রবির ছবি -আশরাফ হোসেন

04 Jul 2022, 01:31 PM অন্যান্য শেয়ার:
রবির ছবি  -আশরাফ হোসেন

কবিতা চিত্রকে ধারণ করে আর চিত্রকবিতাকে আত্মস্থ করে। মালা গাঁথে, তাতে সুই থাকে, সুতো থাকে, রং থাকে, থাকে নানা বেদনার ব্যঞ্জনা- কখনো তা বেগবান, কখনো তা স্থির। যখন সে বেগবান তখন সে অনেক দূরের, আর যখন সে স্থির তখন সে খুব কাছের, প্রাণের। যখন সে দূরে তখন সেখানে আলো থাকে, ছায়া থাকে, ঝাপসা হলেও দূর থেকে তা অনুভ‚ত হয়। কিন্তু কাছে গেলেই যেন মরীচিকা। আর যখন তা স্থির হয়ে রয়ে যায় তখন সেখানে সব বিলীন হয়ে যায়। সেটা কি-বা দূর, কি-বা কাছে। কি-বা আলো, কি-বা ছায়া। কি-বা ছুঁই, কি-বা না-ছুঁই। এ এক অনির্বাচনীয় হৃদয় গহীনে সুর উঠে আর পড়ে। শ্রæত হয় মূর্ছনার ঐক্যতানে প্রাণের গহীনে। এখানে সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিলীন হয় কবিতায় চিত্র, চিত্রে কবিতা। যেখানে আমাতে তুমি আর তোমাতে আমি।

সুখ ও বেদনার দ্যোতনায় তানপুরাটা বেজেই চলে বাদকের ছোঁয়ায়। নচেৎ সে যেন নকশা করা এক টুকরো কাঠের বস্তু। বাদক ছুঁয়ে দিল কী- অমনি সুখ আর বেদনার সুর মর্মে এল, মনের কথাগুলো রঙের ভেতর খেলতে শুরু করল আর ভাবকে উৎসারিত করল শব্দহীন ব্যঞ্জনায়। সে ভাবেই যেন উপচে পড়তে লাগল চিত্রের মধ্যে শব্দ নিঃশেষ হয়ে। আর ভাবগুলো আদান-প্রদান করতে লাগল নিজের সঙ্গে অন্তরে অন্তরে।

সেই যে কবে লিখতে শুরু করেছিল তখন থেকেই এঁকে চলছিলেন। এ নতুন কিছু নয়। কত যে লিখেছেন আর কত যে কেটেছে, কী অদ্ভুত- যতবার কেটেছেন যেন ততবারই এঁকেছেন। না- বাস্তবতার সঙ্গে তেমন কোনো মিল নেই। মানুষের ছবিগুলোর মধ্যে কিছু মানুষ বোঝা গেলেও পশু পাখি দেখে মনেই হয় এরা এ গ্রহের নয়। কিন্তু পশুর ছবি গুলোই কত রকম কত ঢঙের।

ছবি হচ্ছে একটা ফর্মের হারমোনি একের পর এক রং লেপন, ঘষে ঘষে আবার এলোমেলো তার ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে আসে যা চাচ্ছিল ঠিক সেটিই। যেন সকল রঙের ছন্দের সমাবেশই একটি রূপের প্রকাশ করছে।

তার এই কাজ ইনটার্নাল হিউম্যিলিটির একটা ঐকতান খুঁজে পাওয়া যায়। যা প্রকারান্তে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপ মুখোশের আড়ালে ক্রমবর্ধমান রহস্য মাত্র। তার ছবিতে প্রেমময় আবেদন রয়েছে তবে তাতেও রহস্যাবৃত, সর্বজনীন এবং স্বাতন্ত্র্য ভাব, ভাষা, স্টাইল।

তিনি যখন ৬২ বছর বয়সে ছবি আঁকতে শুরু করলেন নিজের ভেতর একটা পরিবর্তন দেখতে পেলেন। তিনি লেখার সময় এ পর্যন্ত প্রকৃতির তাবৎ বস্তুকে কম দেখেননি আর তাদের নিয়ে রচনার ভাÐারও কম নয়। কিন্তু যেই ছবি আঁকার জন্য তৈরি হলেন তিনি তখন গাছের ডাল পাতায় নানা রকম অদ্ভুত জীবজন্তুর অবয়ব দেখতে পেলেন। তিনি অবাক হয়েছেন বার বার এ দেখা তার একেবারেই নতুন দেখা। তিনিই সে কবিতার রবি।

নিজে থেকেই বললেন- “ছবি কোনোদিন আঁকিনি আকবো বলে স্বপ্নেও বিশ্বাস করিনি। জীবনের সকল কিছু যখন শেষ হয়ে এল তখন অভূতপূর্ব উপায়ে জীবনদেবতা এর পরিশিষ্ট করবার উপকরণ জুগিয়ে ছিলেন।”

প্রতিমাদেবীকে লেখা চিঠিতে ১৯৩০-এ তিনি এভাবেই নিজেকে ব্যক্ত করেছিলেন।

“টুকরো যত রূপের রেখা

সঞ্চিত হয় মনের চিত্রশালে

কখন ছবির আকার নিয়ে

জোড়া লাগায় শিল্পকলার জালে”

তার মনোজগতে যখন কোনো একটা রূপ হঠাৎ জেগে উঠল তখন তিনি যেন নানা ভাবে দেখতে পেতেন যেমনটা দেখতেন সালভাদার দালি “পাত্র ছাড়া ডিম সিদ্ধ কিংবা এরকম আরো অনেক কিছু।”

বিছানায় শুয়ে পুরোনো দেয়ালে সুড়কি উঠে যাওয়া ক্ষতস্থানে নানা মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি। আমিও এমন দেখতাম আমার ৬/৭ বছর বয়সে ; মুখে জল নিয়ে কুলি করতাম কোনো শুকনো দেয়ালে। কোনোটা মানুষের অবয়ব কোনোটা পশুর। পুরানো ঢাকার বাড়ির দেয়ালগুলো চুনসুড়কিরই ছিল। শুয়ে শুয়ে দেখতাম দেয়াল থেকে খয়ে যাওয়া চুন সুড়কির ফাঁকে মানুষ, গোরু, ছাগল, কখনো ভূতও দেখতাম। এখন ভাবি, আমার দেখা ভুল ছিল না। তখন না জানলেও এখন জানি, রবীন্দ্রনাথও তো এমনি দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্ট হচ্ছে রসের বাহন যা দেখে আনন্দ পাওয়া যায়। আর সেই আনন্দরস যখন অন্যের মধ্যে সঞ্চালন করে দেয়া যায় তখন সেটাই আর্ট। সেটা হোক আঁকা, গান কিংবা সাহিত্য।

রবীন্দ্রনাথ তার সকল সৃষ্টির ভেতর দিয়ে এক আনন্দরস সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি জানতেন সাহিত্যের মতো সৃষ্টিশীল কলা সত্যি ক্ষণস্থায়ী। অনেকটা নদীর স্রোতের মতো কেবলই যাচ্ছে আর নতুন আসছে। তবে ছবির ব্যাপারে কবির চিন্তা এমন নয় এটা খুব দৃঢ় ভাবেই জানতেন যে, ছবি পশ্চিমের জন্য। এখানে ছবি বোঝে না। অন্তগামী পশ্চিমারাই বোঝে তাই তিনি তার আঁকা ছবি নিয়ে সংকল্প করেছিলেন একটা ছবিও দেশে নিয়ে আসবেন না।

একদিন রানি চন্দ্রের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, তিনি ছবিতে একবারেই রং দেন না। আগে পেন্সিল ঘষে ঘষে একটা রং করে নেন। তারপর আবার রং চাপান। এভাবে রং করলে তিনি মনে করতেন রংটা জোরালো হয়। রঙের উপর রং চাপানো, আর ছবি যখনই সুন্দর হয় ঠিক তখনই তা নষ্ট করে দিতেন। কখনো কালি ঢেলে দিতেন কখনো-বা এলোমেলো আঁচড়ে কাটাকাটি করতেন।

তবে তাঁর কবিতা কাটতে গিয়েও এমন এলোমেলো আঁচড় দিতেন, সেখানে ওই কাটাকুটির মধ্যে আমরা অনেক মানুষের মুখাবয়ব অন্য কোনো নাম না জানা পশুর অবয়ব দেখেছি যা তিনি ইচ্ছে করেই করেছেন- এভাবেই রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা কেটেছেন ব্যবচ্ছেদ করেছেন বারবার। ওর ভেতর থেকেই সৃষ্টি করেছেনে একের পর এক কবিতা। এক একটি ছবি আঁকতে গিয়ে তাকে নষ্ট করেছেনে আবার তা পুনরুদ্ধার করেছেন। তিনি তার আশপাশের মানুষ অন্যান্যদেরও এভাবেই দেখেন। তিনি নিজেই বলেছেন ছবি নষ্ট হয়ে যায় তখন তাকে আবার উদ্ধার করি। আমি মানুষের জীবনটাও এমন করে দেখি।

জীবনচর্চার গোড়াতেই দেখেছি তার প্রতিভা সৃষ্টির বিচিত্ররূপ এবং সাহসিকতা। কবিতায় তার সাহসিকতা কতটুকু তা বুঝে উঠতে না পারলেও তার ছবি দেখলে স্পষ্টই প্রতিয়মান, তিনি চরম দুঃসাহসিক ও দৃঢ়। তার ছবির প্রতি এহেন প্রেম না জন্মালে বাষট্টি বছর বয়স থেকে আশি বছর পর্যন্ত এত অল্প সময়ে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ছবি আঁকা সম্ভব ছিল না। এ যেন দুর্বার গতিতে হয়েছে। কোনো একটি ছবিতে মনে হবার যোগাড় নেই যে একটি ভুল রেখা দিয়েছে বা রেখাটি যতটুকু যাবার দরকার ছিল ততটুকু যায়নি। কম বা বেশি, কী অসাধারণ তার পরিমিতিবোধ। অবশ্য নিজ জীবন চর্চায়ও ছিল যথেষ্ট পরিমিতি বোধ। তিনি জানতেন কার সঙ্গে কতটুকু বলতে হবে, খেতে হবে, চলতে হবে, হাসতে হবে। রবীন্দ্রনাথের এই পরিমিতি বোধ ছিল টনটনে। যা আমাদের জীবনচর্চায় যতটা না আছে তারচেয়ে অধিক পরিমিতি বোধ রবীন্দ্রনাথের ছিল।

ছবি আঁকার প্রস্তুতি তার আজকের নয়। সেই ছোটো বেলায় স্কুলের পাঠ শেষ করে বাসায় ফিরতেই ড্রইংমাস্টার হাজির হতেন, তবে সেটা বেশি দিন নয়। অবনীন্দ্রনাথের আঁকাও দেখেছেন। দেখেছেন একের পর এক দেশ ও বিদেশের বিচিত্ররূপ। এ মহাকালের যাত্রায় তিনি শুধু বিশ্বশিল্পীর সৃষ্টি দেখেন নি, তিনি দেশ ও বিদেশের বহু শিল্পীর সৃষ্টি দেখেছেন। সেখান থেকেই কিছু নিয়েছেন কিছু ফেলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কাজ কারো মতো নয়। নিজের মতোই।

তিনি যেন এতটা বছর ধরে শুধু কুড়িয়েছেন মানুষের চরিত্র, মানুষের ব্যবহার আচার, আচরণ, প্রেম আনন্দ এবং জীবন ধারণ। যে ভাবে মানুষকে ভালবেসেছেন সেভাবেই যেন তার সমস্ত ভালবাসা নিংড়ে ফেলে দিয়েছেন তার সৃষ্টি কর্মে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার চর্চাটা নেহাতই একষট্টি বা বাষট্টি বছর বয়স নয় বরং শিশুকাল থেকেই। চিত্রকলার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় এবং নিগুঢ় সম্পর্ক ছাড়া এ-ধরনের সম্বোধন হতে পারে না। বিশেষ করে তার রেখা ও রঙের সাথে এ সম্বোধনের কোনো নাম নেই। কারণ, এ কোনো আত্মীয়তা নয়। এ এক অন্যরকম প্রেম। কবির সঙ্গে কবিতার যে সম্পর্ক সম্বোধন তেমনই চিত্রকরের তার চিত্রের সঙ্গে। তাই হয়ত তিনি তার ছবির কোনো আখ্যা দিতেন না। কখনো তার কবিতা যেমন ছবি হয়ে উঠেছে আবার কখনো ছবি দেখলেও মনে হতো এ শুধু ছবি নয়, এ যেন কবিতার শেষ হয়েও শেষ হয়নি এমন রেশটুকু। আর সেই ছবিগুলোই যেন কবিতা হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথ তার ছবিতে নিজস্ব বিশ্বাস, সাহসকে স্পষ্টতর করেছেন গভীরভাবে। তিনি দেশ-বিদেশের বহু শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, বিনিময় করেছেন। সে-সময়ে পশ্চিমে, ইউরোপে ছবির উপর বেশ ইজম আন্দোলন চলছিল, নতুন নতুন চিন্তার প্রভাব বিস্তার পাচ্ছিল। সে-সব থেকেও তিনি নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ সময়ে এসে রবীন্দ্রনাথ চিত্রকর হয়ে ওঠার পেছনে ওকাম্পোর একটা প্রভাব আছে বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথ তার ছবি সম্পর্কে একটি কথা বলেছিলেন, ছবি আঁকার এ শখ যেন তার শেষ বয়সের প্রিয়া। রবীন্দ্রনাথ যখন আর্জেন্টিনায় যান, সেখানে তিনি ওকাম্পোর বাড়িতেই উঠেছিলেন পূরবী কাব্যগন্থটি সৃষ্টির সময়ে।

রবীন্দ্রনাথের নানা সময়ে নানা ধরনের খাতা ছিল। ছোটো বড়ো নকশা করা, সে-রকমই একটি ছোটো খাতায় কবিতা লিখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়িতে। মাঝে মাঝে খাতাটা খুলে অন্য কোথাও গেলেই ওকাম্পো এসে খাতার পাতা উল্টাতেন দেখতেন আর বিস্মিত হতেন। মুগ্ধ হতেন এই ভেবে যে, তার লেখার মাঝে ভুল জায়গার কাটাকাটি দেখে। সেই কাটাকাটির মধ্যে যে কত রসবোধ তৈরি হতো সে আনন্দ যেন রবি নিজেই পেতেন। এই কাটাকুটি থেকে নানা অবয়ব সৃষ্টি হতো। কখনো দানবের মতো কখনো সরীসৃপের মতো আরো নাম না-জানা কত পশু পাখির মুখ। তবে এটা ‘পূরবী’র  পাণ্ডুলিপিতেই নয়, ওকাম্পোর বাড়িতে আসার আগেও অনেক খাতার কবিতাতেই এরকম কাটাকুটি করেছেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘রক্তকররী’র  পাণ্ডুলিপি খসড়া পাতাতেও একই কাজ করেছেন। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘মালতি’ নামে একটি পুঁথির পাতায়ও ছবি এঁকেছেন। কবির পকেটে একটা নোটবুকের মতো থাকত, তবে এটা ১৮৮৯-এর দিকে। এর মধ্যে যখন যা মনে আসত, এঁকে ফেলতেন। তবে, একনাগাড়ে কখনোই কাজ করেননি। কারণ, তিনি তখন শব্দের মোহে ছিলেন। তিনি ছবি আঁকায় পুরো মন দেন ১৯২৮-এর দিকে। ওকাম্পোর বাসায় বসে কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতাকে টেনে হিঁচড়ে যতবার ব্যবচ্ছেদ করেছেনে ততবারই সেখানে নতুন কোনো সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেখে ওকাম্পো একদিন কবিকে ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন-

“শেষে না তুমি ইচ্ছে করেই বাজে কবিতা লিখ। যেভাবে ভুল কবিতায় কলম চালিয়ে আনন্দ পাও।” সত্যি এতে রবির এক আনন্দের বিষয়ও ছিল।

মানুষ স্বপ্ন দেখে, রবীন্দ্রনাথও দেখেছিলেন, পার্থক্য রবি তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। সময়কে নিজের মতো করে সাজিয়ে কাজ করেছেন। যা তার সাজানো সময়টাকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্র্ণ হয়েছে। যেমন নদীর বুকে স্রোতের রেখা বয়ে যায়, তেমনি।

এই স্বপ্নগুলো ছিলো অন্য শিল্পীদের থেকে আলাদা, অভিনব এবং নতুন। তাই পূর্বের অনেকেই তখন এবং এখনো তা গ্রহণ করতে পারেনি। পারছেও না। নতুনকে গ্রহণ করতে পারাটা বিরাট চিত্তের প্রয়োজন। সম্ভবত এটা এখনো আমাদের তৈরি হয়নি। কারণ, রবীন্দ্রনাথের কাজ ধরাবাঁধা একাডেমিক বা মাস্টার মশাইদের কোনো নিয়মের মধ্যে নয়। মানুষ যা দেখে, যা করে অভ্যস্ত সেটা করতে চায়, দেখতে চায়। আর এর বাইরে যেহেতু যায় না এবং চিন্তাও করে না সেহেতু মানসিকতা একটা গণ্ডির মধ্যেই বাঁধা থাকে। তাই তিনি বলেছিলেন, “যাই হোক আমার চিত্রলীলার দিগন্ত এই পশ্চিম উপকূলেই। অস্তগমন কালেরই শেষ বর্ণবিন্যাস। স্বদেশে একটু তার আভাস মাত্রেই যেরকম শব্দভেদী বর্ণের টংকার শোনা গেল, তাতে বুঝলুম এই চিত্রগুলোর উপলক্ষে আমার বিরুদ্ধে  বিদ্রুপের বৈচিত্র্য ঘটবে মাত্র। সংকল্প করে এসেছি এই ছবিগুলির একটিও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাব না।” আরও বলেছিলেন, “আমার লিখা দিয়ে গেলাম পুবে। যদিও লেখাগুলোর ভাষা বদলে যেতে পারে। তাতে আফসোস নেই। ভাষা পরিবর্তনশীল কিন্তু ছবি দিয়ে গেলাম পশ্চিমে যারা ছবি বুঝে তাদের।”


রবির ছবি

রবীন্দ্রনাথ তার ছবিতে অবহেলা বা খামখেয়ালি করেননি যে সব রথীরা এসব বলেন, তারাই কিছুটা রবির ছবির প্রতি খামখেয়ালিপনা করেন। রবির ছবিতে রেখার ছন্দময়তা রঙের বিন্যাস ও বুনট, ভাব ও তার প্রকাশ ছিল প্রাণময় মননে উজ¦ল সরলতায় রেখার চঞ্চলতায় ছবিকে দিয়েছে ভিন্নতা, দিয়েছে নব বৈচিত্র্য। তাঁর ছবির ফর্মগুলো ফর্ম হিসেবেই ধরা দিত। যেন নতুন বিশ্বাস নতুন সম্ভাবনার খোঁজ পেত। এ যেন এগিয়ে যাবার রসদ। তার ছবিতে আলো, ছায়া, পারসপেক্টিভ, ডাইমেনশন কিছুই নেই তবে গভীরে যেতে হয় সেখানে যেন এক বার্তা আছে। যা চিরন্তন এবং শীতল নূন্য উগ্রতা নেই। বিদ্রোহ নেই- শান্ত স্থির তাতে রয়েছে রহস্যময়তা। ছবি সে যেন নিজেই নিজেকে প্রকাশ করছে বিকশিত হচ্ছে স্ব-মহিমায়। সীমাহীন অন্য কোনো পথে তার ছবিতে একই ফর্ম বারবার ফিরে এসেছে অথচ তাতে কোনো মিল ছিল না। তিনি এখানে একটা মিস্টিক ভাব তৈরি করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রহস্য বা মিস্টিক ভাব একটা প্রধান বিষয়। এটা সম্ভবত হয়েছে এ কারণেই যে তিনি জানতেন না তিনি কী করছেন। সবাই তো জেনে করে, তাঁর কাছে আর্টের সীমানা এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। যারা তাঁর গানকে নিন্দা করেছে, তারাই সে গান গেয়েছে। ঠিকভাবে না হলেও- গেয়েছে। তাঁর আরেকটি বড়ো বিষয় ছিল, তিনি নিজেকে বিচার করতে পারতেন খোলামেলা। নিজের নিন্দা এবং প্রশংসা করতে কৃপণতা করেননি। তাই তিনি বলতে পেরেছেন “আমার নাম ফুরোবে না” সত্যি আজও মানুষ তার গান গেয়ে ওঠে দুঃখে, শোকে ও আনন্দে। তিনি ছবির ক্ষেত্রেও এমনি বুঝেছিলেন যা এলোমেলো, যা অকিঞ্চিৎকর, ছন্দই তাকে বাস্তব মূল্য দেয়। তার পাণ্ডুলিপি কাটাকুটিগুলো মুক্তির জন্য কেঁদে উঠত। তখন তিনি তার মূল কাজ রেখে তাদের অপ্রাসঙ্গিক কুশ্রীতা থেকে ছন্দের সুষমায় ভাসিয়ে দিতেন রং ও রেখায়। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আশ্রয়হীন বৈসাদৃশ্যের কর্মহীনতা সমস্যার সমাধান করতে তাদের একটা পরস্পর সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ রূপের সম্পূর্ণতায় সীমাহীন রূপান্তরিত করাই কলাসৃষ্টির কাজ।

ফর্ম হচ্ছে আমার কাছে একটা এসেন্স। এর প্রকাশ যেখানে বস্তু বা প্রাণীর গঠন তার ফর্মগুলো সর্বদাই নিজস্ব রীতিতে বহমান ছিল। কবির মন চাইত না তিনি ভারতীয় ধারায় ছবি আঁকবেন। তিনি যখন ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ ঝুঁকে পড়লেন, সে-সময়ে বিশে^ শিল্প আন্দোলন চলছিল। সে আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের মনে দাগ কাটে দারুণভাবে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত অনেক ছবি দেখেছেন এবং চিত্রকলাকে মননে ঠাই দিয়েছেন।  সূত্র বিষয়গুলো বুঝবার চেষ্টা করেন যে সময়ে বাউহাসের দাপট ছিল আরও ছিল পলক্লি, মুংক ও নোলদে প্রমুখ। তখন ছিল যুদ্ধের সময় ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ। তখন ইউরোপে আর্টের জগৎ ছিল রমরমা। এরা সব মেতে উঠেছিল নতুন কাজে। আর সেই হাওয়া রবীন্দ্রনাথের মনেও দোলা দিয়েছিল।

তিনি আসলে শিল্পী হতে চাননি, তাই কে কী করেছেন সে দিক দেখেননি কিংবা তা খুঁজেও বেড়ান নি। তবে ছবি দেখেছেন গুণী দর্শকের মতো। তিনি নেশার মাদকে মাতাল ছিলেন, উন্মত্ত ছিলেন, অস্থিরতায় ভুগেছেন। একজন মৌলিক শিল্পী যখন কনসেপ্ট করেন, তখন তিনি এরকম অস্থিরতাতেই থাকেন আর যখন প্রসব করেন তখন কিছুটা স্বস্তি পান। সাহিত্য ও কবিতাকে পাশে রেখে যখন ছবিতে ডুব দিলেন মানিক রতœ তোলার জন্য তখন তিনি নতুন রূপে জন্ম নিলেন। তার সব ভাষা ও রেখা যেন রঙে নেচে উঠল। “মম চিত্তে নিতি নিত্যে কে যে নাচে তা তা থৈ থৈ” কখনো রেখা চিত্রে, কখনো কালিতে কখনো বা কলম দিয়ে আঁকতেন। জলরংও ব্যবহার করেছেন। রংদানি তেমন একটা ব্যবহার করেননি। তিনি নিজেই বহুবিধ রং তৈরি করতেন। রবীন্দ্রনাথ জার্মান ইস্ট প্যাস্টেল ব্যবহার করতেন। বেশির ভাগ রংই আসত জার্মান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড থেকে। এই রং ও ছবি তার শেষ জীবনকে অন্য পথে নিয়ে গেল। তিনি অন্য রবীন্দ্রনাথ হলেন। চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ হলেন। এতটা বছর সাহিত্য কবিতা তাকে যে তৃপ্তি দিল তাতেও তার মন পুষ্ট হোল না। আরো কী গভীর নেশায় ছুটে চললেন দ্রুত
 গতিতে। এ যেন নায়েগ্রার জলপ্রপাত। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে ‘ভলগানিক ইরাপশন’ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের সহ¯্র ছবির মধ্যে হয়ত শত শত ছবির উত্তরণ হয়নি কিন্তু যেসব ছবি উত্তরণ হয়ে উৎকৃষ্টতা পেয়েছে তা বিশ^চিত্র জগতের মাপকাঠিতে স্ব-মহিমায় ঠাঁই পেয়েছে। যেখানে কবিতা সাহিত্য ছিল তার সারাজীবনের অনুষঙ্গ, সেখানে ছবি দিল এক নতুন সঙ্গ। নতুন ভাব নতুন আঙ্গিক। এ যেন রবীন্দ্রনাথের জীবনকে নতুন শৈলীতে প্রাণ দিল। একজন চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার জন্য।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যখন জাপান ভ্রমণে তখন অবনীন্দ্রনাথ-কে পত্রে লিখেছিলেন আরো একটু সাহস নাও বড়ো ছবি আঁকো। তিনি ছবি আঁকার তাগিদ বেশ অনুভব করেছিলেন। ফরাসি ও জার্মানি ছবি তাকে অভিভূত করেছিল। তার আড়াই, তিন হাজার ছবির মধ্য কিছু ছবির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। উদ্ঘাটন করতে ইচ্ছে হয়, কী রহস্য আছে এ ছবিতে। বোদ্ধা ও সুধিজনদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন বারবার। তার সব সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে একেবারে ভিন্ন এবং নতুন কোনো পথে হেঁটেছেন। এই পথ যেন সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে অনেক দূরে, যেখানে কেউ পৌঁছায়নি এখনো। ভারতীয় ধারা তো নয়ই। তিনি তার সকল কর্মেই প্রচলিত ধারা, নিয়ম এসব থেকে দূরে থাকতেন। তিনি নিজে যা করতেন সেটাই একটা ধারা হয়ে যেত। তাকে আমরা রাবীন্দ্রিক ধারা বললে অবশ্য ভুল হয় না। তার ছবিতে আমরা একটি মিস্টিকভাব দেখতে পাই। তার হাতে এক নতুন সৌন্দর্য প্রকাশ পেল। যেখানে কালো নেই, সময় নেই, আলো নই, ছায়া নেই। কিছুই নেই, পারসপেক্টিভ নেই। যেন শুধু অনুভূতির অনুভবটুকু ছুঁয়ে গেছে হৃদয় দিয়ে। আর না জেনে না শুনে নিজের মতো করে ছুটে চলেছে এক রহস্যের জাল উন্মোচন করতে। শিল্পী যামিনী রায় কবির চিত্রের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তার মতে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় পদ্ধতিতে কাজ করেছেন। মাস্টার নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথের ছবিতে সরল ব্যঞ্জনার কথা বিশেষভাবে বলেছেন এবং তিনি মনে করেন যে, এ ধরনের চিত্র দেশীয় চিত্রায়ণে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যামিনী রায়কে একপত্রে জানিয়েছিলেন যে “চিত্রদর্শনের যে অভিজ্ঞতা যে জ্ঞান সমৃদ্ধ হলে দৃষ্টির বিচার শক্তিকে কর্তৃত্ব দেয়া যায়, তা এ দেশে এখনো কারো হয়নি।”

সমকালীন শিল্পীদের প্রভাব বলতে মাদিগিøয়ানের কাজে কিছুটা প্রভাবিত ছিল বলে কোনো কোনো গবেষকের ধারণা। রং দেয়ার ধারণাটা প্রায় একইরকম ছিল কিন্তু তাই বলে মিলিয়ে কিছু করেননি। অসতর্কভাবে যদি কিছু এসে থাকে সেটা আসতে পারে। তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় রেখে নিজের আবর্তে নিজেকে বেঁধেছেন। বিরাট ভারতীয় নিয়ম-কে অস্বীকার করেই নিজস্ব একটি রীতি দাঁড় করিয়েছিলেন যেখানে রহস্য আর আবেগের ছিল ছড়াছড়ি। ভারতীয় ভাবনা তার ছিল না, তিনি বুঝেছিলেন চিত্রের ভাষা বিশ্বের ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্র তার বিচরণ। বিশ্বময় মৌলিক শিল্পীর কোনো দেশ নেই, গোত্র নেই, জাত ও ধর্ম নেই। আর বিশেষ করে যাকে বিশ্ব কবি বলা হচ্ছে তাঁর চিত্র নিয়ে ঘরে বেঁধে রাখবে সে কী করে হয় ! তার বেশ কিছু চিত্রকর্ম বিশ্বমানের। এর মধ্যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর যে বড়ো পোট্রেট সেটি বিশ্বমানের কাজ বলেই বিবেচিত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিত্রের জগতে আমাদের দেশে এভার্গাদ, যিনি পথ প্রদর্শক। 

লেখক : ভাস্কর, চিত্রকর