বেঁচে থাকুক যৌথ পরিবার

20 Jun 2022, 02:45 PM অন্যান্য শেয়ার:
বেঁচে থাকুক যৌথ পরিবার

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হলুদিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক সমৃদ্ধ পরিবার বেপারি পরিবার। বাংলাদেশের হাতে গোণা কয়েকটি যৌথপরিবারের মধ্যে বেপারি পরিবার অন্যতম। বেপারি পরিবারকে নিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন শেখ সেলিম...



বিএম শোয়েব


বিএম শামীম 

সময় পাল্টেছে, পাল্টে গেছে পরিবারের ধরনও। আর্থ-সামাজিকতায় যৌথ পরিবার ভেঙে হচ্ছে একক পরিবার। শিশুর বেড়ে ওঠায় জীবনবোধ গড়ে দেয় পরিবার। তাই পরিবারের শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সবাই।
সময়ের বিবর্তনে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও এখনো অনেক স্থানে যৌথ পরিবার টিকে আছে আপন মহিমায়। পরিবার যেমন জীবনবোধের শিক্ষা দেয়, তেমন সুখ-দুঃখও ভাগ করে নেওয়া যায়।
পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। যেখানে সব সদস্যের অধিকার সমান। মানবাধিকার, জনসংখ্যা ও নারীদের অগ্রগতি পরিবার দ্বারা প্রভাবিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে পরিবারের ভূমিকা অনেক। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান, মৌলিক অর্থনৈতিক একক।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। বাড়ছে পরিবারের সংখ্যা। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে এ জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ কোটিতে। বর্তমানে ধরা হয় সাড়ে ১৬ কোটি। ’৭১-এ পরিবার ছিল প্রায় ৯০ লাখ। এখন পরিবারের সংখ্যা ২ কোটির বেশি। একান্নবর্তী পরিবারগুলো সময়ের প্রয়োজনেই ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছে। তারপরও কিছু পরিবার এখনো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, এমন এক পরিবার মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার হলুদিয়া গ্রামের বেপারি পরিবার।
৪ মে ২০২২ ঈদের পরেরদিন মুন্সিগঞ্জ জেলার, লৌহজং থানার, হলুদিয়া গ্রামে ঐতিহ্যবাহী বেপারি পরিবারে ঈদ-পরবর্তী মিলনমেলায় নিমন্ত্রণ জানানো হয় আনন্দভুবন পরিবারকে। আনন্দভুবন থেকে আমি ও আলোকচিত্রী জাকির হোসেন মিলনমেলায় অংশ নিই। সকাল ১০টায় আমি আর জাকির গুলিস্তানে একত্র হই। উদ্দেশ্য বাসে চেপে গন্তব্যে পৌঁছাব। কিন্তু অবাক কাণ্ড ! ঈদের পরের দিনও বাসে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, লম্বা ছুটি পাওয়ায় মানুষ আজও বাড়ি ফিরছেন। কেউ আবার স্বপ্নের সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু দেখতেও যাচ্ছেন। বুঝতে পারলাম আজ আর বাসযোগে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ছুটলাম হলুদিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে।
বাবু বাজারের ব্রিজ পার হয়ে চুনকুটিয়া থেকে কিছুটা এগিয়ে যখন ফ্লাইওভারে উঠলাম, মনে হচ্ছিল না, আমি আমার দেশে আছি ! চারদিকে শুধু সৌন্দর্যের হাতছানি। কোনোরকম ব্রেক ছাড়াই গাড়ি ছুটছে গন্তব্যে। চোখ আটকে আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের দিকে, দেখছি আর ভাবছি দেশকে কোথায় নিয়ে চলেছেন তিনি। কেন বিশ্ব বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে দেখছে। ভাবছি, আর অপলক দৃষ্টিতে মাওয়া সড়কের সৌন্দর্য উপভোগ করছি।
হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষল। ঘোর ভাঙল। ড্রাইভার সাহেব জানালেন, ‘ভাই সামনে প্রচুর জ্যাম, এখানে নেমে কিছুদুর হেঁটে অটোরিকশা নিয়ে চলে যান।’ আমরা সিএনজি অটোরিকশা ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পর আবারও একটি অটোরিকশা নিলাম।
অটোরিকশা চলছে হলুদিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতেই সবকিছু হলুদ মনে হচ্ছে। চারদিকে হলুদের ছড়াছড়ি। এরপর আবিষ্কার করলাম দু’পাশে সারিবদ্ধ কাঁঠাল গাছ। গাছে গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁঠাল ঝুলছে। এজন্যেই বোধহয় পুরো প্রকৃতিই হলুদ মনে হচ্ছে। বাড়িঘরগুলোও বেশ ব্যতিক্রমী। কাঠ আর টিন দিয়ে বানানো হয়েছে প্রতিটি বাড়ি। এ যেন শিল্পীর হাতের তুলিতে আঁকা কোনো শিল্প। যত দেখি, তৃঞ্চা মেটে না। এরই মধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। দূর থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল এই বাড়িটিই হবে বেপারি বাড়ি। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘জ্বি এটাই নান্নু হাজী সাহেবের বাড়ি।’
নান্নু হাজি ছিলেন খুব মানবদরদি একজন মানুষ। বেক্সিফেব্রিকসের বর্তমান চেয়ারম্যান বিএম শোয়েব সাহেবের বাবা তিনি। গত হয়েছেন প্রায় ১০ বছর। এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে তার নাম। সত্যি ভালো লাগল। এরকম একটি পরিবারের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আসতে পেরে। ভেতরে প্রবেশ করতেই ওই পরিবারের সন্তান বেক্সিফেব্রিক্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএম শামীম আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
ভেতরে প্রবেশ করার পর বাড়ির পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হলাম। অসাধারণ কিছু টিন-কাঠের বাড়ি, রয়েছে একটি বহুতল ভবনও। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম এই পরিবারের ইতিহাস।
বর্তমানে এই পরিবারের সবচেয়ে পুরাতন মানুষ শামসুল বেপারি। তার কাছে জানতে চাই এই পরিবারের ইতিহাস। তিনি বলেন, “আমাদের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে হলুদিয়া গ্রামে বসবাস করছে। এর আগে আমাদের পরিবার শয়লাহাটিতে ছিল, ওটা ভেঙে যাওয়ার পর লৌহজং থানার হলুদিয়া গ্রামে বসতি শুরু হয় এবং এখনো সবাই এখানে আছি। প্রায় দুই শো বছর আগে আমাদের পরিবার শয়লাহাটি গ্রামে বসবাস করত। আমার দাদার শ্বশুরের গ্রাম ছিল ওটি। আমার দাদারা দুই ভাই ছিলেন, আমার দাদার নাম একাবর বেপারি, তাঁদের ধান-চালের ব্যবসা ছিল। দাদার বয়েস যখন ২২ বছর তখন এখানে তাঁরা বসতি গড়ে তোলেন। আমার দাদার তিন ছেলে। তার মধ্যে আমার বাবা সবার ছোটো। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আমার জন্ম। আমার বাকি পাঁচ ভাইবোন, তাদের জন্ম আসামে। দাদা ধান-চালের ব্যবসা করতেন। আমার বাবা-চাচারা আসামের সোনা চারুলিয়ায় কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বিশ্বনাথ চারআলিতে আমাদের টিনের একটি মার্কেট ছিল, সামনে ছিল আমাদের দোকান, আর তার পেছনে বাসা। সেই বাসা এখনো আছে। আমার চাচা, ফুপু এখনো ওখানে রয়েছেন। ওখানে মসজিদ, কবরস্থান আমার বাবা-চাচারা বানিয়েছেন। আমার পরিবারের সবাই সেখানে গেলেও আমি কখনো যাইনি। তাঁরা সেখানে এখনো কাপড়ের ব্যবসা করেন। কাপড়ের ব্যবসাটা আমাদের আদি ব্যবসা। বাবা যখন ১৯৪৭-এ এখানে আসেন, তখন চাচারা ওইখানে রয়ে যান।
এখানে এসে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। দুইটা দোকান নিয়ে বরিশালে তামা-কাশার একটা দোকান দেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বাবা মারা যান। তখন এই ব্যবসাটা আমার খালু দেখাশোনা করতেন। তখন আমার বড়ো ভাইয়ের বয়েস ১৪ বছর। মেট্রিক পাশ করে বড়ো ভাই আলাদাভাবে ব্যবসা শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের ফ্রেঞ্চ মার্কেটে। এই ব্যবসা থেকে পরবর্তীসময়ে আমরা ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামপুরে আসি, জানুয়ারি মাসে।


আমরা ছয় ভাই এক বোন। আমার বড়ো ভাই ও সেজ ভাই লালমনিরহাটে চলে যায়। আমার বড়ো ভাই নজরুল বেপারি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন। আমার একভাই এখন লালমনিরহাটে থাকেন- মো. ফজলুল হক বেপারি। আমরা পাঁচ ভাই ঢাকায় চলে আসি। ওখানে তিনি খাদ্যপণ্যের ব্যবসা করেন। পল্ট্রিফার্ম, রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল এগুলো নিয়ে তাঁর কারবার। তিনি ওখানকার চেম্বারের সহ-সভাপতি।১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা শুরু। প্রথম দোকানের নাম ছিল তিস্তা করপোরেশন, শোয়েব করপোরেশন, সেতু করপোরেশন, দৌলত টেক্সটাইল- এই চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা ব্যবসা শুরু করি।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে যাই। অঞ্জলি টেক্সটাইল লি. বর্তমানে ইউনিমেক্স টেক্সটাইল লি. নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং এটা। নান্নু টেক্সটাইল মিলস লি. আমাদের ওয়েডিং ফ্যাক্টরি ও নান্নু স্পিনিং মিলস লি.- এই তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। হাজি নান্নু বেপারি ও আরো দু’জন পার্টনার বেক্সিফেব্রিকসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আমরা এমনভাবে একত্র হয়েছি, বিভিন্ন উৎসবে অন্তত দুটি ঈদ আমরা গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে করবই। যে যেখানেই থাকুক না কেন, সবাইকে এই দুই উৎসবে আসতে হবে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে মা মারা যান। মার মৃত্যুর পর থেকে আমরা আরো সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছি। ঈদুল ফিতরের তিনদিন এবং ঈদুল আজহার তিনদিনÑ এই ছয়দিন কেউ বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি। কোরবানি ঈদে নান্নু ভাই, তার মিলের জন্য ঢাকায় কোরবানি দেন। ঈদের পরের দিন দেশে কোরবানি দেন। আর আমরা সব ভাইয়েরা একসঙ্গে এলাকায় কোরবানি দিই এবং সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি।”
ঈদে আপনাদের পরিবারে একই রকম পোশাক পরার ঐতিহ্য রয়েছে। এটা কবে থেকে শুরু হয়েছে ?

“এটা শুরু হয়েছে আমার ভাতিজা শোয়েব কানাডা থেকে আসার পর। এই ট্র্যাডিশন আমার পরিবারে আগে থাকলেও এত বড়ো পরিসরে ছিল না।”দীর্ঘদিন ধরে এই ধারা চলে আসলেও বাধ সাধল বৈশি^ক মহামারি করোনা ভাইরাস। এর প্রকোপের কারণে গত দুই বছর ঈদপুনর্মিলনী করতে পারেনি বেপারি পরিবারের সদস্যরা। দুই বছর বিরতির পর ৪ মে ২০২২ আবারো সরগরম হয়ে উঠছে হলুদিয়ার বেপারি বাড়ি। এই ধারা অব্যাহত থাকুক অনন্তকাল। শুভকামনা রইলো এই পরিবারের প্রতিজন সদস্যের জন্য।

ছবি : জাকির হোসেন