‘চাচায় চা চায়, চাচি চ্যাঁচায়’- জনপ্রিয় গায়ক নকুল কুমার বিশ্বাসের এই রঙ্গ গান শুনে আপনি হেসে গড়াগড়ি যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই গানে বাঙালির সংসার যাপনের যে গভীর সত্যটি ফুটে উঠেছে সেটাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। নিয়ম করে তিনবেলা আর বে-নিয়মে যখন তখন চা পান করা যদি চাচার জীবন যাপনের অংশ হয়ে থাকে, তা হলে চাচি শুধু চেঁচামেচিই নয়, আরো অনেককিছু করার অধিকার রাখেন। একবার ভাবুন তো, নিয়ম করে তিন বেলা আর বে-নিয়মে যখন তখন চা তৈরি করতে হলে চাচিকে ঠিক কতখানি ধৈর্যশীলা হতে হয় ? প্রথমে বিশুদ্ধ জল ঠিক মতো ফুটিয়ে নেওয়া, সেই ফুটন্ত জলে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ চাপাতা ফেলে প্রয়োজনমতো ফুটানো, তারপর পরিষ্কার কাপে সেটা ঢেলে পরিমাণমতো চিনি সঙ্গে মেশানো, তারপর সেই কাপ চাচার হাতে তুলে দেওয়া। আবার খেয়াল রাখা, চায়ে চুমুক দিয়ে চাচা তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ‘আহ্’ বলছেন কি না ? বললে তো হয়েই গেল, না বললে সঠিক সময়মতো খোঁচা দেওয়ার হিসাবও চাচিকেই রাখতে হয়। তার ওপর আবার চাচার যদি দুধ-চা, মসলা-চা, কিংবা ‘হালকা এলাচ গুঁড়ার সাথে আধা ইঞ্চির দুই সুতা কম আদার ফালি আর তুলসিপাতা দিয়ে পাক্কা দশ মিনিট ঢেকে রেখে তারপর গুরু খেতে বলেছেন,’ মার্কা বাতিক থাকে ; চাচি না চেঁচিয়ে পারবেন বলে কি আপনার মনে হয় ? এই যে, বঙ্গ ললনাদের এই পেরেশানিতে ফেলে দেওয়া, এর যাবতীয় লায়াবিলিটি ব্রিটিশদের।
শোনা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের কোনো এক ক্ষণে চৈনিক সম্রাট শেনংগ-এর গরম জলের পাত্রে একটি পাতা উড়ে এসে পড়েছিল। এতে জলের রং ও স্বাদে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল। সেই স্বাদ সম্রাটের ভালো লেগে গেলে তিনি প্রতিদিন তা পান করতে শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে এই পাতা ভেজানো জল জনপ্রিয় হতে থাকে। এটিই পরে ‘চা’ নামে পরিচিতি পায়। তারপর দীর্ঘদিন চীনদেশ সেই পাতা নিয়ে ব্যবসা করে সারা পৃথিবীতে। তাতে ভালো লাভটাভ হচ্ছিল। কোন এক ঘোর অমাবশ্যা তিথিতে যখন ব্রিটিশদের ওপর রাহু ভর করল, তারা চীনদেশের চায়ের ব্যবসায় দিল শনির দৃষ্টি। তলে তলে ভেবে ফেলল, যে করেই হোক ব্যবসাটা দখল করতে হবে। ব্রিটিশ বুদ্ধি বলে কথা ! ধীরে ধীরে চীনদেশের চায়ের ব্যবসায় ভাগ বসাতে শুরু করল তারা। ১৭৭৪ সালে ইংরেজরা চীন থেকে বীজ এনে ভুটানে চা চাষের চেষ্টা করে বিফল হলো। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ কবির এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে ব্রিটিশরা নতুন উদ্যমে চা-চাষের চেষ্টা করল ১৭৮৮ সালে, কোলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এর পঁয়ত্রিশ বছর পর ১৮২৩ সালে মেজর চার্লস রবার্ট ব্রুস আসামে প্রথম ভারতীয় প্রজাতির চাগাছ আবিষ্কার করেন। ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসামে চা-চাষের মধ্য দিয়ে ভারতে চা শিল্পের গোড়াপত্তন করে। ১৮৪০ সাল নাগাদ চীনদেশ থেকে আবার বীজ এনে চা চাষের চেষ্টা হয় বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাহাড়ি অঞ্চলে। ভারত স্বাধীন হবার একশো বছর আগে, ১৮৪৭ সালে দার্জিলিং অঞ্চলে চা-চাষ শুরু হয়। আর তার পরের ঘটনা তো আপনারা জানেনই- নকুল কুমার বিশ্বাস গান বানাতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলার ঘরে ঘরে চাচিদের যে দুরবস্থার জন্য শুধু ব্রিটিশদের দোষী করে লাভ নেই। বাঙালিরাও তাদের সঙ্গে ছিলেন। ১৮৩৫ সালে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর গঠন করা চা সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন দুই বাঙালি, রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘The Bengal Tea Association’, ১৮৩৯ সালে। ১৮৮১ সালে কোলকাতায় ‘Indian Tea Association’ স্থাপিত হবার ঠিক উনিশ বছর পর ১৯০০ সালে গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন বাংলা ভাষায় প্রথম চা বানানোর বই- ‘চা প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা’। আপনাদের মর্মাহত করার জন্য একটি তথ্য দিই- ঢাকায় হাতির ঝিলের পাশে বেগুনবাড়ি নামে যে জায়গাটিকে আপনারা চেনেন, সেই বেগুনবাড়ির প্রায় ত্রিশ বিঘা জমি পরিষ্কার করে, সেখানে একটি চা বাগান বানিয়ে বাঙালিকে চা খোর বানানোর নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গনি। নবাবের বাগানে উৎপন্ন হয়েছিল আড়াই মণ চা ! ঘটনাটি ১৮৬৭ সালের। এদিকে আবার প্রথম ইন্ডিয়ান টি প্লান্টার ছিলেন বাঙালিরই তুতো ভাই মনিরাম দেওয়ান নামের এক অসমিয়।
প্রথম দিকে ইংরেজরা চা উৎপাদন করত রপ্তানির জন্য। তারপর তাদের হঠাৎ মনে হলো, আরে পুরো ভারতই তো পড়ে আছে ব্যবসার জন্য। বাজার হিসেবে তখন তারা বেছে নিলো ভারতবর্ষ। এত বড়ো ভূখ , এত বড়ো বাজার সারাদুনিয়ায় আর কোথায় আছে ? তখন আবার ব্রিটিশ হেডকোয়ার্টার খোদ বাংলায়। আর যায় কোথায় ? বাঙালিকে চা খাওয়াতে উঠেপড়ে লাগল ব্রিটিশরা। অন্যান্য জাতির মানুষও অবশ্য বাদ গেল না। প্রথমে শুরু হলো ফ্রি ফ্রি চা খাওয়ানোর পালা। আড্ডাবাজ বাঙালির আড্ডার জায়গাগুলোতে হাজির হতে লাগল চাওয়ালা। কিছুদিন পর মাগনায় আলকাতরা খাওয়া বাঙালির নেশাটা যেই একটু চড়ে গেল, বেনিয়ার জাত ইংরেজ বুঝল ওষুধে কাজ করেছে। তারা ফ্রি চা খাওয়ানো বন্ধ করে দিল। বদলে খুবই অল্প পয়সায় চা খাওয়ানোর চল শুরু করল। তারপর যা হয়। পকেট ফুটো হতে থাকল বাঙালির আর চিলচিৎকারের আবহসংগীত শুরু হলো বাংলার রান্না ঘরে।
বাংলাদেশের বাগানগুলোতে সাধারণত আসাম জাতের চা উৎপন্ন হয়। এই চা আবার দুধ চিনি দিয়ে খেতে ভালো। আসাম বাদে ভারতের দার্জিলিং এবং এর আশেপাশের চা মূলত ব্ল্যাক টি। এই কালো চা দুধ চিনি ছাড়া খেতে হবে তার স্বাদ ও ঘ্রাণ পেতে হলে। লেখক দীপারুণ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, নতুন বছরের প্রথম চাপাতা তোলা শুরু হয়, মোটামুটি ফেব্রুয়ারি থেকে। এই পাতা স্বাদে গন্ধে ভরপুর থাকে। তাই এই চায়ের দামও হয় সব থেকে বেশি। এই চায়ের পোশাকি নাম First Flush তবে স্বাদ গন্ধ থাকলেও এই চা লিকার ততটা দিতে পারে না। মার্চের শেষ দিক থেকে বাড়তে থাকে রোদ্দুর। তখন যে পাতা তোলা হয় তাকে বলে Second Flush এই চায়ের গন্ধ একটু কম তবে লিকার বেশ ভালো। জুন-জুলাই পাহাড়ে বৃষ্টির সময়। এই সময় গাছ পাতা দেয় সব থেকে বেশি। তবে সে পাতায় তেমন সুগন্ধ বা লিকার থাকে না। এ সময়ে তোলা চা Third Flush নামে পরিচিত। এই চা বাজারে পাওয়া যায় না। এই চা মূলত অন্য সুগন্ধির সঙ্গে ব্লেন্ডিং করে বিক্রি হয়। যেমন, তুলসি, জুঁই, গোলাপ, এলাচ, লবঙ্গ ইত্যাদি। এর পর আসে শরৎকাল মানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। এ সময় যে চাপাতা তোলা হয় তা forhth Flush নামে পরিচিত। এই চা তুলনায় প্রায় Second Flush এর কাছাকাছি। চা বাগান পাহাড়ের কতটা উপরে, পাহাড়ের কোন দিকে, কেমন রোদ্দুর পায়, চা গাছের পরিচর্যা, পরিবেশ দূষণ আছে কি না, কারখানা বাগানের কাছাকাছি কি না ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে চায়ের স্বাদ এবং দাম।
একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে চা পাতাগুলো একটি যন্ত্রের সাহায্যে আকার অনুসারে চার ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো, হোল লিফ বা গোটা পাতা, ব্রোকেন বা ভাঙা, ফিনিক্স বা খুব ছোট ছোট পাতা আর টি ডাস্ট বা চায়ের গুঁড়ো। আড্ডা প্রিয় বাঙালির পরমপ্রিয় চায়ের কাপে দুধ-চিনি দেওয়া বা ছাড়া যে লিকার থাকে তা টি ডাস্ট থেকে বানানো। চিন্তার কোনো কারণ নেই, চাচি বাড়িতে যে টি ব্যাগ ব্যবহার করেন সেটিও টি ডাস্টের। সাধারণত বাজারে যত রকম ‘টি ব্যাগ’ পাওয়া যায় সবই তৈরি হয় এই চায়ের গুঁড়ো দিয়ে। অবশ্য এখন বড় পাতার ‘টি ব্যাগ’ও বাজারে এসেছে। মাসের খরচ বাঁচিয়ে শখ করে এক আধবার কেনা যেতেই পারে সেই বড়ো পাতার টি ব্যাগ।
আড্ডাপ্রিয় বাঙালির পরমপ্রিয় চা- কখনো দুধ-চিনিসহ তো কখনো দুধ-চিনি ছাড়া লেবু, আদা দিয়েও হতে পারে আবার ঋতুভেদে তাতে থাকতে পারে মরিচ-তেঁতুলসহ আরো অনেককিছু। নিয়ম করে তিন বেলা বাড়িতে চা খাবার পরেও বে-নিয়মের চাগুলো যে চাচা গলির দোকানের টংয়ে বসে সাবাড় করেন, এ সংবাদ চাচির বিলক্ষণ জানা আছে। নেহায়েত কিছু বলেন না, তাই। টং দোকান বাঙালির চা খাবার অন্যতম জায়গা। এমন মানুষও আছেন, যারা বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে এসে আবার টং দোকানে চা খান। আমাদের দেশে ‘টি বার’ নেই। কিন্তু টি বারের চাহিদা মিটিয়েছে টং দোকানগুলো। একেক এলাকায় একেক জন ‘টং মামা’ একেক ধরনের চা বানানোর জন্য বিখ্যাত। কেউ মরিচ-চা বানায় তো কেউ লাল-চা। আবার কেউ দুধ চা তো কেউ মালাই চা। দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন সেগুলোতে চা খেতে যায় নিয়ম করে।
চা মস্তিষ্কের কর্ম ক্ষমতা বাড়ায় বলে শোনা যায়। হয়ত এ-কারণে চায়ের আড্ডায় বাঙালি এত তুখোড়। এই আড্ডায় পৃথিবীর হেন কোনো কাজ নেই যা করা অসম্ভব। হবে নাই বা কেন ? এই চায়ের সঙ্গে যে বাঙালি নামটি জড়িত আছে তিনি শ্রীজ্ঞান অতিশ দীপঙ্কর। এত বড়ো নাম যার সঙ্গে জড়িত সে তো এমনিতেই মহীয়ান ! তা ছাড়া এর নামের সঙ্গে জড়িত বুদ্ধদেবের নামও। অনেকেই মনে করেন, চা প্রথম আবিস্কার করেন বুদ্ধদেব স্বয়ং। এদিকে আবার চা খেতে ভালোবাসতেন স্বামী বিবেকানন্দ আর কাজী নজরুল ইসলামের মতো হাইপ্রোফাইল বাঙালি। বাঙালির অনেক কিছুই পূর্ণ হয় না রবীন্দ্রনাথ না হলে। রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে জড়িত আছে চাচক্র প্রবর্তনের গল্প। এ উপলক্ষে তিনি ‘সুসীম চা চক্র’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর সকাল শুরু হতো প্রিয় চাকর বনমালীর হাতে বানানো এক কাপ চা দিয়ে। এহেন হাইভোল্টেজ বাঙালি যেখানে জড়িত চায়ের কায়কারবারে সেখানে সহজেই বোঝা যায় চাপান উতরে বাঙালি কেন পৃথিবীর সেরা জাতি !
অনেক হলো চা খাওয়া। এবার মন খারাপ করা একটি তথ্য দিই আপনাদের। ভারতীয় উপমহাদেরশের প্রথম টি প্লান্টার মনিরাম দেওয়ান। তাঁর পুরো নাম মনিরাম দত্ত দেওয়ান। ১৭ এপ্রিল ১৮০৬ সালে তিনি জন্মেছিলেন আসামের শিবসাগর জেলার চারিং নামক স্থানে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ১৮৩৯ সালে তিনি অসম টি কোম্পানিতে যোগদান করেন। ১৮৪৫ সালে কোম্পানির চাকরি ছেড়ে তিনি যোরহাটের সেনিমরা ও শিবসাগর জেলার চিংলৌ অঞ্চলে নিজস্ব দু’টি চা-বাগান স্থাপন করেন। গল্প এগুলো নয়। গল্প হচ্ছে তিনি, সিপাহী বিদ্রোহের কথা জানতে পেয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রাহ শুরু করার কথা বলে একটি চিঠি লিখেছিলেন রাজা কন্দর্পেশ্বরকে। পথে এই চিঠি ব্রিটিশ পুলিশকর্মী হরনাথ দারোগার হস্তগত হলে মণিরাম দেওয়ানকে কোলকাতায় গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষে বিচারের পর ১৮৫৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে জনসমক্ষে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এই হলো চা- অনেক ইতিহাস আর ঘটনার সাক্ষী। তাকে চুম্বন করতে করতেই অতীতে পৃথিবী উল্টে দেওয়ার মতো অনেক ঘটনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এখনো হয়, ভবিষ্যতেও হবে।
লেখক : লেখক, গবেষক