বৃষ্টি হলে গান গাইতে ইচ্ছে করে শিমুর

20 Jun 2022, 03:14 PM সারেগারে শেয়ার:
বৃষ্টি হলে গান গাইতে ইচ্ছে করে শিমুর

বর্ষাকাল আসতে আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। সংগীতশিল্পী শিমু দে-র সঙ্গে ফোনে কথা হলো ‘বর্ষা ও রবীন্দ্রনাথের গান’- এই বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বাংলাদেশ বেতার কার্যালয়ে যেতে হবে তার কর্মস্থলে। সকাল ১১টায় পৌঁছাবো। কী আশ্চর্য দশটা থেকে শুরু হলো বেজায় বৃষ্টি। আষাঢ় আসার আগেই জ্যৈষ্ঠের ভীষণ খরাকে ঠান্ডা করতে বর্ষা নেমে এলো নগরীর আনাচেকানাচে। বর্ষাও বুঝে গেছে আমরা তাকে নিয়েই কথা বলতে চলেছি। ঘণ্টা দুয়েকের বৃষ্টিতে জল জমে রাস্তায় লেগে গেল অসহনীয় যানজট। সেই জট ঠেলে যখন আগারগাঁওয়ের বেতার ভবনে পৌঁছালাম তখন বেলা তিনটা। আমরা [আমি আর ফটোগ্রাফার জাকির হোসেন] ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যানজটে বসে থেকে আর শিল্পী শিমু দে অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে। তবুও কথা হলো তার সঙ্গে বর্ষণমুখর পড়ন্ত বেলায় বেতার ভবনে তার কক্ষে বসে। কথা হলো তার সংগীতচর্চা, রবীন্দ্রনাথের গান, গানে বর্ষার উপস্থিতি ও অনুভব এমনি নানা বিষয়ে...

সিরাজগঞ্জের মেয়ে শিমু দের সংগীতের হাতেখড়ি তার মায়ের কাছে। মা-ই তাকে প্রথম সা-রে-গা-মা-পা শিখিয়েছেন। তারপর ভরতচন্দ্র প্রসাদ এবং রতন লাল সূত্রধরের কাছে সংগীতে তালিম নিয়েছেন। দু’জনেই সিরাজগঞ্জের মানুষ। বাড়িতে যেহেতু গানের পরিবেশ ছিল তাই অনেকের কাছেই শেখার সুযোগ হয়েছে তার। শিমু দে-র সংগীতে তালিম নেওয়ার ওস্তাদদের তালিকা বেশ লম্বা। ওস্তাদ আমিরুল ইসলামের কাছে শিখেছেন আধুনিক গান। আধুনিক গানের গায়কি এবং কীভাবে গাইতে হয় এসব শিখেছেন তাঁর কাছ থেকে। শিমু দে-র রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হওয়ার সবচেয়ে বেশি অবদান যার, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক। ওয়াহিদুল হককে তিনি দাদু বলে ডাকতেন। তার সঙ্গে প্রতিদিনই একটি করে চিঠি আদান-প্রদান হতো সিরাজগঞ্জ টু ঢাকা। এরপর লিলি ইসলাম, নিলোৎপল সাধ্য, সুজিত মোস্তফা, হিমাদ্রী শেখর, সারথী চ্যাটার্জি, রুবিনা আহমেদ মিলি, প্রদীপ কুমার নন্দী, অনিল কুমার সাহা-সহ অনেকের কাছেই তিনি গান শিখেছেন। এখনো শিখছেন। শিমু দে’র বাবা শংকর কুমার দে ছিলেন একজন বিখ্যাত তবলা বাদক ও সংগীতগুরু। ছেলেবেলা থেকেই গানের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন শিমু দে। কথাবলা শেখার সঙ্গে সঙ্গে গানও চলে আসে তার কণ্ঠে। বাসায় যেহেতু নিয়মিত গান-বাজনা চলত তাই শিমু দে’র কাছে গানই ছিল মূল, বাকি সবকিছুই অস্থায়ী।
সম্প্রতি দশটি গানের কাজ শেষ করেছেন শিমু। ওস্তাদ রশিদ খান আর শিমু দুজনে মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ডুয়েট করেছেন। শিমু বলেন, “এটা আমার সংগীতজীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া। রবীন্দ্রসংগীতের স্টেজ শো খুব একটা হয় না। তবে জাতীয় অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং অন্যান্য চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো করছি।”
রবীন্দ্রনাথের গান ও বর্ষা প্রসঙ্গে শিমু দে বলেন, “রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা যে শুধু প্রকৃতি পর্যায়ে আছে তা নয়, রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রেমের গানেও আমরা বর্ষার ঘনঘটা দেখি। কিন্তু বর্ষার গানের মধ্যে যেরকম বৃষ্টিকে উপভোগ করার ব্যাপার আছে, বর্ষার মাঝখানে তার থেকেও বেশি উপভোগ্য হয় প্রেম। বর্ষায় প্রেম কেমন হতে পারে, বর্ষায় নতুন করে কাউকে মনের কথা বলা যায় কি না। সেটার জন্যই শুধু বর্ষার সময়ের জন্য অপেক্ষা করাÑ রবীন্দ্রনাথের গানে এরকমও আছে। আবার নিদারুণ অপেক্ষাও আছে। যেমন ‘আমার নিশীথ রাতের বাদলধারা এসো হে গোপনে’। এই গানটিতে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার বর্ষায় বিরহও আছে। সবই আছে। রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথই। রবীন্দ্রনাথ যে কাজগুলো করে গেছেন সেটা শুধু রবীন্দ্রনাথ নিজেই যে উপভোগ করেছেন তা কিন্তু নয়। তিনি আমাদের জন্যও লিখে গেছেন তার গানে, তার রচনায়। কিন্তু যারা রবীন্দ্রনাথকে বোঝেনি বা বুঝতে পারেনি তারাও কিন্তু অপেক্ষাই করেন। তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এটা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত এবং এটা আমাদের প্রকৃতির ব্যাপার। এখানে আমার বা আপনার যুক্তি দেখানোর কোনো জায়গা নেই।”
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান দারুণ আন্দোলিত করে শিমু দে-কে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বর্ষা খুব পছন্দ করেন। অপেক্ষায় থাকেন কবে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি হলে মানুষের অনেক অসুবিধা হয়। তবে বৃষ্টি হলে শিমুর গান গাইতে ইচ্ছে করে, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে। তিনি বলেন, “রাত আটটার সময় বৃষ্টি হলেও আমি ছাদে চলে যাই। এটা আমার পাগলামোও বলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে বৃষ্টির কোনো গান কখনো মানুষের হৃদয়-কে এতটা স্পর্শ করতে পেরেছে কি না আমার জানা নেই। তাছাড়া ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ এমন রোমান্টিক গান আর একটা সৃষ্টি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। রবীন্দ্রনাথের আরো একটি অসম্ভব ভালা লাগার গান হলো ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’ এই গানটির কথাও যদি আপনি একটু ভাবেন, তাহলে দেখবেন এই গানে কত কিছুই যে লেখা আছে।”
বর্ষা ঋতুকে দারুণ উপভোগ করেন শিমু। “যেকোনো বৃষ্টির গান আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান এবং বর্ষার কাছাকাছি গান। আসলে এগুলো নিয়েই আমি বাঁচি। বর্ষা ঋতু আমার কাছে উপভোগের বিষয়।”
শিমু দে’র প্রথম অ্যালবাম বের হয় ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর অসংখ্য মিক্সড অ্যালবাম বের হয়েছে তার। একক অ্যালবাম বের হয়েছে তিনটি। শিমু দে রবীন্দ্রসংগীতে ভারতের কনিকা বন্দ্যোপ্যাধায় অ্যাওয়ার্ড, রাসেল শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রবীন্দ্রসংগীত এবং আধুনিক গানে শ্রেষ্ঠ মান এবং উত্তম মান পেয়েছেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ থেকে পেয়েছেন অনন্য মান। আর সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ শিল্পী বিভাগে চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন শিমু দে।
করোনাকালীন ‘শিমু দে অনলাইন মিউজিক একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছেন। অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে।


লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল 

ছবি : জাকির হোসেন