ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

09 Nov 2022, 12:07 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আমি এ কথা অনেকবারই বলেছি যে, বারগেন খুব সুন্দর শহর তারপরও কেন বারগেন আমার কাছে এত একঘেয়ে লাগে এটা অবশ্য আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন। বারগেন সুন্দর নিঃসন্দেহে, শুধু সুন্দর না বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে লালিত প্রকৃতিকন্যাই বলা যায় বারগেনকে, তারপরও কেন ভালো লাগে না, ভালো লাগে না অনুভূতি, উত্তরটা অবশ্য আমার জানা এবং জানিয়েছিও ; বহুবার না হলেও বার কয়েক তো বটেই। যাই হোক, মুখবন্ধ বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি, আমরা যারা ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাসিন্দা তারা সারাবছর জুড়েই রৌদ্রের ঝলকানি দেখতে অভ্যস্ত, প্রচন্ড শীত আর ঘোর বর্ষার দিনকতক বাদ দিলে এ একরকম নৈমিত্তিক ব্যাপার আর এখানে মানে বারগেনে রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিনের জন্য হা-পিত্যেস করতে হয়। sunny day যেন এখানে ঈদের আনন্দ নিয়ে আসে আর যদি বিবশবহফ এ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন পাওয়া যায় তবে তো কথাই নেই। এখানে প্রকৃতি তার ডালিতে সৌন্দর্যের সকল উপাদান সাজিয়ে নিয়ে তাতে একটু জল ঢেলে দেয় আরকি, মজা করে বললাম। আসলে অঞ্চলভেদে প্রকৃতির এই ভিন্নতাই এর সৌন্দর্য, এটা স্বীকার করতেই হবে। আর তা স্বীকার করে নিয়েই আমি অপেক্ষায় থাকি পরিষ্কার নীল আকাশের অথবা বৃষ্টিসনাথ রংধুনু রাঙা আকাশের। বারগেনে রংধনু একটি মামুলি ব্যাপার, বৃষ্টির পরে প্রায়ই আকাশ সেজে ওঠে রংধনু রঙে।

সন্ধ্যার আকাশে রংধনু


বলেছি বোধহয় বারগেনের সময়গুলোতে অথবা শুধু বারগেন না বলে বলা ভালো ইউরোপে আমার সবচেয়ে আনন্দ আর ভালো লাগার সময় কেটেছে পথে হেঁটে, তবে বারগেনের আরেকটি বিষয় ছিল আমার খুব পছন্দের, সেটা হচ্ছে water body, আগেই বলেছি শহরটি প্রায় সমুদ্রের খাঁজে অবস্থিত, এর শিরা-উপশিরায় ঢুকে আছে সমুদ্রের খাড়ি, এছাড়া এখানে-সেখানে রয়েছে লেক বা জলাধার, খালের বিস্তারও কম নয়। বারগেনে আমরা যে জায়গাটায় থাকতাম তার আগে পরে প্রায় এক স্টপেজ পরপরই লেকের দেখা মিলে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল স্লেতেন (sletten) লেক, যা ফ্যানটপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে একটা স্টপেজ পরেই। আমরা বারগেন পৌঁছানোর পরদিনই অবশ্য এই লেকের দেখা পাই, মূলত এশিয়ান শপ খুঁজতে গিয়ে ফেরার পথে আমরা এ লেকটা ক্রস করি। প্রশ্ন জাগতেই পারে এশিয়ান শপ কী এবং কেন ? কী, এটা নামেই বোঝা যায়, মূলত এশিয়ার লোকজনের মালিকানাধীন অথবা পরিচালনাধীন দোকানগুলোই এশিয়ান শপ। এগুলোর প্রত্যেকটিই ছোটোখাটো ওয়ান স্টপ মলের মতো। আমরা যারা দেশীয় স্বাদের খাবার চাই একই সাথে হালাল খাবার খুঁজি তাদের জন্য ইউরোপে এশিয়ান শপের বিকল্প নেই। মূলত পাকিস্তান, ইরান, মঙ্গোলিয়া, নাইজেরিয়ান দোকানগুলোই এখানকার প্রবাসী মুসলিমদের জন্য ভরসা। বলছিলাম লেকের কথা, চলে এলাম গোসারি শপে। এটা ঠিক, এই চলতি পথেই কিন্তু অচেনা পথ চেনা হয়, অজনাকে জানা হয়। সেদিন শুধু লেকটির একধার ধরে হেঁটে মেট্রো স্টেশনে চলে এলাম তবে এই অল্প সময়েই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য মনে দাগ কেটেছিল। যেহেতু এটা অনেকটা বাড়ির পাশে আরশীনগর সেহেতেু আসা তো হবেই, এর মধ্যে অবশ্য দু’-একটা ছবি যে তোলা হলো না, তা কিন্তু নয়।


সামাজিক পাখিদের মাঝে লেখক

এরপর যথারীতি ক্লাস আর দিন-যাপনের অন্যান্য কাজে যেতে আসতে যখনই ট্রেন স্লেতেন এ পৌঁছে তখনই মনে হয় নেমে যাই। তবে, যাই যাই করেও কিন্তু যাওয়া হয় না। আর ছুটির দিনগুলোসহ অন্যান্য দিনগুলোতেও প্রায়ই আকাশ তুমুল কান্নাকাটি করে তাই দেখে মন খারাপ করে আমার ঘরবন্দি সময়ই কাটে। সব কিছুরই তো সীমা থাকে কিন্তু এখানকার আকাশের কান্না যেন কোনো সীমারেখার ধার ধারে না, তাই বলে আমি আর কতটা ঘর বন্দি থাকতে পারি। ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে’ এই ভাবনাতে একদিন ঝর-ঝর বৃষ্টির মধ্যেই আমি আর ফারজানা বেরিয়ে পড়লাম। এ যেন অনেকটা ধনুর্ভাঙাপণ, যাই ঘটুক আজ আর ঘরে থাকব না, বাড়ির পাশের আরশীনগরে যাবই যাব। যেহেতু তখনো আকাশ তার ন্যাকা কান্না কেঁদেই চলেছে তাই আমরাও বর্ষাতি নিয়ে প্রস্তুত হয়েই বের হলাম। হোস্টেল থেকে বেরিয়েই বাতাসের প্রথম দমকায় প্রায় জমে যাওয়ার জোগাড়। এই ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ট্রেন থেকে নেমে একটি দোকনে ঢুকলাম কফি কিনব বলে, জানা না থাকলে যা হয়, অটো মেশিন থেকে কফি নিলাম ঠিকই তবে তা যেন আর খাওয়ার যোগ্য হলো না, কফি যে এত তিতকুটে হতে পারে তা আমার জানা ছিল না ; একে মোটামুটি খাবার যোগ্য করে তুলতে বেশ খানিক দুধ-আর চিনি মেশাতে হলো। কী নিয়েছিলাম তা আর মনে নেইamericano না coffee latte কিছু একটা হবে হয়ত, যাই হোক, যা ছিল তা মোটামুটি খাবার অযোগ্য। অনেকটা ঠান্ডা আর অন্য দিকে টাকার মায়ায় ফেলতেও পাচ্ছিলাম না। কফিমগ হাতে করে আমরা ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে লেকের সীমায় প্রবেশ করলাম, এরই মধ্যে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলো। আজ পুরো লেকটি চক্কর দেব এমন উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু আসা। এতদিন দূর থেকে যে লেকটি দেখেছি মুখোমুখি এর রূপ যেন আরো অপরূপ হয়ে ধরা দিল। আগে কখনো বলেছি কি না জানি না, বারগেনের এই লেকগুলোকে ঘিরে হাজারো জাইগার বা স্কুয়া প্রজাতির পাখির বাস। এরা খুব সামাজিক পাখি, মানুয়ের সাথে তাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। আসলে এখানকার জনগণও খুব পশুপাখি বৎসল, পাখিদের কোনো ক্ষতি তো এরা করেই না বরং নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে এদের খাবার কিনে খাওয়ায়। অবশ্য পশুপাখি নিধনের ক্ষেত্রে আইনি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও এখানে খুব কঠোর। পাখিরা নিশ্চিত জানে বলেই হয়ত মানুষকে এড়িয়ে চলে না বরং নিশ্চিন্তমনে তাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খায়। আজ আমরাও পাখিদের খাবার খাওয়ালাম। তারপর লেকের শান বাঁধানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। মাঝারি আকৃতির লেক ; তবে, আমাদের ধানমন্ডি লেকের সাথে তুলনা করলে অবশ্য একে পুকুরের কাতারে ফেলতে হবে। আয়তন যাই হোক লেকের পুরো এলাকাটাই নির্মল পরিছন্ন আর শ্যামল মায়ায় ঘেরা। পুরো লেকটাই যেন এক বিশাল আয়না, যেখানে আকাশ যতটা পারছে তার নিজের প্রতিবিম্ব মেলে ধরে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে। আসলেই সেজেছে আকাশ, আকাশের পূর্ব-পশ্চিম আড়াআড়ি করে এক রংধনু যেন রামধনু হয়েই ফুটে উঠেছে।


সবুজ চত্বরে লেখক

লেক এলাকাটি কিন্তু শুধু লেকের জলেই সীমাবদ্ধ নেই, রয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, ওভালশেপের সবুজ চত্বর, হঠাৎ দেখায় গলফ মাঠ বলে ভুল হতে পারে। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয দিকটি ছিল একধারে আকাশছোঁয়া গাছের সারি। আর শেষ শরতের এই সময়টাতে গাছগুলো সব বর্ণিল রঙে সেজে রয়েছে। একে তো বৃষ্টিধোয়া স্নিগ্ধ চরাচর তার উপর আকাশ আর বৃক্ষরাজির এই পাল্লা দিয়ে সাজগোজ এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য। লেকটাতে কিন্তু শুধু সৌন্দর্য পিয়াসীদের আনাগোনা তা নয় বরং সৌন্দর্য আর সচেতনতা এই দু’য়ের মেলবন্ধন এখানে বেশি মাত্রায় চোখে পড়ে। পায়ে কেডস, মাথায় ক্যাপ আর কানে গোজা হেডফোনের কর্ড, ছিপছিপে তরুণ-তরুণী কেউ দ্রæতলয়ে কেউ বা মাঝারি গতিতে লেকের শান-বাঁধানো পাড় ধরে চক্কর কেটে চলেছে। এখানে সবাই তরুণ তা বয়স যাই হোক। আর আমাদের মতো আগন্তুক এখানে হাতে গোনা, যেমন আজ এ বেলায় শুধু আমি আর ফারজানা এ দু’জনই।


তিতকুটে কফি হাতে হাঁটাহাঁটি

স্লেতেনের এই লেকটি নিয়ে বলতে গেলে আরেকটি বিষয় বলতেই হয়, সেটা হচ্ছে এর লেকের জলের এলোমেলো চলার স্বাধীনতাকে অক্ষুণœ রাখতে ছোটো ছোটো কাঠের সেতু দিয়ে পথচারীদের পথকে মসৃণ করার পাশাপাশি যে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা কিন্তু অসাধারণ। মনে হতেই পারে এ আর এমন কী ? এটাই তো স্বাভাবিক। হ্যাঁ স্বাভাবিকতাটা যত্নে আর ভালোবাসায় অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। পুরো লেকটি ঘুরে আসতে আমাদের ঘণ্টা দেড়েকের মতো সময় লেগেছে, অবশ্য এতটা লাগার কথা না ; লেগেছে কারণ আমরা টানা হাঁটিনি, যেখানটায় ভালো লেগেছে সেখানেই বসেছি কিছুটা সময় নিজেরা গল্প করেছি, ছবি তুলেছি আবার হেঁটেছি। আকাশ যখন পুরোটা লালিমায় ছেয়ে গেছে তার আবিরের আভা মনে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। ততক্ষণে শীত আরো জাঁকিয়ে নেমেছে, তাই না ফিরেও উপায় ছিল না। 

[চলবে]