ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে করণীয় -ডা. আকলেছুর রহমান খান তুহিন

01 Jun 2022, 12:43 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে করণীয় -ডা. আকলেছুর রহমান খান তুহিন

প্রতিবছর বৃষ্টিপাত হলেই ডেঙ্গুর উপদ্রব বেড়ে যায়। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বৃষ্টিপাতের এই সময়টাতে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়, এটা আমাদের সবার জানা। অধিক বৃষ্টির কারণে জলবদ্ধতা, বাতাসে অধিক আর্দ্রতা, এডিস মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক। তাছাড়া পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, পানির ট্যাংক, ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। এদের ডিম ফোটানোর জন্য দরকার হয় পরিষ্কার পানি। তাই শুকনো মৌসুম বা শীতের সময় এডিস মশা কমে যায়। সবাই মিলে এই সময়টায় বাড়ির চারপাশ যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি তাহলে ডেঙ্গু থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকতে পারব।
এবার জেনে নিই এডিস মশা কখন কামড়ায়, ডেঙ্গুর লক্ষণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, চিকিৎসা-পদ্ধতি এবং সতর্কতা সম্পর্কে-
এডিস মশা কখন কামড়ায়
সাধারণত মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গুজ্বর হয়। এডিস মশা রাতে কামড়ায় না। ভোরে সূর্যোদয়ের ঠিক আধা ঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়ায়। তাই সকাল এবং সন্ধ্যা এই দুই সময়ে এডিস মশার কামড় থেকে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গু হচ্ছে একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য সব সাধারণ জ্বরের থেকে ডেঙ্গুজ্বর সম্পূর্ণ আলাদা। ডেঙ্গু হলে প্রথম দিন থেকেই প্রচণ্ড জ্বর অনুভূত হবে। জ্বর ১০২-১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। তার সঙ্গে তীব্র শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনের দিকে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা থাকবে। খেতে ইচ্ছে হবে না। বমি হতে পারে। শরীরে ক্লান্তিভাব অনুভূত হবে। শরীরে র‌্যাশ উঠতে পারে। পায়খানা কালো হওয়া, দাঁত মাজার সময় রক্ত পড়া এবং পেটে ব্যথা হওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধ
যেহেতু ডেঙ্গুজ্বর এডিস মশা দ্বারা ছড়ায় তাই এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রে এবং যেখানে ডিম পাড়ে সেই স্থানগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। বাড়ির আশপাশে, বাড়ির ছাদে, বাগানে, ঘরের ভেতরে বালতি বা পাত্র, ডাস্টবিন এসব স্থানে যেন চার-পাঁচদিনের বেশি সময় পানি জমে না থাকে সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আরো কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন-
এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় তাই দিনেরবেলায় ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, হাসপাতালের আনাচে-কানাচে মশার ¯েপ্র এমনভাবে ছিটাতে হবে যাতে এসব স্থানে মশা আশ্রয় নিতে না পারে।
ঘরের দরজা-জানালা এবং ভেন্টিলেটারে নেট ব্যবহার করতে হবে যাতে ঘরের ভেতরে মশা প্রবেশ করতে না পারে।
ছোটোদের ফুলহাতা শার্ট, ফুল প্যান্ট এবং মোজা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে।
বাড়ির আশেপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় যত্রতত্র পড়ে থাকা পুরনো ক্যান, টিনের কৌটা, বোতল, মাটির পাত্র, নারকেলের খোসা, পানি জমে থাকে এমন পাত্র নষ্ট করে ফেলতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে, এগুলোতে যেন পানি জমে থাকতে না পারে।
গোসলের বালতি, মগ, ড্রাম বা অন্য কোনো কিছুতে যেন পাঁচদিনের বেশি পানি জমে থাকতে না পারে। মনে রাখতে হবে স্থির ও পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বেশি জন্মায়।
ফেলে দেওয়া গাড়ির টায়ারে যেন পানি জমে থাকতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
ফ্রিজের নিচে ট্রেতে, এসি, ফুলের টব এবং মাটির পাত্রে পানি জমা থাকতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিতে হবে।

চিকিৎসা-পদ্ধতি
সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মতোই ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা। ডেঙ্গুজ্বরের আলাদা কোনো চিকিৎসা নেই। এমনকি চিকিৎসা না করলেও এমনিতেই জ্বর ভালো হয়ে যায়। ডেঙ্গুজ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে বিশ্রাম নিতে হবে এবং ঘন-ঘন তরল-জাতীয় খাবার খেতে হবে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমে যাবে। তাই সময়মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ থাকুন।

বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন
মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সাধারণ জ্বরের মতো অ্যাসপিরিন, ব্যথার ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে কোনো কাজ করে না। এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল জ্বর কমাতে সাহায্য করে। এসময় রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার দিতে হবে। প্রতিবেলা খাবারের সঙ্গে পানি, খাওয়ার স্যালাইন, জ্যুস, স্যুপ, তাজা ফলের রস একটু পর-পর খাওয়াতে হবে। যেসমস্ত শিশু মায়ের দুধ পান করে তাদের মায়ের দুধ খাওয়ানো যাবে। গর্ভবতী মায়েদের ডেঙ্গু হলে অন্যসব রোগীদের মতোই যত্ন নিতে হবে।

রোগী কখন মারা যায়
তাপমাত্রা যখন অত্যধিক বেড়ে যায় তখন শরীরে দ্রুত পানি শূন্যতা দেখা দেয়। শরীরের কোষের ভেতরে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং আশপাশের রক্তনালিতে চাপ পড়ার কারণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রক্তক্ষরণ বেশি মাত্রায় হলে রক্তের অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের সংখ্যাও কমে যায়। শরীরে প্লাটিলেট কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। যার কারণে আস্তে আস্তে রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকে। তখন শক সিনড্রোমের দিকে রোগী চলে যায়। যার ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা না করালে রোগী মারা যেতে পারে।

রক্তের পরীক্ষা
সাধারণত লক্ষণ দেখে চিকিৎসকগণ রক্তের বিশেষ অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু সনাক্ত করে থাকেন। তবে, এটি ডেঙ্গু রোগী সনাক্তের নিশ্চিত পরীক্ষা নয়। সাধারণ জ্বর হলেই এই পরীক্ষা করার দরকার নেই। কারণ, এটি একটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা। জ্বর যদি ১০৪ ডিগ্রির বেশি হয় তাহলে প্রথমেই শুধু রক্তের একটি রুটিন পরীক্ষা করে অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট কাউন্ট দেখে নেওয়া জরুরি। প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের নিচে হলে পরবর্তী পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক : ডায়াবেটোলজিস্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল