সংলাপ
মার্কটোয়েন
প্রশ্ন : আচ্ছা, উনি তো আপনার একজন ভাই, তাই না ?
উত্তর : ও! হ্যাঁ ! হ্যাঁ ! বটেই তো আপনি মনে করানোতে এখন মনে পড়ছে, ঠিকই সে আমার ভাই-ই ছিল বটে ! কী যেন নাম ? হ্যাঁ উইলিয়াম, আমরা বলতাম বিল, আহা বেচারা বিল।
প্রশ্ন : কেন ? উনি কি তাহলে মারা গেছেন ?
উত্তর : হ্যাঁ, তা বোধহয়। তাই ভেবে নিতে হবে। আমরা কোনোদিনই ঠিক বলতে পারিনি। এ বিষয়ে একটা রহস্য রয়েই গেল।
প্রশ্ন : আহা সে তো খুবই আফসোসের কথা, উনি কি তাহলে উধাও হয়ে গেলেন ?
উত্তর : তা, হ্যাঁ ঠিকই, এটা সাধারণভাবে তাই বলা যায় আমরা ওকে কবর দিয়েছিলাম।
প্রশ্ন : সে কী কথা ? কবর দিলেন, সে মৃত না জীবিত না জেনেই ?
উত্তর : আরে না না, তা নয়। সে যথেষ্ট ভালোরকম মারাই গিয়েছিল।
প্রশ্ন : আজ্ঞে আমাকে বলতেই হচ্ছেÑ এসব আমি কিছুই বুঝছি না। যদি তাকে গোর দিলেন আপনারা, আর স্পষ্টই জানতেন যে সে মারা গেছে ...
উত্তর : না, মোটেই আমরা জানতাম না, কেবল ভেবেছিলাম যে সে মারা গেছে।
প্রশ্ন : ও ! এবার বুঝলাম, সে তাহলে আবার বেঁচে উঠেছিল !
উত্তর : হলপ্ করে বলতে পারি সে আবার বেঁচে ওঠেনি।
প্রশ্ন : যাব্বাবা, এ ধরনের কথা কস্মিনকালে শুনিনি। একজন কেউ নিশ্চিত মারা গেছে। অন্তত একজন কাউকে কবর দেওয়া হয়েছে এখন এতে রহস্যটা কোথায় ?
উত্তর : আহা ! ওখানেই তো আপনি আসল সমস্যা হুবহু ঠিক জায়গাটায় ধরেছেন। দেখুন, আমরা ছিলাম যমজ ভাই ওই খতম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি আর আমি। আমরা দুজনে মাত্র দু’সপ্তাহ বয়সে গোসল করবার চৌবাচ্চায় বদলা-বদলি হয়ে যাই। আর আমাদের মধ্যে একজন ডুবে যায়। কিন্তু ডুবলো কে - সে না, আমি, তা ঠিক করে কেউ জানে না। কেউ মনে করে [ডুবে যাওয়া বাচ্চাটা ছিল বিল, বেচারা বিল !]। আবার কেউ মনে করে ওটা ছিলাম আমি। ওই বাচ্চাটাই হচ্ছে সেই ভাইটি যে ডুবে মরে গেল। আবার কেউ মনে করে ওটা ছিলাম আমি। ওই বাচ্চাটাই হচ্ছে সেই ভাইটি যে ডুবে মরে গেল।
[মূল গল্প : Dialague]
অনৈসর্গিক বিহঙ্গ
বার্ট্রান্ড রাসেল
বিখ্যাত কবি-দার্শনিক পরফিরি ইগেলটন তার অসংখ্য উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত লেখার জন্য পৃথিবীর আনাচে কানাচে পরিচিত। কিন্তু সবচেয়ে পরিচিতি অর্জন করেছেন তিনি তার এক অমর কাব্যের জন্য। যদিও কাব্যটি বহুল পরিচিত এক কাহিনির ওপর লেখা, অথচ খুব অল্প সংখ্যক লোক জানে এই কাব্য রচনার পটভূমি। যদিও দুঃখজনক, তবুও এটা আমার দায়িত্ব সেইসব ঘটনাবলি ও কারণগুলো বর্ণনা করা যা তাকে কাব্য রচনায় প্রভূত সহায়তা করেছে।
সুদূর শৈশব থেকেই পরফিরি ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ এবং তার ছিল এক কষ্টকর জীবন। একধরনের বিষাদ আর ভীতি তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। তার কেবলই মনে হতো হয়ত তিনি আর বাঁচবেন না। বারবার আয়নায় নিজের চেহারা দেখতেন। যতবার তিনি আয়নায়Ñ তার ধারণা হতো তিনি বুঝি আর আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি খুঁজে পাবেন না। তিনি একটি দর্শন উদ্ভাবন করে আশান্বিত হলেনÑ উদ্ভাবিত এই দার্শনিক তত্ত¡টি এই বিষাদ-ভয় বিহŸলতা অনেকটা কমিয়ে আনবে। কিন্তু অনেক সময়ই এই দর্শন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
তিনি তার এই উদ্বেগের বাতিক লুকোতে পারলেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হলো না। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে নিজের মনের কাছে প্রবল হলেন এই ভেবে যে, যেভাবেই হোক তাকে বেঁচে থাকতে হবে। পর্যবেক্ষণ এবং আত্মবিশ্লেষণÑ এই উভয়বিধ কার্যকরণ তাকে উপলব্ধি করালোÑ ‘যন্ত্রণার চেয়ে কোনো কিছুই বেশি বাস্তব নয়’ এবং এই যন্ত্রণাকে আশ্রয় করেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। দুঃখের অভিযাত্রায় সারাদুনিয়ায় তিনি যন্ত্রণাকে খুঁজতে লাগলেন। অ্যান্টার্কটিক এলাকায় তিনি একটি নিঃসঙ্গ শীত কাটালেন। এই সময় বিশাল ও অশেষ রাত্রি আসন্নÑ বিষাদময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিল। নিজেকে একজন ইহুদি ভেবে নিয়ে নাৎসী জার্মানির কষ্টকর নিপীড়নের ভেতর অবগাহন করলেন। এই যন্ত্রণা যখন অসহনীয় মনে হচ্ছিল, ঠিক তখন পোস র্যাভেন এলেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তাকে এহেন কষ্টকর কাজের শেষে ফরাসি কবি মালার্মের কণ্ঠের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন : ‘যে যন্ত্রণা পায় সে বেঁচে থাকে।’
পরফিরি এরপর রাশিয়ায় যাত্রা করলেন। নিজেকে ওয়াল স্ট্রিটের একজন গুপ্তচর ভেবে সেগুন গাছে ঢাকা শ্বেত সাগরের তীরে এক দীর্ঘ শীতকাল কাটালেন। ক্ষুধা, অবসাদ এবং তীব্র তীক্ষè শীত প্রতিদিন তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল, আর বিপন্ন করে তুলল তার অস্তিত্ব। তিনি ভাবলেন অবশ্যই এভাবে যদি দীর্ঘদিন কাটানো যায় তাহলে বেঁচে থাকবেন, অক্ষয় হবে তার অস্তিত্ব ! কিন্তু তা হলো না। শীতের শেষদিন বরফ যখন গলতে শুরু করেছে ভয়ঙ্কর পাখিটি আরেকবার আবির্ভূত হলো এবং ভীষণ শব্দে চারদিক প্রকম্পিত করে তুললো। তিনি ভাবলেন, হয়ত তিনি যে যন্ত্রণা খুঁজে ফিরছেন তা খুবই সাধারণ। ‘আমি যদি সত্যিকার অর্থে কষ্টকর জীবন কামনা করি, তাহলে আমার এই দুঃখের সাথে কিছু লজ্জাও মেশাতে হবে।’ এই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য তিনি অতঃপর চীন দেশে গমন করলেন। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুন্দরী এক মহিলাকে গভীরভাবে ভালোবাসলেন। কতগুলো নকল কাগজপত্রের মাধ্যমে সেই পার্টি-মহিলাটিকে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অনুচর বলে চিহ্নিত করালেন। মহিলার দÐাদেশ হলো। তার সামনে মহিলাকে শারীরিক পীড়ন করা হলো। এই শারীরিক অত্যাচারে মহিলার মৃত্যুর পর তিনি ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, এখন আমি সত্যিকার অর্থে কষ্ট পেলাম। যেহেতু ওর মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবেসেছি এবং আমার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তার মৃত্যু হয়েছে, সে কারণে এটা আমার জন্য যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক।’
কিন্তু কী আশ্চর্য এখানেই তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ হলো না।
নির্বিকার এক আতঙ্কের ভিতর নিজেকে প্রোথিত রেখে তিনি দেখতে পেলেন নিয়তির অলৌকিক পাখিটি আবার আবির্ভূত হয়েছে এবং আরেকবার অবিনশ্বর এক কবির কণ্ঠের অনুকরণে কথা বলছে।
সেই অমর কবি একদা ফারসি সাহিত্য পাঠকদের কাছে এই পাখিটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার এই বিষণœতা চেপে রাখতে না পেরে প্রচÐ আবেগে সেই পাখিটির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন : ‘হে পাখি, এই বিশাল পৃথিবীর সবকটি দেশে, সব জায়গায়, এমন কিছু কি আছে যা তোমাকে স্বীকার করতে বাধ্য করবে যে আমি বেঁচে আছি, আমার অস্তিত্ব আছে ?’ পাখিটি তখন কেবল দু’টি শব্দ উচ্চারণ করলো : “অনুসন্ধান করো।”
অতঃপর সে অদৃশ্যে বিলীন হয়ে গেল।
একথা ধরে নেওয়া যায় না যে, পরফিরি এই অনুসন্ধানে তার সমস্ত শক্তি ও ধৈর্য ব্যয় করেছিল। দার্শনিক কবি হিসেবেই তিনি খ্যাতি পেলেন সর্বত্র, পৃথিবীর সবাই তাকে সম্মান দেখালো, একটি বিশেষ দার্শনিক গোষ্ঠী তাকে নিয়ে বেশি হৈচৈ করল। চীন থেকে ফিরে আসার পর প্যারিসে দার্শনিকদের কংগ্রেসে তার সম্মানে তাকে আমন্ত্রণ জানালো। সভাপতি ছাড়া আর সব অতিথিরা এসেছিলেন। যখন পরফিরি অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলেন কখন সভাপতি আসবেন তখনই সেই অলৌকিক পাখিটি এলো এবং সভাপতির আসনে বসল। পরফিরির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে তার তত্ত¡ বদলে ফেলে মধুময় কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার দর্শনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এটাতো কিছুই নয়।’ এরকম বিরক্তিকর শব্দশর পরফিরির সমস্ত শরীরে আঘাত হানল।
তিনি তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তার জ্ঞান যখন ফিরে এল, তিনি শুনতে পেলেন পাখিটি সেই কথাগুলোই বলছে, যা এতদিন ধরে ইগেলটন অনুসন্ধান করে আসছিল : ‘অবশেষে তুমি কষ্ট পাচ্ছ। অবশেষে তুমি আছো।’ ... তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেনÑ হায়! এ যে স্বপ্ন !
এবং মজার বিষয়, পরফিরি আর কখনো কোনোদিন দর্শন বিষয়ে কথা বলেননি এবং লেখেনওনি।
[মূল গল্প : Supernatural Bird
থেকেই কিছু জানা যায়, যদি ভুল করে ব্রাসেল থেকে টিকেট না কাটতাম আর এতোগুলো ইউরো গচ্চা না যেত, তাহলে এত কিছু হয়ত জানাও হতো না। কেননা, ইতিহাস কখনই আমার পছন্দের বিষয় না। [চলবে]
লাশের নৃত্য
বুজরাখ আলভী
ঢং ঢং করে বারোটা বাজলো। এখন থেকে ভোর না হওয়া পর্যন্ত মৃতেরা.. স্বাধীন ... স্বাধীন ... স্বাধীন।
মধ্য রাত্রি !
কী ভয়ঙ্কর রাত !
প্রত্যেকটা রাতই ভয়ঙ্কর। কারণ, আমাদের জীবনই তো বীভৎস-বিভীষিকা ! আতঙ্কিতরা কি হৃদয় বিনিময় করতে পারে ! মৃতদের তো হৃদয় নেই। আমরা কিন্তু সেরকম নই ; কিন্তু মৃত ব্যক্তিরা তো তাই।
মাঝরাত থেকে মোরগ ডাকা সময় পর্যন্ত মৃতেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মরণশীল জীবন থেকে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি’ উৎসব করে।
সবাই সমান।
এখানে কেউ রাজা নয় কিংবা ভিক্ষুক। না বৃদ্ধ না যুবক। না ছেলে না মেয়ে। না পুরুষ না রমণী। সবাই মৃত। সবাই কঙ্কাল।
কারো মাথায় পালকের মুকুট নেই, কারো পিঠে ছালা নেই। হাত ধরাধরি করে তারা নাচে।
মৃত্যু সবার কাছেই সমান, তাদের জীবনের অঙ্গÑ মৃত্যুই কঙ্কালের নৃত্য।
মৃত্যু, চামড়ার হারের মতো এক কালে যুবতী মেয়েদের জঙ্ঘা ছিল। আর ঘন হার যুক্ত মাথার খুলি ছিল ঢোল-সদৃশ।
রাত বারোটা বাজতেই কঙ্কালরা কবর থেকে পা ফেলে চলে আসেÑ শুরু হয় শব্দহীন নৃত্য।
যেহেতু তারা সব প্রাণহীন ; সেজন্যেই এখানে কোনো সেনানায়ক নেই অথবা নেই সৈন্য, মন্ত্রী নেই, আমলা নেই, কামলা নেইÑ এক নেই রাজ্যের-নৈরাজ্য।
সবাই নীরব গায়ক।
মৃতের দল হাত ধরাধরি করে নাচে আর নাচে।
যার মুখের চোয়াল কদাকার সে তার জীবিতকালে ছিল বিচারক। অবজ্ঞাতদের বিচার সে করেনি। সে এখন নবমৃত। এই চিহ্নও খুব শিগ্গিরই চলে যাবে। মুখ আর গালের কোনো নমুনাই আর থাকবে না। কেননা, এখন সে মৃত এবং স্বধীনÑ মুক্ত।
যার মেরুদÐ বাঁকা সে সুন্দর জীবনের জন্য কখনো পিঠ খাটায়নি। এবং সে কখনো নত হয়নি। অন্যের দুঃখ বোঝেনি। এ সবও থাকবে না।
এখানে কোনো হাসি নেই। কান্না নেই। অপমান নেই। সম্মান নেই। বিনয় নেই। অহংকার নেই। সুখ নেই। দুঃখ নেই। আশা নেই। নিরাশা নেই। ক্ষুধা নেই। আহার নেই। প্রেম নেই। ঘৃণা নেই। ভালো নেই। মন্দ নেই। পুণ্য নেই। পাপ নেই। এখানে কিছুই নেই। কেবল মৃত্যু। কেবল মুক্তি-স্বাধীনতা।
যে বিচারক সুবিচার করে না তার চেয়ে কি মৃত্যু ভালো নয় ?
যে শিরদাঁড়া অকাজে থেকেছে তারচেয়ে কি মৃত্যু ভালো নয় ?
যে প্রেমিক প্রতারক তার চেয় কি মৃত্যু ভালো নয় ?
মানবতা যেখানে শৃঙ্খলাবদ্ধ সেখানে কি মৃত্যু ভালো নায় ?
এজন্যই বিদ্রোহ।
তারা নাচে। কারণ তারা মুক্ত-স্বাধীন।
মৃত্যু, লাশের নৃত্যে বিভোর !
হায় কপাল ! এ স্বাধীনতাও সীমিত।
ভোর না হতেই মোরগ ডাকে।
সমস্ত মৃত লাশ এবং কঙ্কাল বিদায় নেয়।
[বুজরাখ আলভী মূলত ফারসি ভাষার লেখক, ‘লাশের নৃত্য’ গল্পটি তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন।]
[মূল গল্প : The Dencing Corpse]