শীতকাহন

19 Jan 2021, 02:52 PM অভোগ শেয়ার:
শীতকাহন

শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এল

গানের বেলা শেষ না হতে হতে ?

মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো

ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পৌষ-মাঘ শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ হলো শীতের মোহনা। এসময় রিক্ত প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে চারপাশ। দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে রুপালি তারাখচিত শুভ্রতা। চাঁদের ধবধবে দুধসাদা জোছনা। পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রুপার থালা।

খালবিল থেকে বর্ষার জল শুকাতে শুরু করে। আকাশে ছন্নছাড়া নীল মেঘের ভেলা। কাশবনের শনশন শব্দ আর পাখ-পাখালির কিচির-মিচিরে মুখর জনপদ। প্রাণে প্রাণে কেমন যেন এক আকুলতা। খাল-বিল হাওড়ে শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। হেমন্তের এমন আবহাওয়াই জানান দেয় শীতের আগমনীবার্তা।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শীত পঞ্চম ঋতু। অন্য ঋতুগুলোর থেকে শীত একেবারেই আলাদা। গ্রীষ্মের মাঠ-ঘাট ফাটা খরতাপ, বর্ষার অবিরল বারিধারা, শরতের শুভ্র স্নিগ্ধতা পেরিয়ে আসে ঋতুর রানি হেমন্ত। নবান্নের এই ঋতুর হাত ধরেই আসে শীত। মাঠে মাঠে সোনালি ধান গোলায় ভরার উৎসবে মেতে থাকা মানুষের শরীরে লাগে শীতের পরশ। সকালের মিষ্টি রোদে পিঠ থুয়ে নতুন ধানের পিঠা-পায়েসের রসাস্বাদন- রসনা তৃপ্তি-শীতের সে এক অন্যরকম অনুভূতি।

খেজুরের রস, পাটালি গুড়, চিড়া-মুড়ির মোয়া, পিঠা-পায়েস, খড়-পাতার আগুনে ওম নেওয়া, বড়ো হাওড়, নদীর চরে অতিথি পাখির আনাগোনা, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশাঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দ-কষ্টের মিশেল নিয়ে আমাদের জীবনে শীতকাল উপস্থিত হয়।

শীতের মিষ্টি রোদ, কুয়াশার চাদর, উঠানের কোণে মাটির চুলার পারে গৃহিণীর রক্তাভ মুখ, চুলার পাশে বসে বসে ছেলেমেয়েদের হাতের তালু গরম করে নেওয়া, চায়ের কাপের সাদাটে ধোঁয়া, দিগন্তবিস্তৃত হলুদ সরষে ফুল, রবিশস্যের চোখ জুড়ানো সবুজ- এসব ছবি আর ছবির পেছনের গল্প আমাদের চিরচেনা। এর সাথে হিম হাওয়ায় ঠান্ডা-কাশি তো আছেই।

সা¤প্রতিক বছরগুলোতে পঞ্জিকার অনুশাসন মানছে না আর বিরূপ প্রকৃতি। বিশেষত, শহর ও শহরতলিতে শীত-গ্রীষ্মকে আলাদা করে চেনা কঠিন হয়ে উঠছে। শীত অনুভ‚ত হতে-না-হতেই বসন্ত এসে প্রকৃতিকে অধিকার করে নিচ্ছে।

শীতের পিঠা-পুলি

বাঙালির প্রিয় খাবারের তালিকায় শীর্ষে পিঠা-পুলির অবস্থান। শুধু স্বাদে নয়, এগুলো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও ধারক। পিঠার নকশায় ফুটে ওঠে নিবিড় শিল্পনৈপুণ্য। বাহারি নামের নানারকম পিঠার সৌরভে মুখর হয়ে থাকে চারদিক। পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাজাকলি, নারিকেলী, ভাপা, চিতই নকশিপিঠা কত কত নামের রসনাতৃপ্ত করা কত কত যে পিঠা তার কোনো শেষ নেই। খেজুরের রসে ভেজানো পুলি বা চিতই, বিশেষ করে ভাপাপিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায় এসময়। আতপ চালের গুঁড়ো, গুড় ও নারকেল সহযোগে তৈরি করা হয় ভাপাপিঠা। রসের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে বানানো হয় রসের পিঠা। এছাড়া দুধচিতই, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি প্রভৃতি পিঠারও বেশ প্রচলন রয়েছে।


শাকসবজির সম্ভার

আমাদের দেশে শীতকালে গ্রামের বিস্তৃর্ণ মাঠজুড়ে শীতকালীন শাকসবজি দিগন্তবিস্তারি দৃশ্য চোখে পড়ে। বছরের অন্যান্য সময় বাজারে টাটকা সবজি কম পাওয়া গেলেও শীতকালে বাজারে প্রচুর পরিমাণে শীতকালীন শাকসবজি পাওয়া যায়। এ সময় পেঁয়জপাতা ও কলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাঁজর, সিম, বেগুন, টমেটো, আলু, বরবটিসহ শীতকালীন সবজিতে ভরপুর থাকে হাট-বাজার। পালংশাক, মুলাশাক, লালশাকসহ নানাজাতের টাটকা শাকও পাওয়া যায় বাজারে।


অতিথি পাখির বিচরণ

এ-সময় উত্তর গোলার্ধের বরফে আচ্ছাদিত দেশগুলোতে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। বরফে ঢেকে যায় চরাচর। হারিয়ে যায় পাখিদের আশ্রয়স্থল। তাছাড়া এমন তীব্র শীত সহ্য করে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা প্রজাতির পাখি তাই হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের সন্ধানে আসে এই বাংলায়। তাদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠে বাংলার নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, ঝিল, জলাশয় ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। এ-সময় অতিথি পাখির গুঞ্জনে গ্রামবাংলা জেগে ওঠে নতুন রূপে। পাখিরা প্রতিবছর অগ্রহায়ণের শেষে ও পৌষমাসের শুরুর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে নীলশির, লালশির, কালো হাঁস, লেনজা হাঁস, খুদে গাঙ্চিল চুটকি, ফুটকি, লেঙ্গাসহ প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে বলে এই পাখিগুলোকে অতিথি পাখি বলা হয়। শীতজুড়েই থাকে অতিথি পাখিদের বিচরণ। এদেশের নদ-নদী, হাওর-বাওর যেন এদের নিরাপদ আশ্রয়। আমাদের দেশে দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন, সুনামগঞ্জের টাঙ্ওয়ার হাওর, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা চিড়িয়াখানার জলাশয়গুলোসহ গোপালগঞ্জ, খুলনা ও যশোরের বিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পার্বত্য এলাকাসহ কয়েকটি উপজেলায় অতিথি পাখির বিচরণ চোখে পড়ে।


উৎসবে ভাসে দেশ

হেমন্তের নবান্নের উৎসব শেষে এই শীত ঋতুতেই চলে নানাবিধ উৎসবাদির আয়োজন। কার্তিকের মঙ্গা অতিক্রম করে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে সোনার ধানে। শুরু হয় রবিশস্যের নতুন আবাদ। এর ফাঁকে ফাঁকেই চলে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক নানা উৎসবের আয়োজন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সংস্কৃতির যুগে আগের মতো না হলেও আমাদের বিনোদনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে যাত্রা ও পালা গানের আবেদন একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি। তা আমরা টের পাই শীত এলেই। শীত এলেই যাত্রা ও পালাগানের শিল্পীরা বেরিয়ে পড়ে গ্রামের পথে প্রান্তরে, এমন কি অনেক শহর বন্দরেও যাত্রা-উৎসব শুরু হয়।

ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণের আর চার লাখ নারীর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার বিজয়-উৎসবও হয় এই শীতেই। শীতের একেবারে শেষপাদে যখন আর কনকনে শীত অনুভ‚ত হয় না তখন জমে ওঠে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশের বইমেলা। একুশে ফেব্রæয়ারি ভোরে কুয়াশা মাড়িয়ে নগ্নপায়ের প্রভাতফেরি হেঁটে চলে শহিদমিনারে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।


শীতের পোশাক

শীতে আমাদের পোশাক, সংস্কৃতিতেও আসে অনেক পরিবর্তন। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষজন পরিধান করে গরম পোশাক। তবে শহরে কি গ্রামে দরিদ্র মানুষের জীবনে শীত আসে অভিশাপ হয়ে। শীত নিবারণের জন্য থাকে না তাদের তেমন গরম পোশাক। লোকালয়ের ভাঙাঘরে এবং শহরের বস্তিতে শীতের তীব্রতায় কুঁকড়ে থাকে হতদরিদ্র মানুষগুলো। খড়কুটো বা কাগজ কুড়িয়ে আগুন জে¦লে দলবদ্ধ হয়ে তারা শীত নিবারণের চেষ্টা করে।


বাহারি ফুলের শোভা

শিশিরভেজা এই সময়ে প্রকৃতিতে সৌরভ ছড়ায় নানাবর্ণের ফুল। শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে গোলাপ আর গাঁদা ডালিয়া, কসমস ফুলের চাষ হয়। শহর-নগর-প্রান্তরে শোভা পায় গোলাপ আর গাঁদার বাগান। শীতের শিশিরস্নাত ফুলের মধ্যে মল্লিকা, নয়নতারা, মাধবীলতা, রঙ্গন, অলোকানন্দ, দোপাটি অন্যতম।


পিকনিকের ধুম

আমাদের দেশে শীত মৌসুম শুরু হতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক শিক্ষা সফরের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বছরের এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে একদিনের জন্য ছুটে যান প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত কোনো স্থানে পিকনিক করতে। খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলায় বিনোদিত হয়ে ফিরে আসেন আপনভুবনে। পুনরায় ডুবে যান প্রাত্যহিকতায়।


আছে রোগেরও প্রকোপ

শীতকাল উপভোগ্য হলেও এই মৌসুমে নানা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে ঠান্ডাজনিত নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। এ-সময়টাতে শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে নয়। যাতে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধি থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। এ-সময়ে সর্দি-কাশি, গলায় খুশখুশ ভাব, নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরা এবং ঘন ঘন হাঁচি, ভাইরাসজনিত জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও খাদ্যে অরুচিসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। শীতকালে নাক, কান ও গলায়ও বিভিন্ন সমস্যা হয়ে থাকে। শীতে ত্বক শুষ্ক হয়, ত্বক ফেটে যায় এবং একজিমা, চুলকানির মতো চর্মরোগ দেখা দেয়।


করোনার প্রকোপে এবার আর শীত উপভোগ্য নেই

গত বছরের ডিসেম্বরে চিনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ শাসন করছে পুরো বিশ^। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই এ-বছর বাংলাদেশেও শীত বরাবরের মতো আর উপভোগ্য নেই। করোনার সংক্রমণ এড়াতে মানুষজন অনেক উৎসব আয়োজন, পিকনিক করা থেকে বিরত থাকছে।

খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২১-এর নতুন সূর্য নিশ্চয়ই বয়ে আনবে সুদিনের বার্তা। হ্যাপি নিউ ইয়ার 

লেখা : শ্যামল কায়া

ছবি : সংগ্রহ