বর্ষা ভালোবাসি-নিজেরা সুস্থ থাকি

21 Jun 2022, 11:35 AM অভোগ শেয়ার:
বর্ষা ভালোবাসি-নিজেরা সুস্থ থাকি

বর্ষাকালের মেজাজ-মর্জি বোঝা বড়ো দায়। এই রৌদ্রের খরতাপ, অস্বস্তিকর গরম আবার নিমিষেই ঝমঝমে বৃষ্টি, ভ্যাপসা চারপাশ। বর্ষাকাল এভাবেই কাটে। এমন আবহাওয়ায় সবকিছুই অসহনীয় হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। এই সময় অনেক রোগ-বালাইও দেখা যায়। কর্মব্যস্ত এই জীবনে এসব নিয়েই চলতে হয়। বর্ষা আসার আগেই জীবনযাত্রা নিয়ে একটু প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে বর্ষাকাল বেশ উপভোগ্য হবে। বর্ষার জীবনযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে এবারের অঁভোগ আয়োজন...
বর্ষার ঘরদোরবর্ষার প্রথমে কয়েকদিন বৃষ্টি বেশ ভালো লাগলেও পরে কিন্তু বেশ বিরক্তিকর ঠেকে। কারণ বাতাসের আর্দ্রতা ঘরের ভেতরে স্যাঁতসেঁতে ভাব সৃষ্টি করে। ঘরের ভেতর চাপা গন্ধভাবও তৈরি হয় এবং ঘরের আবহাওয়া জুড়ে গুমোটভাব বিরাজ করে। বর্ষায় নিজের ঘরের যত্ন তো অবশ্যই নিতে হবে। কেননা, দিশেষে আমরা ঘরেই ফিরি। বর্ষায় ঘরদোর পরিষ্কারের বিষয়ে নিতে হবে বাড়তি খেয়াল।
ঘরে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে। অনেকক্ষণ যদি দরজা, জানালা বন্ধ থাকে তাহলে ঘরের ভেতর একটা গুমোটভাব দেখা দেয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ঘরে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে একটি বিষয়ের ওপর একটুু নজর দিতে হবে। এ সময় ডেঙ্গু মশার উৎপাত থাকে বেশ তাই খুব বেশি সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পর্দা বা নেট টেনে দিতে হবে। ঘরের পর্দা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, পর্দা যেন খুব বেশি ভারি বা মোটা না হয়। কারণ, মোটা কাপড় বাতাসের আর্দ্রতা বেশি শোষণ করে। এতে স্যাঁতসেঁতে ভাব বিরাজ করে। আর বৃষ্টিতে ভিজে গেলে শুকাতেও সমস্যা হয়। বর্ষাকালে এমনিতেই মেঝে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। মেঝেতে পা দিলে মনে হয় ভেজা ভেজাভাব রয়েছে। এর মাঝেও মেঝে পরিষ্কার করতে চাইলে পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে ফিনাইল।
শুধু ঘরেই নয়, বাড়ির আশেপাশের অপরিষ্কার জায়গা নর্দমাও পরিষ্কার করতে হয় বর্ষাকালে। জমে থাকা পানিতে মশার বিস্তার বাড়ে, যা থেকে ডেঙ্গু বা অন্যান্য ভাইরাসজনিত জ্বর ছড়ায়। বর্ষায় যেহেতু অনেক বৃষ্টি হয়, তাই বাড়ির চারপাশে পানি জমে থাকার সম্ভাবনাও বাড়ে। আর তাই বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
কাপড়ের বাড়তি যত্নবৃষ্টিতে কাপড় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। তাই বর্ষাকালে কাপড় নিয়ে সচেতন থাকতে হবে ; নিতে হবে বিশেষ যত্ন। বৃষ্টির সময় পোশাকে কাদা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কাদা লাগলেই আগে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। কাদালাগা স্থানগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর পুরো কাপড় আলাদাভাবে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে পুরো কাপড়ে দাগ লাগবে না। বৃষ্টির দিনে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় কাপড় শুকাতে বেশি সময় লাগে। যদি কাপড় ভালোভাবে না শুকায় তবে ইস্ত্রি করে নিন। এতে ভ্যাপসা ভাব থাকবে না। আলমারিতে রাখার সময় কাপড়ের ফাঁকে ন্যাপথলিন রেখে দিন। এতে ছত্রাক থেকে কাপড় সুরক্ষিত থাকবে। ঘরের ভেতর কাপড় না শুকানোই ভালো। বারান্দায় যেখানে বৃষ্টির পানির ছাঁট আসে না, সেদিকে কাপড় রাখুন। রোদ উঠলে রোদে দিন। কাপড় দু-তিন দিন ভেজা থাকলে ব্যাকটেরিয়ার কারণে বাজে গন্ধ বের হয়। ডিটারজেন্ট ও অ্যান্টিসেপ্টিক লিকুইড দিয়ে কাপড় আবার ধুয়ে নিলে গন্ধ দূর হয়ে যায়।
বর্ষার খাবার-দাবারএকেক ঋতুর খাবারের আছে একেক ধরন। যেমন বর্ষা মানেই খিচুড়ি আর তেলে ভাজা মচমচে খাবারের গল্প। এই সময়ের খাবার শুধু আবহাওয়া নয়, বর্ষার ভেজা দিনে খিচুড়ি বা তেলে ভাজাজাতীয় চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পেছনে হরমোনের হাত আছে। বৃষ্টির দিনে সূর্যের আলো হঠাৎ কমে যাওয়ায় দেহে সেরোটোনিন নামের একটি উপাদানের মাত্রা কমে যায়। সেরোটোনিন একটি নিউরো ট্রান্সমিটার, যা প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে, চর্বিজাতীয় খাবারে থাকা ট্রিপ্টোফ্যান, যেটি সেরোটোনিন বৃদ্ধি করে। ফলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাদের চর্বিজাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে হয়। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে তেলে না ভেজেও সে-রকম খাবার খাওয়া যায়।
বর্ষা মৌসুমে আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। ফুডপয়জনিং, ভাইরাল ইনফেকশন, ডায়রিয়ার মতো রোগ বেশি ছড়ায়। এ-সময় ডাল, চাল, হালকা ঘি ও সবজি মিশ্রিত খিচুড়ি খেতে বলার প্রধান কারণ হলো, এগুলোতে সব ধরনের ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস থাকে। এছাড়া খিচুড়ি আমাদের পরিপাকনালি সুস্থ রাখে। বর্ষাকালে ইনফেকশনজনিত রোগ বৃদ্ধি পায়। এজন্য বেশি পরিমাণে পানি পান করতে হবে। মৌসুমী ফল, শশা, স্যুপ, হলুদ দিয়ে দুধ, বাদাম, ওটস, ডাল সবচেয়ে বেশি খাওয়া উচিত বর্ষাকালে। কাঁচা রসুনও বেশ উপকারী। কাঁচা রসুনের গন্ধ সহ্য করতে না পারলে রান্না করা খাবারে রসুনের ব্যবহার বাড়াতে পারেন।
চায়ে থাকা পলিফেনলস ও ফাইটো-কেমিক্যাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান দুটি ইনফেকশনজনিত রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। দুধ-চা সবার পছন্দের হলেও স্বাস্থ্যের যত্নে বেছে নিতে পারেন তুলসি-চা, আদা-চা, সবুজ-চা, ক্যামোমিল-চা বা ম্যাকা-টি কিংবা বিভিন্ন মসলা-চা। এ ছাড়া ঘরে বানানো স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। টেস্টিং সল্ট বাদ দিয়ে আদা, রসুন, চিকেন, সবজি দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত স্যুপ তৈরি করতে পারেন এ সময়। আম, জাম, কাঁঠাল ও জামরুল ইত্যাদির মৌসুম এখন। এগুলো টাটকা খেলে সর্বোচ্চ পুষ্টিগুণ ও স্বাদ পাওয়া যায়।
বর্ষায় পালংশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, ব্রকলি, কলমিশাকে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। পেটের সমস্যা থাকলে এ-জাতীয় সবজি এড়িয়ে চলতে পারেন। উচ্চ ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, মিনারেলসমৃদ্ধ সবজি, যেমন করলা, লাউ, পটোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, কচু, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স, শশা ইত্যাদি বেশি করে খাওয়া উচিত এ সময়। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
বর্ষার রোগ-বালাইবর্ষায় অতি বৃষ্টির অন্যান্য অসুবিধার সঙ্গে প্রায় অনুষঙ্গ হয়ে আসে নানা রকমের রোগবালাই। তাই বৃষ্টি যতই উপভোগ করা হোক না কেন, বর্ষায় রোগের হাত থেকে সাবধান থাকতেই হবে।

ম্যালেরিয়া
বর্ষায় সবচেয়ে বেশি যে রোগ দেখা যায় তা হলো ম্যালেরিয়া। বর্ষার জমা পানি থেকে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া, শিশু থেকে বড়ো সকলেরই হতে পারে। এই ম্যালেরিয়ায় যদি ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যায় তা থেকে মৃত্যুও হতে পারে।

ডেঙ্গু
ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। বেশ কয়েক বছর ধরে বর্ষার শুরু থেকেই এই রোগের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। মশাবাহিত এই ভাইরাসজনিত রোগটি অতিরিক্ত জ্বর, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতার মতো বড়ো সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

ডায়রিয়া
বর্ষায় বাইরের খাবার যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। বাইরের খোলা খাবার, অপরিশোধিত পানি থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। শিশুদের ডায়রিয়া থেকে ডিহাইড্রেশন হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

চিকুনগুনিয়া
সংক্রমিত অ্যাডিস অ্যালবোপিকটাস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া হয়। বর্ষার জমা পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে ও দিনের আলোয় কামড়ায়।

টাইফয়েড
সালমোনেলা টাইফোসা ভাইরাসের প্রকোপ বর্ষাকালে খুব বেড়ে যায়। অপরিশোধিত ও অপরিচ্ছন্ন পানি থেকে টাইফয়েডের সংক্রমণ ছড়ায়। দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা না নামলে টাইফয়েড থেকে হয়ে যেতে পারে বড়োসড়ো ক্ষতি।

ভাইরাস ফিভার
যেকোনো মৌসুমেই ভাইরাস ফিভার হতে পারে। তবে বর্ষায় ভাইরাস ফিভারের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। জ্বর, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতার সঙ্গে এই জ্বর ৩-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

নিয়মিত শরীরচর্চা
বর্ষায় মানুষের মনে কিছু আলসেমি চলেই আসতে পারে। সব আলসেমি ঝেড়ে ফেলে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চায় রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং শরীর ফিট থাকে। শরীরে নানা ব্যথা কমাতে যোগব্যায়াম করা যেতে পারে। জিমে যেতে না পারলে বাসায় থেকেই শরীরচর্চা করা সম্ভব।
বর্ষায় ত্বক ও চুলের যত্নবর্ষার দিনে আমাদের ত্বক ও চুল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রূপ বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য ঋতুর মতোই বর্ষাকালে একটু বেশিই সৌন্দর্যচর্চা করা দরকার। একটানা বৃষ্টির জন্য আর্দ্র আবহাওয়ায় ত্বক আর চুলের ক্ষতি বেশি হয়। এর ফলে ত্বক তেলতেলে দেখায়। ত্বকের লোমকূপ বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় ব্রণ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। আবার চুল শুকাতে চায় না, অনেক বেশি সময় লাগে। এই সময় খুশকির সমস্যা দেখা দেয়। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত চুলও ঝরে পড়ে। এ কারণে, বর্ষার এই মৌসুমে ত্বক আর চুলের জন্য চাই আলাদা যত্ন।
বর্ষাকালে কিছু নিয়ম মেনে চললে ত্বক ও চুল সুস্থ ও সুন্দর থাকবে। যেমন দিনেরবেলায় ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। প্রতিদিন সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করা ভালো। যেসব মেকআপ প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন, সেগুলো যেন নন-কমেডোজেনিক ও ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট প্রোডাক্ট হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এতে বর্ষার দিনগুলোতে ত্বক হালকা ও সুস্থ থাকে। বর্ষার মৌসুমে বাতাসে বেশি পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে। তাই মুখের ত্বক, শরীরের ত্বকের তুলনায় অনেকটাই শুষ্ক থাকে। এই সময় ত্বকের পাশাপাশি চুলেরও যত্ন নেওয়া দরকার। বর্ষাকালে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা অনেক বেশি থাকে। তাই বেশি শ্যাম্পু করাও যেমন ভালো নয়, তেমনই একেবারে শ্যাম্পু না করলে খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ কারণে, এ সময় একটু নরম ধরনের শ্যাম্পু ব্যবহার করাই ভালো। শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে চুলের গোড়ায়। গোটা চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুল হয়ে উঠবে শুকনো খটখটে। বর্ষাকালে চুলে ভালোমানের শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে।
লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন