কোন জ্বরের কী চিকিৎসা

06 Oct 2022, 12:11 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
কোন জ্বরের কী চিকিৎসা

বর্তমান সময়ে ঘরে ঘরে জ্বরজারি লেগেই আছে। অনেকে শর্দিজ্বরে ভুগছেন। আবার অনেকেই ভুগছেন ভাইরাস জ্বরে। এই সমযয়ে যেকোনো জ্বরকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাছাড়া বিভিন্ন জ্বরের চিকিৎসাও বিভিন্ন রকমের। তাই ঠিক চিকিৎসা দেওয়ার আগে জ্বরের ধরন চিহ্নিত হওয়া খুবই জরুরি। নানাধরনের জ্বরের উপসর্গ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হলো

ডেঙ্গু

ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে তার কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ব্যক্তি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগ ডেঙ্গুজ্বর ছয়-সাত দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। তবে হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি। সময়মতো ঠিক চিকিৎসা না নিলে ঝুঁকি থাকে।


লক্ষণ

* প্লাটিলেট কমে যায়। শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া ও চোখ ব্যথা, চোখ থেকে পানি পড়া, অরুচি বা বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয়।

* বিভিন্ন স্থানে হামের মতো র‌্যাশ হতে পারে।

* হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু হলে দাঁত ও মাড়ির গোড়া থেকে, নাক দিয়ে বা বমির সঙ্গে, পায়ুপথসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তপাত হতে পারে।


চিকিৎসা

* রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে

* যথেষ্ট পরিমাণ পানি বা তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে

* জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রূপের ওষুধ ছাড়া ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাকজাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে

* রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে

* কারো ডেঙ্গুজ্বর হলে মশারি ব্যবহার করে রোগীকে আলাদা রাখতে হবে। এতে অন্যরাও ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাবে

চিকুনগুনিয়া

ডেঙ্গুজ্বরের মতোই ভাইরাসজনিত একটি রোগ চিকুনগুনিয়া। এটি ছড়ায় স্ত্রীজাতীয় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে। চিকুনগুনিয়া হলে শরীরের ১০ ভাগ বা তারও বেশি জয়েন্টে আক্রমণ করতে পারে। তবে, এটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।


লক্ষণ

* চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গজ্বরের মতোই, তবে দেহের তাপমাত্রা একটু বেশি [প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত] থাকে। সাধারণত দুই থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া থাকে এবং একসময় নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়

* হাত বা পায়ের আঙুল, গোড়ালি, কবজি, মেরুদÐ বা অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথার সঙ্গে তা ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা থাকতে পারে

* তীব্র মাথাব্যথা, মাংসপেশীর দুর্বলতা দেখা দেয়

* জ্বর কমে যাওয়ার পর ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যথা চলে যায়। বাকি ৩০ শতাংশের ব্যথা বেশ কিছুদিন থাকে

* ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যায়, রক্তক্ষরণের ঝুঁকি, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও থাকে, চিকুনগুনিয়ায় এসব থাকে না

চিকিৎসা

* এডিস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া হয় বলে এ থেকে বাঁচতে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস ও মশা নির্মূল করা উচিত

* রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি, ফলের জুস বা অন্যান্য তরল খাবার খেতে দিতে হবে

* সংক্রমিত অবস্থায় সব ধরনের সামাজিকতা এড়িয়ে চলতে হবে

* চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এ রোগের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা নেই

* প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। এতে জ্বরের পাশাপাশি ব্যথাও কমে যায়

* ব্যথা বেশি হলে এনএসএইড ছাড়া সাময়িকভাবে ট্রামাডল গ্রূপের ওষুধ দেওয়া যেতে পারে

* গলা ব্যথা থাকলে লবণ ও গরম পানি দিয়ে ঘন ঘন গার্গল করতে হবে

ম্যালেরিয়া

সংক্রমিত অ্যানোফিলিসজাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া জ্বর হয়। পরে এর জীবাণু লালার মাধ্যমে প্রোস্টেটের সংবহনতন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং যকৃতে পৌঁছে। সেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশবৃদ্ধি ঘটায়।


লক্ষণ

* উচ্চমাত্রায় জ্বর, বমি বমি ভাব ও মাথাব্যথা থাকে

* এই রোগের প্রধান লক্ষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, যা ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে

* মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব

* মাথা ধরা, অনিদ্রা

* রুচিহীনতা বা ক্ষুধামন্দা

* কোষ্ঠকাঠিন্য, হজমে গোলযোগ, বমি বমি ভাব বা বমি

* অত্যধিক ঘাম হওয়া, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা ইত্যাদি


চিকিৎসা

* কারো ম্যালেরিয়া হয়েছে এমন সন্দেহ হলে দ্রæত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত

* রোগটি কোন ধরনের ম্যালেরিয়া বিষয়টি নির্ণয় করতে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। তবে তা অবশ্যই ওষুধ শুরু করার আগে হতে হবে

* ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় গেলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে


টাইফয়েড

সাধারণত ‘সালেমানেলা টাইফি’ ও ‘প্যারাটাইফি’ জীবাণু থেকে টাইফয়েড নামের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে টাইফয়েড জ্বর হয়ে থাকে। টাইফয়েডের অন্যতম কারণ হলো দূষিত খাবার গ্রহণ।


লক্ষণ

* ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, চামড়ায় লালচে দানা দেখা দেওয়া টাইফয়েডের প্রাথমিক লক্ষণ

*  প্রচন্ড মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, পেট ব্যথা, দুর্বলতা।

* তাপমাত্রা হতে পারে ১০৩-১০৪ ফারেনহাইট। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই জ্বর প্রথম দিকে ধরা পড়ে না


চিকিৎসা

* টাইফয়েড হয়েছে কি না, তা বুঝতে সবার আগে অসুস্থ ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করতে হবে

* পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। খাবার গরম করে খেতে হবে

* পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে

সর্দি-কাশি-ইনফ্লুয়েঞ্জা

হঠাৎ গরম বা ঠান্ডাজনিত আবহাওয়ার কারণে সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। এটি একটি কমন সমস্যা, এই সময়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।


লক্ষণ

* গলা ব্যথা, খুসখুস ভাব, নাক বন্ধ বা অনবরত হাঁচি

* মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেওয়া

* জ্বর পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে গেলেও সর্দি বা কাশি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে

* সাইনাস, টনসিলে প্রদাহ, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হতে পারে। সর্দি বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ থাকতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে

* অ্যাজমার রোগীদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে।


চিকিৎসা

* ঠান্ডা, বাসি খাবার, পানীয়, ধূমপান পরিহার, ধুলাবালি এড়িয়ে চলা

* সতেজ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা

* চোখ বা নাক মোছার পরপরই হাত ধোয়া

* আদা-লং-এলাচ-লেবু চা, তুলসীপাতা, মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে উপকার মেলে

* অ্যান্টিহিস্টাসিনজাতীয় ওষুধ, প্রয়োজনে কাশির সিরাপ সেবন বা নাকের ড্রপ ব্যবহার করা যায়

* অ্যাজমার রোগীরা ধুলাবালি বা ঠান্ডা এড়িয়ে অ্যালার্জির ওষুধ বা ইনহেলার ব্যবহার করলে ভালো থাকবেন

* গলা ব্যথা বা অস্বস্তির ভাব কাটাতে কুসুম কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে ঘনঘন গার্গল করলে ভালো ফল পাওয়া যায়


বাত জ্বর

বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার হলো জ্বর-সহ শরীরের অস্থিসন্ধি, গিরা বা গাঁটগুলোর প্রদাহজনিত একটি রোগ। আক্রান্ত রোগীর শরীরে জ্বর ছাড়াও তীব্র ব্যথা হতে পারে। তবে একধরনের জীবাণুর সংক্রমণে গলায় ব্যথা বা টনসিলের প্রদাহ বাতজ্বরের প্রধান উৎস।


কারণ

অস্বাস্থ্যকর ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে শিশুরা স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়। গলায় প্রদাহ বা গলাব্যথা, বারবার টনসিল আক্রমণ, জ্বর ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর শরীরের গাঁটগুলো একটির পর একটি আক্রান্ত হয়ে ফুলে যায়। ফলে তীব্র ব্যথা হয় এবং চলাফেরার অসুবিধা হয়। ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অপরিষ্কার এবং অজ্ঞতাই বাতজ্বরের প্রধান কারণ। যেসব শিশুর দীর্ঘদিন পাঁচড়া ও টনসিলের রোগ থাকে তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

শুরুতে কিছুদিন গলাব্যথা, কাশি, জ্বর। তারপর দুই থেকে তিন সপ্তাহের বিরতি।

সাধারণত একটি বড়ো গাঁটে ব্যথা এবং ফুলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সেরে গিয়ে আরেকটি বড়ো গাঁটে আক্রমণ করে।

গাঁটগুলোতে আক্রমণ করার ফলে গিরা ফুলে যায়, তীব্র জ্বর এবং অত্যাধিক ব্যথার কারণে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়।

চামড়ায় লাল দাগ বা চামড়ার নিচে উঁচু গোটা হতে পারে।

শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা দেখা দিতে পারে। হৃৎপিন্ড প্রদাহের ফলে বুক ধড়ফড় করতে পারে।

অল্প বয়সে রোগটি হয় বলে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

খাদ্য অরুচি, পায়ে পানি আসা, প্রচন্ড  দুর্বলতা অনুভব হতে পারে।

মাস্তিষ্ক প্রদাহের ফলে কাঁপুনি, খিচুনি দেখা দেয়।

স্নায়ুর প্রদাহের ফলে অনিয়ন্ত্রিত অঙ্গ সঞ্চালন হওয়া ইত্যাদি।


চিকিৎসা

বাতজ্বর চিকিৎসার জন্য প্রথমে রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এতে হৃৎপিন্ড হতে কাজের চাপ কমায়। ফলে হৃৎপিন্ড দ্রুত সেরে উঠতে পারে। বাতজ্বর চিকিৎসার জন্য রোগীর ইতিহাস ও লক্ষণের উপরে নির্ভর করে চিকিৎসা নিতে হবে।

প্রয়োজন হলে জীবাণুনাশক, ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড দেওয়া হয়।

রোগ নির্ণয় হওয়ার পর দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নিকটে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট