মুর্শিদ জানায় যারে, মর্ম সেই জানিতে পায়

06 Jan 2021, 02:53 PM বাউল ভুবন শেয়ার:
মুর্শিদ জানায় যারে, মর্ম সেই জানিতে পায়

প্রান্তিক জনগণ সর্বজনীন যে-সকল গান গ্রহণ-বরণ-শ্রবণ করেন বা যে-সকল গানে সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় প্রান্তিক জনগণের কথা বলা হয়ে থাকে সে সকল গানকে আমরা লোকজগান বলি। বাউলগণ একদিকে গানের মাধ্যমে সাধনার তত্ত¡-মন্ত্র-শ্লোক-আয়াত প্রচার করেন, অপরদিকে এরা গানের মাধ্যমেই ‘মনের মানুষ’ বা ‘প্রাণের মানুষ’ অর্থাৎ ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবানকে খোঁজেন, পূজা করেন, সাধনা করেন, ধ্যান করেন, ভজন করেন। কাজেই বাউল তত্তে¡-মতে-আর্দশে দিক্ষীত না হলে কারো পক্ষে বাউল গানের নিগূঢ় তত্ত¡ উপলব্ধি বা ব্যাখ্যা নিয়ে আসা সম্ভব নয়। বাউলের এমন কিছু ভাবনা নিয়ে লিখেছেন চপল মাহমুদ...


বাউল শব্দটি শুনলেই মনে পেেড় যায় আমরা বাঙালি। কারণ, বাউল শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের আদি স্মৃতি। বাউল আমাদের মনে করিরে দেয় শেকড়ের কথা। মনে করে দেয় প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকসংগীতের কথা। কালের বিবর্তনের ফলে হারিয়ে গেছে প্রায় বাউল সম্প্রদায়। বর্তমান সময়ে চুল দাড়ি বড়ো হলেই আমরা বাউল মনে করি। আর যদি গেরুয়া বা সাদা কাপড় পরিধান করে হাতে একতারা বা দোতারা ধারণ করে তাহলে তো কথাই নেই। আমরা ভাবি, বাউল একটি এলোমেলো জীবনের নাম। এমনটাই সব সময় ভেবে নিই আমরা সাধারণজন। আসলে, আসল বিষয়টা তা নয়, বাউল শব্দের অর্থ ব্যাপক।

বাউল আসলে কী ? এই বিষয়ে কথা হলো বাউল শিল্পী ফকির সহিদুল আলমের সঙ্গে।

বাউল ফকির সহিদুল আলমের জন্ম ১৯৫৪ সালে। বাংলা মাস ভাদ্র, কুষ্টিয়া থানা ও জেলায় জুগিয়া দর্গাপাড়া গ্রামে। পিতার নাম মো. ইসলাম উদ্দিন মাস্টার ও মাতা সুফিয়া খাতুন। তিনি একজন সংসার ত্যাগী বাউল ফকির। গানের সঙ্গে কীভাবে তার পরিচয় তা জানতে চাইলে এই বাউল বলেন, ‘আট বছর বয়স থেকেই গানের প্রতি আমার একটু একটু আকর্ষণ শুরু হয়। গানের কথা কানে এলেই সেখানে চলে যেতাম। আমার এক মামাও ছিলেন গানের পাগল। তাকে দেখে আমার গানের পাগলামি আরো বেড়ে যায়। আমার বাবা ছিলেন একজন স্কুল মাস্টার। তিনি আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে আমার কোনো পড়া কখনোই মুখস্থ হতো না। কিন্তু কোনো গান একবার শুনলে সুন্দর মনে থাকত। লেখাপড়া আর হলো না। ডা. সাদেক আলির কাছে দোতারা শিখতে শুরু করলাম। তারপর গানের গুরু হিসেবে তক্করেল হোসেনের কাছে তালিম নিতে শুরু করলাম। লালন সাঁইজির গানের পাশাপাশি ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতিসহ অন্য গানও তার কাছে থেকে শিখতে থাকি। এরপর আস্তে আস্তে আমার শুরু হয় গান নিয়ে পথচলা। গাইতে শুরু করলাম বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মাজার ও সাধুসঙ্গে। আমার পিছনের জীবনে সব কিছু ত্যাগ করে বেড়িয়ে পড়লাম। এভাবেই চলছি সাঁইজির কৃপায়।’

আপনার দৃষ্টিতে বাউল আসলে কী ? শুধুই একজন গায়ক না এর অন্য কোনো অর্থ আছে ? বাউল শব্দের অর্থ কী ? এমন প্রশ্নের জবাবে ফকির সহিদুল আলম জানালেন, ‘বাউল শব্দের অর্থ হচ্ছে বাতাসের অনুসন্ধানকারী। একজন বাউল মনে করেন যে, তার দেহটাই মহাবিশ্ব। তার দেহের মধ্যেই সারাক্ষণ পরমাত্মা বিচরণ করেন। আকাশ পাতাল সন্ধান করে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সৃষ্টিকর্তা সকল জীবের মধ্যেই বিরাজমান। তাই বাউলরা সব সময় জীবপ্রেমের কথা বলে থাকেন। নিজের দেহঘড়ির মধ্যেই সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করেন একজন প্রকৃত বাউল। তাই বাউল সব সময় নিজের কর্মে আপন মনে মগ্ন থাকতে পছন্দ করে। নিজের ভাব ও ভাবনাকেই বড়ো বলে মনে করে। সৃষ্টিকর্তার সন্ধান ও মরণের কথা মনে ধারণ করে বাউল পথ চলে।’

তাহলে এখানে আধ্যাত্মিকতা কোথায় ? আধ্যাত্মিক ভাব কোথায় ? এ প্রশ্নের জবাবে ফকির সহিদুল আলম বলেন, ‘যখন একজন মানুষ প্রেমে পড়ে বা প্রেম করে তখন তার ভেতর একটা আনন্দের ভাব জন্ম নেয়। প্রেম যতই বাড়তে থাকে এই আনন্দ ভাবটা ততই বাড়তে থাকে। আমি মনে করি, আত্মার আনন্দটাই আসল আধ্যাত্মিক ভাব। যা সাধনার মধ্যদিয়ে অর্জন করতে হয়। কিন্তু সেই ভাবে যদি সে নিজেই মজে যায় এবং নিজের দেহ সম্পত্তিকে নষ্ট করে দেয়, তবে তখন তার প্রেমটা ধীরে ধীরে দেহ ও মন থেকে দূরে সরে যায়। তখন প্রেমের ঘরে জন্ম হয় বিবাদের বিষাদ ভাব। তার যদি প্রেম থাকে সে হিসাব বিচার করে চলে তাহলে সে প্রেম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সেই জড়িয়ে পড়াটাকেই আধ্যাত্মিক ভাব বলে থাকি বাউলের ভাষায়।’ 

তাহলে আমরা যে গানের আধ্যাত্মিক ভাব বলি তা আসলে কী ? গানের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব কোথায় ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘গানের বিষয়টা অনেক ব্যাপক। গান দিয়ে যত সহজে মানুষের মন জয় করা যায় তা আর অন্য কিছু দিয়ে সম্ভব নয়। একজন শিল্পী বা বাউলের মনের ভেতর যখন গানের ভাব পুরোপুরি প্রকাশ হয়ে যায়, তখন তার মনের ভেতর অন্য কিছু থাকে না। তখন তার কাছে জগতের কোনো কিছু আর বোঝার বাকি থাকে না। তখন তার মনের খেয়াল মোকাম খুলে যায়। অবলীলায় তার মধ্যে জ্ঞানের তীক্ষè আলো জ্বলে ওঠে এবং খুলে যায় জ্ঞানের দরজা, কেটে যায় অন্ধকার। জগতকে সে জানতে ও বুঝতে পারে। কিছুটা বলতেও পারে। যেখানে প্রেম আছে, সেখানেই আলো আছে।’ 

গান তাহলে মনের আলো জ্বালায়। কিন্তু গান কখন মানুষকে আনন্দ দেয় ? ‘গানের জগতে ঢুকে দেখলাম, এটা আসলে সৎসঙ্গ। গানের সাথে যন্ত্রের একটা সম্পর্ক আছে শুরু থেকেই। বাদক দল যদি ভালো বাজায় তাহলে এমনিতেই ভেতর থেকে গান চলে আসে। আর যদি বাদক দল একটু সমস্যা করে তাহলে গানের সুর ও তাল নষ্ট হয়ে গান প্রাণহীন হয়ে যায়। তাই বাদক ও গায়ক দু’দলের মনের মধ্যে গানের জন্য প্রেম ভাব থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাহলেই একজন বাউল গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারবে।’ 

লালন সাঁইজির গান নিয়ে ফকির সহিদুল আলম বলেন, ‘সাঁইজির গানের জগতটা বড়োই অভিনব। তার গানের সুরের মধ্যে একটা বৈচিত্র্য রয়েছে। তার গান ভাবপ্রধান হলেও সুর ও তালের মিলনে এই গান সত্যিই অপূর্ব। তার গানে রয়েছে ভক্তিরসের আবেশ। রয়েছে বিহŸলতা। এই বিহŸলতা শুধু গায়ক নয়, শ্রোতার মনেও শিহরণ জাগায়। গায়ক যখন তন্ময় হয়ে গান গায়, শ্রোতা তখন বিহŸল হয়ে শোনে। তার গানে বাংলার প্রকৃতি ও মাটির গন্ধ রয়েছে। মানুষের মনের সুর ব্যক্ত হয়েছে। তার গান তাই মানুষকে অভিভ‚ত করে এবং মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে।

গান গাইতে বা লিখতে অবশ্যই খাবার প্রয়োজন। তাই আপনি একজন বাউল হিসেবে মনে করেন যে, একজন শিল্পীর কেমন খাবার খাওয়া দরকার ? লালন সাঁইজি কী রকমের খাবার খেতেন ? এ বিষয় কিছু জানতে চাই, ‘আমার নিজের কথা নয়, শোনা কথা। বিভিন্ন আসরে গিয়ে লালন সাধুদের মুখ থেকে যা শুনেছি তাই বলছি, লালন সাঁইজি খাবারের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি সব সময় পরিমিত খাবার গ্রহণ করতেন। মাছ ও মাংস কোনোটাই খেতেন না। তবে কেউ কেউ বলেছে, তিনি শুধু ইলিশ মাছ পছন্দ করতেন অন্য কোনো মাছ নয়। সাঁইজি নিরামিশ ও ফলমূল খেতেন। আরো শুনেছি তিনি নাকি দই বেশি পছন্দ করতেন। তবে সাঁইজি নিজে খাওয়ার চেয়ে অন্যদের খাওয়াতে বেশি পছন্দ করতেন। আর সেই কারণেই তার আখড়া বাড়িতে সব সময় সাধুদের যাতায়াত বেশি ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে সাঁইজির আখড়ায় গানের অনুষ্ঠান হতো আর সেই অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের সাধ্যমতো সকলকেই কিছু না কিছু খাওয়াতেন। সেই পরম্পরা এখনো কুষ্টিয়ার আখড়া বাড়িতে প্রচলন।’ 

বর্তমান সময়ের নতুন প্রজন্মের অনেকেই সাঁইজির গান করছেন। এবং তারা বেশ সাড়া পাচ্ছেন। সাঁইজির গান করতে হলে বাউলের বেশ ধরতে হবে এমন বিষয়টি আপনি কোন ভাবে দেখছেন ? ‘নিরাকার কয় অচিন দেশে, আকার ছাড়া চলে না সে, নিরন্তর সাঁই, অন্ত যার নাই, যে যা ভাবে তাই সে হয়। সাঁইজির এই বাণীতেই লুকিয়ে আছে নতুন প্রজন্মের এসব কথা। বর্তমানে নতুন প্রজন্ম যেভাবে লালন সাঁইজির গান করে, তার মধ্যে আমি আদিভাব খুঁজে পাই না। দিন দিন পার্থক্যের পরিমাণটা বেড়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজš§কে একটা কথা বলে যেতে চাই, গান কাউকে ভাসায় আবার কাউকে ডুবায়। মুর্শিদ জানায় যারে মর্ম সেই জানিতে পায়, জেনে শুনে রাখে মনে সে কি কাউরে কয় ?