সুরের এক সফল পথিক তানভীর তারেক

03 Jan 2021, 03:02 PM সারেগারে শেয়ার:
সুরের এক সফল পথিক তানভীর তারেক

সংগীত নিয়ে তাঁর ২৩ বছরের পথচলা- জীবনসংগ্রামের সেরা সাফল্যের আনন্দে তানভীর তারেক প্রথম নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন পূর্বোক্ত কথাগুলো। এবছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯ এ শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ছবিতে একটি দেশের গানের জন্য এই সম্মাননা পেলেন তিনি। গত ৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। তার কিছুদিন পরই একই গানের জন্য সেরা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। আজ সারেগারের এই আয়োজনে থাকছে সফল এই সঙ্গীত পরিচালককে নিয়ে কথোপকথন। লিখেছেন নিথর মাহবুব...


“বাবা,

কী করো ? ভাতঘুম দিয়েছ ? নাকি উঠে বসে আছো বারান্দায়!

তোমাকে ফোন করছি আমি গত ১২ মিনিট ধরে তোমার পুরনো নম্বরটায়। ফোনটা ধরো প্লিজ। জানো তোমার ছেলেটা আজ কাজের জন্য জীবনের সেরা স্বীকৃতিটা পেয়েছে !

বাবা জানো ? এ শহরটা তোমার ছেলেকে কৃতজ্ঞতায় মুড়িয়ে দিয়েছে।

ভালোবাসায় আগলে রেখেছে। যে শহরে তুমি প্রথম নিয়ে এসে তোমার ছেলেকে কোথায় রাখবে ? কার বাসায় কে আশ্রয় দেবে ? তা নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে।

এক পর্যায়ে বলেছিলে- ‘চলো বাবা। এই ঢাকা শহরে রাখতে পারবো না মনে হয়।

গ্রামেই চলো.. এ শহর তোমার জন্য না। আমার সামর্থ্যরে শহর না এটা..।

বাবা সেই শহরের মানুষেরাই আমাকে বড়ো করেছে।

আদর শাসন করেছে। কাজ করার সুযোগ দিয়েছে.. অতঃপর বঙ্গবন্ধু কন্যা পুরস্কৃত করেছে..!! বাবা আমি এবছর সেরা সুরকার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি।

সর্বপ্রথম তোমাকেই জানালাম।

তুমি নিশ্চয়ই দেখছো!! তুমি নিশ্চয়ই শুনছো। ভালো থাকো। গত ১৩ বছর তোমাকে দেখি না। আজ ভিডিও কল দিতাম। অনেকক্ষণ তোমাকে দেখার ইচ্ছে ছিল! দেখতে চাইতাম ছেলের খুশিতে তোমার আনন্দে ছলছল করা চোখ।

ভালো থেকো বাবা।

- ইতি তোমার ছেলে”

সৈয়দ মো. তানভীর তারেক


আনন্দভুবন : প্রথমেই অভিনন্দন। এই দেশসেরা স্বীকৃতি নিয়ে আপনার উপলব্ধিটা শুনতে চাই-

তানভীর তারেক : ধন্যবাদ। প্রথমে বলে রাখি, আনন্দভুবন আমার স্মৃতিতাড়িত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে লিখে, আড্ডা দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। আজ সেখানে আমার সাফল্যের কথা বলতে পারছি এটাও একটা বড়ো অর্জন। আর উপলব্ধি নিয়ে আমার ভাবনাটা ভিন্ন। দেখুন এমন একটি বিশাল রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলে যা হয়... নিজেকে স্রষ্টার প্রতি বারবার শুকরিয়া জানাতে ইচ্ছে করে। আর বিগত পরিশ্রমের পরের যে এই আমি। সেই স্ট্রাগলের গল্পের একটি কার্যকারিতা আসে। অর্থাৎ আমার গল্প শোনার মানুষ বেড়ে যায়। এছাড়া আপনি জানেন তো আইয়ুব বাচ্চু, তপন চৌধুরী, অরুণা বিশ্বাস [আমার প্রিয় ক’জনার নাম বললাম শুধু] এমন অগণিত গুণী বরেণ্য ব্যক্তির হাতে পৌঁছায়নি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মান।

তার মানে এই নয় যে, তারা গুরুত্বহীন হয়ে গেল! কিংবা রাষ্ট্র তাদের যথাযথ সম্মান দিল না। বরং রাষ্ট্র তাদের এই সম্মাননা দেবার সুযোগ মিস করে ফেলল। কারণ, তাদের হাতে পুরস্কারটি সঠিক সময়ে উঠলে আয়োজনটিই আরো সমৃদ্ধ হতো। রাষ্ট্র ঠিকই তাদের সম্মান করেছে অনেকভাবে ; অন্য উপায়ে। এখন রাষ্ট্র আমার ২৩ বছরের পারিশ্রমিক দিয়েছে। ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এটা ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধ হওয়াটাই আমার মূল দায়িত্ব হবে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি, দেখুন আমার দেখা আইয়ুব বাচ্চুর একঘরের মানুষ, যিনি আইয়ুব বাচ্চুর হাতেই তারকা হয়েছেন। আমিও তাকে অডিও মাধ্যমে সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একজন সহায়ক ছিলাম। এককভাবে ক্যারিয়ার গড়লেন। পেলেন একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর কথা প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন জায়গাতেই বললেন তার গুরু পাননি, কিন্তু তিনি পেয়ে গেছেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। আমার প্রশ্ন এতে কী শিষ্য গুরুর থেকে বড়ো হয়ে গেল !! কখনওই না। মহীরুহরা ছোটো হয় না। তাদের সম্মান দিলে আশীর্বাদ নিলে বরং আরো অনেক পথ হাঁটা যায়।

আনন্দভুবন : আপনি গানের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। নিজের কথা ও সুরে ২৭টি অ্যালবাম প্রকাশিত। এর বাইরে নাটকে আবহসঙ্গীত করেছেন। সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন মাধ্যমটি বেশি আনন্দ দেয়।

তানভীর তারেক : অবশ্যই একটি মৌলিক কথা ও সুরে গান বাঁধতেই বেশি আনন্দ। গান লেখা ও সুর দুটোই ভালো লাগার জায়গা। ইচ্ছে করে প্রতিদিনই নতুন নতুন সুর বাঁধি।

আনন্দভুবন : আপনার এ শহরে কাজের ব্যাপ্তি বিস্তৃত। একাধারে সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, উপস্থাপনা, সর্বশেষ যোগ হয়েছে ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। সেক্ষেত্রে গানের তানভীর তারেকের বেড়ে ওঠার গল্প খানিকটা শুনতে চাই-

তানভীর তারেক : আমি সবসময়ই বলি, আমি আমার নিজস্ব আনন্দে বাঁচি। এই শহরের প্রতি আমার আজন্ম কৃতজ্ঞতা। আমি সুর আর গানের টানেই শহরে এসেছিলাম। ভোরের কাগজের সঞ্জীবদা আমাকে বিনোদন সাংবাদিক বানিয়ে দিলেন। তাতে যা ভালো হয়েছে তা হলো নিজে টিকে থাকবার একটা শক্ত ভিত পেলাম। আমি গত দুই যুগের ঢাকার জীবনে একটি জিনিসই সঞ্চয় করেছি। তা হলো সম্পর্ক। তবে সবার সাথে না। গুণী মানুষদের সাথে সম্পর্ক গড়েছি। এই সম্পর্কগুলোই আমাকে সহযোগিতা করেছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে নিত্য নতুন কাজের।

আনন্দভুবন : গানে কীভাবে নিয়মিত হলেন-

তানভীর তারেক : মফস্বল থেকে আসা গানপাগল এক তরুণ তখন বিনোদন সাংবাদিকে কনভার্ট হয়ে গেল। কিন্তু মনে মনে খুঁজতে লাগলাম গানের পথ। আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের কাছে চলে গেলাম এক দুপুরে। গিয়ে মিথ্যা বললাম, যে সঞ্জীবদা আমাকে পাঠিয়েছে। এই বলে কথায় কথায় কাগজে প্রিন্ট করা ১০-১২টা গান তার হাতে দিলাম। বাচ্চু ভাই আমার মিথ্যাটা ধরে ফেললেন। এক বিকেল বসিয়ে আমার গল্প শুনলেন। হয়ত মানুষটার আমার প্রতি মায়া হলো। আমি অবাক হলাম। তিনি পরের সপ্তাহে যেতে বললেন। আমি ভাবলাম, আমার কাজ বোধহয় হয়ে গেল। পরের সপ্তাহে আমি গেলাম আবার এবি কিচেনে। আমাকে বললেন, তুই এইভাবে গান দিয়ে টিকে থাকতে পারবি না। তোকে তো নিজে আগে টিকে থাকতে হবে। তুই এক কাজ কর। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি সোজা সাউন্ডটেকে চলে যাবি। ওখানে কাজ পাবি।

আনন্দভুবন : কী কাজ দিয়ে শুরু করলেন সেখানে ?

তানবীর তারেক : আমি নিজেও জানি না। সেখানে কী কাজ করতে হবে। গান লেখা সুর করা ছাড়া তো কিছু জানি না। সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল ভাই বাচ্চু ভাইয়ের চিরকুট পড়ে আমার জীবনবৃত্তান্ত শুনতে লাগলেন। আমি আবারও আমার ঢাকা শহরের আশ্রয় সংকট নিয়ে বিস্তারিত বললাম। উনিও পরের সপ্তাহে আসতে বললেন। আমাকে অবাক করে দিলেন বাবুল ভাই। পরের সপ্তাহে ২ লক্ষ টাকা দিয়ে বললেন, যান গান বানায়া লইয়া আসেন। অথচ তখনকার মেসের জীবনে আমি একসাথে ২০ হাজার টাকাও দেখিনি। আমি বাবুল ভাইয়ের মতো একজন অভিভাবক পেলাম। এরপর একের পর এক নেশাতুর হয়ে কাজ করে গেছি। এসআইটুটুলকে একক সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি। তখন টুটুল এলআরবি ছেড়ে দেবে। কিন্তু আর্থিক সঙ্গত পাচ্ছে না। সেই সংগ্রামে সহায়ক হলাম। সেসময় তখনও টুটুল হুমায়ূন আহমেদের সাথেও পরিচিত হয়নি। এই অভাগা আমিই ছিলাম পাশে। একসাথে তখন ওকে নিয়ে ১৮ টি অ্যালবাম করলাম। অ্যালবামের একক সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।

আনন্দভুবন : চলচ্চিত্রে গানের কাজ শুরু কীভাবে হলো। তা থেকে যে গানটির জন্য পুরস্কার পেলেন সে সম্পর্কে শুনতে চাই -

তানভীর তারেক : জীবনের সবচেয়ে আরাধ্য পুরস্কারটি পেলাম। সত্যিই আমি অভিভূত। জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এটি আমার ১৭তম চলচ্চিত্রের কাজ। শুরু হয়েছিল একটি সিনেমার আইটেম সং-এর সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে। কৃতজ্ঞতা ছবিটির নির্মাতা মাসুদ পথিককে। ধন্যবাদ আমার গানের গীতিকার হেদায়েত উল্লাহ মামুন ও আমার গানের শিল্পী কোনালকে। একজন শিল্পীর জীবন পূর্ণ করে একটি জাতীয় পুরস্কার। আমার আনন্দটার বাড়তি কারণ আমি সৌভাগ্যবান যে, দেশের গানে সুর করবার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম। সবার কাছে প্রার্থনায় থাকতে চাই। ভালোবাসায় থাকতে চাই। যেন এই দেশের জন্য, প্রিয় এই শহরের জন্য বাকি জীবনটা শুভ কাজে খরচ করতে পারি। 