই এর কাঁটা ছাড়িয়ে গেছে। মনে হতেই নদীর পাড়ে সাজানো রেঁস্তোরা রেখে আমরা আবার কোথায় যাচ্ছি খাবারের খোঁজে। আসলে এই রেঁস্তোরাগুলোতে সাধারণত সান্ধকালীন আয়োজন থাকে। সকাল-দুপুর এই সময়টায় শহরের এ অংশটি যেন ঘুমন্ত পুরীর মতো ঘুমিয়ে থাকে, পৃথিবী সমান নির্জনতা গ্রাস করে নেয় রাত্রির জমজমাট এ রেঁস্তোরাগুলোকে।

আমরা খাবারের দোকানের সন্ধানে যেতে পথে অ্যানির সাথে দেখা, এটা আমার জন্য সারপ্রাইজ ছিল। যদিও প্লানটা বাই চান্স ছিল তবুও বাবু আর অ্যানি ঠিক করেছিল যে, আমরা একসাথে লাঞ্চ করবো আমাকে সেটা বলেনি। অ্যানি সকাল সকাল ক্লাসে বেরিয়ে যাওয়ায় আমার সাথে তার দেখা হয়নি, তাই জানাও হয়নি সে কখন ফিরছে। লাঞ্চে যাওয়ার পথে আমি বাবুকে বলছিলাম অ্যানি থাকলে ভালো লাগত, বাবু ইচ্ছে করেই তখন আমাকে কিছু বলেনি। যাই হোক, মাঝে মাঝে এমন সারপ্রাইজ মন্দ না, কী বলেন ? এখন আমরা তিনজন একসাথে বাসে উঠে বসলাম, কোথায় যাচ্ছি জায়গাটার নাম এখন আর মনে নেই, এমনিতেই আমি নামধাম খুব একটা মনে রাখতে পারি না আর ইউরোপের বিভিন্ন শহরের নাম আঞ্চলিক উচ্চারণে এত জটিল কষ্ট করে মনে রাখার চেষ্টাও বৃথা। তবে তাদের দু’জনের কথায় বুঝলাম, এটি একটি অ্যারাবিয়ান রেস্তোরা এবং তাদের খুব পছন্দেরও বটে। বাস থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সকাল থেকে বেশি সময় ধরে হাঁটতে থাকায় খিদে বেশ চনমন করছিল, রেস্টুরেন্টে পৌঁছে বেশ স্বস্তি লাগছিল, সময় তখন বোধ করি দুটোর কাছাকাছি। রেস্টুরেন্টে টইটম্বুর ভিড়ের মাঝে অনেক খুঁজেপেতে এক কোণায় তিনজনের ব্যবস্থা হলো এরপর খাবারের মেনু নির্বাচন করে অর্ডার করা হলো। এ কাজটি অ্যানিই করল। অপেক্ষার সময়টাতে অ্যানির কোর্স নিয়ে কথা বলছিলাম, জানছিলাম তাদের পড়াশোনার ধরন। এ যেমন ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধানভানে, আমরা যারা শিক্ষা-গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলাম, তাদের কাছে আজীবনই শিক্ষা-পদ্ধতি, কারিকুলাম এসব আগ্রহের বিষয়। জানলাম, সেদিন তাদের একটি কা¬সে একটি মুভি দেখানো হলো একই সাথে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সেই মুভির লিংকও দিয়ে দেয়া হলো, স্বাধীনতা ছিল যে ইচ্ছা ক্লাস টাইমে ক্লাসের প্রজেক্টরে মুভিটি দেখতে পারে অথবা চাইলে পরবর্তীসময়ে তাদের নিজেদের পছন্দমতো যেকোনো সময় মুভিটি দেখে নিতে পারে, অ্যানি সে সুযোগটিই নিল, চলে এলো আমাদের সাথে লাঞ্চ করবে বলে। প্রথমত, মনে হতে পারে মুভি দেখা এটা আবার কারিকুলাম বা সিলেবাসের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত, আসলে মুভির বিষয়বস্তু ছিল তাদের কোর্স রিলেটেড, যেখানে হসপিটাল হসপিটালিটির সংযোগ ছিল এবং মুভিটি দেখে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পারসেপশন তুলে ধরে একটা রাইট আপ জমা দেবেন। সেটা কিন্তু নির্ধরিত সময়েই দিতে হবে, সেখানে আর নিজেদের পছন্দমতো সময় বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। বিষযটি বেশ মজার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আনন্দের সাথে শিক্ষার কথা বলেছিলেন, এ যেন তার বাস্তব প্রতিফলন। এর মাঝে খাবার পরিবেশন করা হয়ে গেছে, তো আর দেরি করা কেন, খিদে তো বেশ জোরেসোরেই লেগেছে।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে পথে নামতেই বিনা মেঘে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, আশেপাশে দাঁড়ানোর কোন জায়গা না থাকায় একরকম দৌঁড়েই রাস্তাটুকু পার হয়ে যাত্রী ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। বলা হয়নি অ্যানিকে আবার তার প্রতিষ্ঠানে ফিরতে হবে, তাই বাসে একটা নির্দিষ্ট গন্তেব্যের পর আমাদের পথ আলাদা হলো। অ্যানি অন্য একটি বাস ধরে তার গন্তেব্যের রওনা হলো আর আমরা বাস থেকে নেমে আবার কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম সেই ওয়াকস্ট্রিটের আশেপাশেই। এদিকটায় মাঝারী পায়ে চলার পথের দু’ধারে বাহারী স্যুভেনিরের দোকান, হাতে আপাতত অন্য কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এ দোকান-সে দোকানে ঢুঁ মারছি। যা হয় আরকি দেখে দেখে এটাসেটা পছন্দও হয়ে যায় তাই কেনাকাটা চলল আরো কিছুক্ষণ।

নভেম্বরে ইউরোপে দুপুর হতে দেরি ; সন্ধে নামতে আর দেরি হয় না। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটার আশেপাশে যেতেই মনে হলে সন্ধে যেন জাঁকিয়ে নেমেছে। আমরা এবার আবার বাস স্ট্যান্ডে গেলাম, এবারের গন্তব্য আদিবার স্কুল কাম ডে-কেয়ার সেন্টার। আদিবার স্কুলে পৌঁছে মনটা আরো ভালো হয়ে গেল, সেইসাথে আমাদের দেশের কর্মজীবী মায়েদের কথা ভেবে খারাপ লাগল, তারা যখন অফিসে বা বাইরে কোথাও কাজে যায় তারা এক মুহূর্তের জন্যও তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারেন না। যাদের এক্সটেনডেট ফ্যামিলি তাদের কথা ভিন্ন, নিঃসন্দেহে তারা ভাগ্যবান। কোন কথায় কোথায় চলে গেলাম। আমরা আদিবার স্কুলে ছিলাম, তখন অবশ্য স্কুলের নির্ধারিত সময় শেষ, শিশুরা যে যার মতো করে সময় কাটাচ্ছে। কেউ পড়াশোনা করছে, আগামী দিনের টাস্ক দেখে রাখছে কেউ তাদের সহযোগিতার দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের নানান প্রশ্নে ব্যস্ত রাখছে, আবার কেউ কেউ ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন খেলায় মেতে আছে। যদিও বলছি খেলায় মেতে আছে আসলে খেলাচ্ছলে তারা শিখনেই ব্যস্ত আছে। আমরা যেতেই আদিবা তার পড়ালেখা আর খেলার সামগ্রী গুছিয়ে রেখে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

[চলবে]