পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম

09 Feb 2023, 02:17 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম


বর্তমান যুগে জীবনযাপনের মানের আমূল পরিবর্তনে প্রভাবিত হচ্ছে আট থেকে আশি বছরের মানুষ। ধূমপান, মদ্যপানের মতোই ক্ষতিকারক সেই পরিবর্তন। আধুনিকীকরণ এবং বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে একাধিক রোগ। একদিকে ধূমপানে যেমন বাড়ছে ক্যান্সারের প্রবণতা, অন্যদিকে সেডেন্টারি বা শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় লাইফস্টাইলের জাঁতাকলে বাড়ছে নারীদের একাধিক শারীরিক রোগ, যার মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ অন্যতম।


কী এই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ

পলিসিস্ট কথার অর্থ একের বেশি সিস্ট। চিকিৎসকেরা বলছেন, এক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ থেকে ১২টি সিস্ট থাকবে প্রতি ওভারিতে এবং এই সিস্টের ওজন হবে ২ থেকে ৬ মিলি লিটার। পাশাপাশি প্রতিটি ওভারির আয়তন হতে হবে ১০ মিলি লিটারের বেশি।

আসলে সিস্ট হলো ছোট পানি ভরা থলি, আর একাধিক সিস্টকে একসঙ্গে বলা হয় পলিসিস্ট। আর ওভারি যে ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ অরগ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম তা নিশ্চয়ই সবার জানা। ছোটো ছোটো সিস্ট [১০-১২টি] পুঁতির মালার মতো দেখতে ওভারি বা ডিম্বাশয়কে ঘিরে থাকে। এই সিস্টের জন্য ওভারির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।


কেন হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ

ঠিক কোন কারণে এই সমস্যা শুরু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কারণ হিসেবে তিনটে দিক উল্লেখ করা যেতে পারে :

১. জিনগত কারণ, অর্থাৎ যাদের পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে,

২. পরিবেশগত কারণ,

৩. আচরণগত কারণ। অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া, অনিয়মিত খাদ্যাভাস, ফাস্টফুডের প্রতি ঝোঁক, অতিরিক্ত ফ্যাটজাতীয় খাবার খাওয়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ইত্যাদি। পাশাপাশি মানসিক চাপও এই অসুখের বড়ো কারণ।


পলিসিস্টিক ওভারির লক্ষণ

* শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমা।

* ঠোঁটের নিচে, গালে বা চিবুকে কখনোবা বুকে, পেটে, পিঠেও পুরুষালি লোম গজায় [যা ওভারি থেকে মাত্রাতিরিক্ত পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন বেড়ে যায় বলে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়]।

* পিরিয়ডের গোলমালের সূত্রপাত হয়, শুরুতে দুই-তিন মাস পরপর পিরিয়ড হয়। কখনো-বা হরমোনের তারতম্য বেশি হলে বছরে দুই-তিনবার বা তারও কম পিরিয়ড হয়। কারো আবার অতিরিক্ত  ব্লিডিং হয়। বিবাহিতদের সন্তান ধারণে সমস্যা হয় অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য।

* অনেক ক্ষেত্রেই ইনফার্টিলিটির এক অন্যতম কারণ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।

যে বয়সে হতে পারে

যেকোনো বয়সের নারীরাই মেনার্কি থেকে মেনোপজ পর্যন্ত হতে পারে। তবে একই পরিবারের মেয়েদের মধ্যে অনেকের হয় বলে জেনেটিক ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই মেয়েরা ডাক্তারের কাছে আসছেন এবং ইদানীং রোগ নির্ণয়ের অনেক অত্যাধুনিক ব্যবস্থার কারণে রোগ নির্ণয় হচ্ছে বেশি। আগেকার দিনে এ ধরনের মেয়েলি সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো না।


চিকিৎসা

এ সমস্যার সর্বপ্রথম চিকিৎসা মেদ কমানো। একই সঙ্গে লো ডোজের ওরাল পিলস দেওয়া হয়। এই পিলস এন্ড্রোজেনের মাত্রা কমায়। যাদের সন্তান ধারণে অসুবিধা হচ্ছে তাদের মেটফরমিন নামে একধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। এটি ডায়াবেটিসের ওষুধ হওয়া সত্তে¡ও ডিম্বাণু নিঃসরণে সাহায্য করে। এ ধরনের ওষুধ ধৈর্যের সঙ্গে তিন থেকে ছয় মাস খেয়ে যেতে হয়। অবাঞ্ছিত লোমের জন্য ইনেকট্রোলিসিসের সাহায্য নিতে হতে পারে। অনেক সময় মেয়েরা সাইকোলজিক্যালি এত ডিপ্রেশনে ভোগে, যা সাইকোলজিক্যাল কাউসেলিং এবং প্রয়োজনে ট্রিটমেন্ট নিতে হতে পারে।


কীভাবে সনাক্তকরণ সম্ভব

পিসিওএস সনাক্তকরণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট টেস্ট বা পরীক্ষা নেই। উপযুক্ত উপসর্গগুলো যদি থেকে থাকে তবে অভিজ্ঞ গাইনি বিশেষজ্ঞের তত্ত¡াবধানে কিছু পরীক্ষা করাতে হবে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ওভারিতে সিস্ট আছে কি না দেখা হয়। সাধারণত ওভারিতে দশ-বারো বা এর অধিক সিস্ট থাকলে ওই ওভারিকে পলিসিস্টিক ওভারি বলে।


পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রম দেখতে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু হরমোন পরিমাপ করা হয়। পিসিওএস আগ্রন্তদের পুরুষ হরমোনের [এন্ডোজেন এবং টেস্টস্টেরন] আধিক্য দেখা যায়। FSH ও LH হরমোনের অনুপাত পরিবর্তন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা দেখে এনুভুলেশন সনাক্ত করা হয়। এছাড়া রক্তে কোলেস্টেরল এবং শর্করার মাত্রা দেখা যেতে পারে।

এটি ১০০ ভাগ সেরে যায় না কখনোই। তবে ওষুধ দিয়ে এবং নিয়মিত মনিটরিং-এর মাধ্যমে সমস্যাগুলোকে বেশ কিছুটা কমিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবন দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি এই রোগের প্রভাবগুলোকেও কমিয়ে দেওয়া যায় ২০-২৫ বছরের জন্য। এমনকি রোগীর সহযোগিতা থাকলে তার পক্ষে কনসিভ করারও কোনো সমস্যা নেই। আর এই চিকিৎসার সময়ে অনেকের মানসিক বিরক্তি বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম কম হওয়াসহ বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।

শুধুমাত্র লাইফস্টাইল অর্থাৎ জীবনযাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই রোগ কমানো যায়। নিয়মিত শরীরচর্চা, হাঁটাচলা, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ছোটোদের দৌড়ানো, খেলাধুলার পাশাপাশি সঠিক সময়ে ওষুধের মধ্যে দিয়ে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় সহজেই। আর অযথা চিন্তায় ডুবে থাকা যাবে না। পুরো সেরে যাওয়া অসম্ভব হলেও এটা নিয়ে চিন্তা করতে বসলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। আর ধূমপান বা মদ্যপানের বিষয়ে একটু সচেতন থাকতে হবে, মদ্যপান কখনো কখনো করলেও ধূমপান করবেন না একেবারেই, এতে সমস্যা আরো বাড়বে।