তিন মডেলকন্যার গল্প

29 May 2022, 02:20 PM অভোগ শেয়ার:
তিন মডেলকন্যার গল্প

মডেলিং কিংবা ছোটো ও বড়ো পর্দার অভিনয়শিল্পী হতে হলে নিজেকে প্রস্তুত করার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র হলো র‌্যাম্প মডেলিং। নতুন নতুন পোশাক পরে ক্যাটওয়াকিংয়ের সময় অবয়বের অভিব্যক্তির প্রকাশ একজন শিল্পীকে অভিনয়ে দক্ষ করে তোলে। শো-য়ে উপস্থিত দর্শকের করতালি সরাসরি উৎসাহ জোগায়। র‌্যাম্প থেকে উঠে আসা তিনকন্যা পিয়া, রিবা ও মাহির গল্প দিয়ে সাজানো হলো এবারে অঁভোগ। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন


দারুণ সাহসী পিয়া 

বাংলাদেশের মডেলিং জগতে যে কয়জন নারী-মডেল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া। নজরকাড়া গ্ল্যামারের অধিকারী এই র‌্যাম্প মডেল ও অভিনেত্রীর অর্জনের ঝুলিতে আছে বেশ কিছু দেশ-বিদেশের নানা সুন্দরী ও মডেল প্রতিযোগিতার শিরোপা।

সৌন্দর্য ও মেধার সমন্বয় যাকে বলে, জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়ার ক্ষেত্রে কথাটি একদমই মিলে যায়। তিনি একাধারে মডেল, অভিনেত্রী, উপস্থাপক, ব্যবসায়ী ও আইনজীবী। এক ফটোগ্রাফারের মাধ্যমে পিয়ার মডেলিং জগতে আসা। এরপর খুব তাড়াতাড়ি র‌্যাম্প ও স্টিল ছবিতে বেশ পরিচিতি পেয়ে যান। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন ও শিরোপা জেতেন। মিস বাংলাদেশ হওয়ার আগেই মূলত আড়ং-সহ বেশ বড়ো বড়ো ব্র্যান্ডের মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তবে মডেলিংয়ের শুরুর দিকের রাস্তাটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। পরিবার খুব একটা সাপোর্ট দেয়নি এই কাজে। বাবার সঙ্গে বেশ মনোমালিন্যও ছিল। পরবর্তীসময়ে অবশ্য পিয়ার রাগ, জেদের কাছে সবাই হার মেনে নেয়। কারণ, পিয়া তার কাজ নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। আর প্রতিভা এবং অধ্যবসায় থাকলে সব জয় করা সম্ভব এমনটাই মনে বিশ্বাস রাখেন পিয়া।

প্রাণ ম্যাঙ্গো জ্যুস দিয়ে প্রথম টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজ শুরু করেন তিনি। একটি পন্ডসের বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশ পরিচিতি পেয়ে যান। ক্রিকেটার তামিম, সাকিবের সঙ্গেও একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে মিস বাংলাদেশ খেতাব জয়ের পর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। জার্মানিতে টপ মডেল অব দ্য ওয়ার্ল্ড, সাউথ কোরিয়ার মিস ইউনিভার্সিটি ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ও মিস ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস ইন্টারন্যাশনাল ২০১৩ প্রতিযোগিতায় বেশ খোলামেলা পোশাক পরে দেশে অনেক আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তবে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন আমার শরীর নিয়ে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী। কোনো পোশাকে অস্বস্তি আমার হয় না। আর এত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ইচ্ছেটাও হয়েছে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থেকে। নিজেকে যাচাই করা ও নিজের দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তিনি বেশ কয়েকটি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। তিনি পরিবার ও পেশাগত কারণে মিডিয়ায় খুব একটা সময় দিতে পারেন না। আর নাটক ও চলচ্চিত্রে কাজ করতে গেলে প্রচুর সময় না দিলে ভালো করা সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রগুলোতে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারছেন না। বর্তমানে পিয়া মডেলিং-এর পাশাপাশি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন। বেশ বড়ো আইনজীবী হবেন এই স্বপ্নই তিনি দেখেছেন সব সময়। তিনি লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিসে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন ‘বই’ নামের এক সংগঠনের মাধ্যমে, যা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন বন্ধুদের নিয়ে।

বাবা মাহমুদ হাসান চৌধুরী ও মা মাহবুবা চৌধুরীর ঘরে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর জন্ম হয় পিয়ার। ছেলেবেলা কেটেছে খুলনায়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে করেন ফারুক হাসান সামীরকে। আরিস নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে তার। যারা নতুন মডেলিং-এ আসছে বা কাজ করছে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কাজে ভালো করার জন্য কাজের প্রতি প্যাশন থাকা জরুরি। প্রতিভা, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস থাকলে সব কিছুতেই সফল হওয়া সম্ভব।


অতিশয় ধৈর্যশীল রিবা

র‌্যাম্প মডেল সাবরিনা জামান রিবাকে নতুন করে পরিচিত করানোর কিছু নেই। প্রায় একযুগ ধরে জনপ্রিয় মডেল হিসেবে কাজ করে চলেছেন। ফ্যাশন মডেলিং-এ বেশ পরিচিত মুখ তিনি। প্রচুর র‌্যাম্পে ক্যাটওয়াক করেছেন, নামিদামি ব্র্যান্ডের সঙ্গেও কাজ করছেন দীর্ঘদিন। কিছু টিভিসিতেও কাজ করেছেন।

সাবরিনা জামান রিবার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। বাসার একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়ায় অনেক আদরেই তিনি বড়ো হয়েছেন। মায়ের হিল জুতো নিয়ে ছেলেবেলা থেকেই আয়নার সামনে মডেল হওয়া ছিল তার প্রিয় খেলা। সেই প্রিয় খেলা একদিন শখে পরিণত হয়। পুরোদমে মডেলিং শুরু ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এরপর ফটোশুট, র‌্যাম্প, টিভিসি। রেগুলার শো শুরু করেন ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। বেশ স্ট্রাগল করে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মিডিয়ায় যেহেতু তেমন পরিচিত কেউ ছিল না তাই সবকিছু নিজেকেই করতে হয়েছে। রিবা মনে করেন, তিনি তখনকার মডেলদের মতো অত ভাগ্যবানও ছিলেন না।’ তাই পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতায় তিনি হেঁটেছেন স্বপ্নের পথে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন তিনি।

মূলত বাসায় অনেক স্পেস আছে, তাই র‌্যাম্পে হাঁটার প্র্যাকটিস করেছি। আমি আমার কাজে বেশ ধৈর্যশীল। আমি মডেলিং ভালোবাসি, আমি সব সময়ই চেয়েছি শতভাগ মডেল হতে তাই টিভিনাটকগুলোতে অভিনয়ে আগ্রহী ছিলাম না। তবে ভালো গল্প পেলে চলচ্চিত্রে কাজ করতে উৎসাহী রিবা। রিবার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে বাংলাদেশ, ফ্যাশন উইক, আড়ং, ফ্যাশন শো, খাদি ফেস্টিভ্যাল, জুরহেম এস/এস এফ/ডব্লিউ ফ্যাশন শো, লাস্ট্রাস রানওয়ে, কালারস ম্যাগাজিন প্রেজেন্টস বিজনেস উইমেন’স অ্যাওয়ার্ডস শো, বিডি হিপহপ ফেস্ট, ঢাকা ফ্যাশন উইন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। র‌্যাম্পে হাঁটাহাঁটি রিবার কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয় মনে হয়। অডিয়েন্সের করতালি, লাইট সবকিছুই বেশ ভালো লাগে তার। এই ক্ষেত্রে নতুনরা আসতে পারে।

এ সেক্টরে কাজের সুযোগ অনেক রয়েছে। তবে রিবার পরামর্শ হলো বেসিক জ্ঞানটুকু জেনে তারপর যেন আসে। এতে কাজের মান ও নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দুটোই বাড়ে। কোভিড ১৯-এর কারণে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। তবে, ঘুরে দাঁড়ানোই প্রকৃতির ধর্ম। মানুষও ঠিক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে নতুন উদ্যোমে। মডেলিং-এর পাশাপাশি কোরিওগ্রাফিতেও সময় দিচ্ছেন রিবা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজের স্বপ্ন থাকে সব শিল্পীরই।


প্রবল আত্মবিশ্বাসী মাহি

বাংলাদেশের মডেলিং জগতে আরেক পরিচিত মুখ সাদিয়া আফরিন মাহি। মডেলিং-এর পাশাপাশি নাটক ও চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। স্টিল ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সংসার, কাজ মডেলিং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে আনন্দভুবনের সঙ্গে আড্ডায়...

বাবা মানিক হোসেন ও মা সামিমুন্নেসা সাকির ঘরে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন মাহি। ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। ছেলেবেলা থেকে খুব লাজুক স্বভাবের মাহি কোনোদিন চিন্তাই করেননি তিনি র‌্যাম্প মডেল হবেন অথবা মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত হবেন। কোনো এক বিয়েবাড়িতে তার ছবি তোলে এক ফটোগ্রাফার সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন, তারপর থেকেই নাটক, ফটোশুট ও মডেলিং-এর অফার আসতে শুরু করে। তবে প্রথমে পরিবার থেকে খুব একটা সাপোর্ট পাননি। পরবর্তীসময়ে জনপ্রিয়তা কিছুটা হাতের নাগালে এলে পরিবার তেমন আর বাধা দেয়নি। তবে র‌্যাম্পে খুব একটা সময় দিতে পারেননি। তাছাড়া র‌্যাম্প মডেলদের যে উচ্চতা থাকা প্রয়োজন সে তুলনায় কিছুটা কম তিনি। তাই র‌্যাম্পে খুব একটা হাঁটা হয়নি। তবে স্টিল ফটোশুটে বেশ নাম করেছেন তিনি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিন বছর টানা স্টিল ফটো করেছেন। মডেলিং-এ থাকা অবস্থায় এক পরিচিত পরিচালকের শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেন মাহি। কবি জসীম উদদীনের কবর কবিতা অবলম্বনে ওই শর্ট ফিল্মে মাহির অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়।

এরপর একই পরিচালকের সিনেমা ‘পদ্মপুরাণ’-এ অভিনয় করেন মাহি। এই সিনেমায় বেশ সাহসী অভিনয় করেছিলেন। ওই সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর ভূমিকায়। ‘পদ্মপুরাণ’ মুক্তির সময়েই বাস্তব জীবনে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। সিনেমাটির সঙ্গে এতটাই আবেগ জড়িয়ে ছিল যে, কন্যার নামও রাখেন ‘পদ্ম’। এই সিনেমায় চরিত্রের প্রয়োজনে মাথার চুলও ন্যাড়া করতে হয়েছে। একজন নারীর জন্য তার চুল বেশ মূল্যবান। এতেই বোঝা যায়, মাহি তার অভিনয়ে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। একই পরিচালকের আরো একটা সিনেমায় আগামীদিনে তাকে দেখা যাবে। আসন্ন কোরবানির ঈদে বেশ কয়েকটি নাটকের শুটিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। যারা নতুন র‌্যাম্প বা মডেলিং-এ আসছেন তাদের উদ্দেশে মাহি বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে মডেলিং-এর শুরুটা করেছিলাম কারণ তখন ওই বিষয়টাকে খুব ইতিবাচকভাবে দেখা হতো না। তাছাড়া আমার কোনো সঠিক গ্ল্যামিং ছিল না। তবে এখন যারা আসছে তাদের জন্য এই সময়টা বেশ অনুকূলে। যারা নিজেদের মনে করেন যে, মডেল হওয়ার মতো প্রতিভা এবং ভালো উচ্চতা রয়েছে, তারা যেন নিজেদের একটু গুছিয়ে তারপর মডেলিং-এ আসেন। কারণ, এই ক্ষেত্র থেকে তাদের কাজের পরিধি আরো অনেক বাড়বে। তাই লম্বা সময় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ ও কাজের প্রতি ভালোবাসা।