দেওয়ান সাঈদুল হাসান : বহুমাত্রিক এক প্রতিভা

25 Apr 2022, 12:55 PM অন্যান্য শেয়ার:
দেওয়ান সাঈদুল হাসান : বহুমাত্রিক এক প্রতিভা

দেওয়ান সাঈদুল হাসান শুধু একজন দর্শক-শ্রোতাপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক ও নন্দিত আবৃত্তিকারই নন। তিনি কবি এবং গীতিকারও। দেশের প্রথম সারির দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় তাঁর কবিতা ও ছড়া প্রকাশ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ‘বৈঠা’ নামে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন তিনি। বিস্তারিত লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...

দেওয়ান সাঈদুল হাসানের জন্ম ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫, নরসিংদী জেলার সদর উপজেলার সাটিরপাড়া গ্রামে। বাবা মরহুম মো. রোস্তম আলী দেওয়ান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেই সূত্রে কৈশোর ও কৈশোরোত্তীর্ণ সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায়। পেয়েছেন শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিদগ্ধ, বরেণ্য ও সৃজনশীল মানুষদের সান্নিধ্য। বাবা শিক্ষকতা এবং লেখালেখির পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতারে বিদেশি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের কথক ছিলেন। জীবনে তার প্রভাব ব্যাপক। মানবিক গুণাবলি অর্জনের ক্ষেত্রে যার কাছে বিশেষভাবে ঋণী, সৃজনশীল ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের যিনি ছিলেন সতত উৎসাহদাতা। তিনি সমাজ সচেতন, উদার ও সংস্কৃতিমনা মা মরহুমা বেগম শাহিদা দেওয়ান। তাদের তিন পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে দেওয়ান সাঈদুল হাসান সর্বকনিষ্ঠ।

দেওয়ান সাঈদুল হাসান উদয়ন বিদ্যালয়, ঢাকা থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক [সম্মান] ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীসময়ে যুক্তরাজ্যের উত্তর আয়ারল্যান্ডের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেন। সাংবাদিকতায় পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

সাঈদুল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কণ্ঠশীলনে আবৃত্তি ও বাচনিক উৎকর্ষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক, অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস, বিপ্লব বালা পরবর্তীসময়ে বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী স্থপতি কাজী আরিফের সান্নিধ্যে আসার এবং জানার সুযোগ হয়েছে। কাজী সব্যসাচী, গোলাম মুস্তাফার আবৃত্তি শুনে বিস্মিত হতেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আসাদুজ্জামান নূরÑ এদের আবৃত্তিশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে আবৃত্তিশিল্পের প্রতি আগ্রহ আরো বেড়েছে।

তিনি গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি ‘স্বরশ্রæতি’ নামক আবৃত্তি সংগঠনে যুক্ত থেকে আবৃত্তি করেছেন বেশ কয়েক বছর। বর্তমানে মুক্তকণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সংগঠনের বেশ কিছু আবৃত্তি অনুষ্ঠান প্রযোজনা, গ্রন্থনা, সঞ্চালনা করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম [সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল ও বেতার কেন্দ্র] এবং দেশের বিভিন্ন আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আমন্ত্রণে নিয়মিত আবৃত্তি করছেন। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের বোধন আবৃত্তি পরিষদের আমন্ত্রণে আবৃত্তি সন্ধ্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বনি এবং ধৈবত আবৃত্তি ভূমি মাদারীপুরের আয়োজনে আবৃত্তির যুগলবন্দি ‘রৌদ্র করোটি’তে, শ্রæতি সিলেট আয়োজিত আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন এবং দর্শক-শ্রোতাদের ভালোবাসা ও আগ্রহ তাকে প্রেরণা ও আনন্দ দিয়েছে। ভারতের বেশ কয়েকটি আবৃত্তি সংগঠন আমন্ত্রণ জানালেও করোনার কারণে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, করোনাকালীন দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সংগঠনের অনলাইন আবৃত্তি আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং এখনো করছেন। সাঈদুল হাসান বর্তমানে বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদের যুগ্ম আহŸায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

আবৃত্তি করতে তার ভালো লাগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কখনো জীবনানন্দ দাশের কবিতা। এছাড়া কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, কামাল চৌধুরী প্রমুখ [নাম বলে শেষ করা যাবে না] খ্যাতিমান ও স্বনামধন্য কবিদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কবি যেমনÑ বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী প্রমুখ কবিদের কবিতা এবং দেশের সামসময়িক জনপ্রিয় কবিদের কবিতাও থাকে তার আবৃত্তি নির্বাচনে। ইতোপূর্বে একক অ্যালবাম প্রকাশ সম্ভব না হলেও আবৃত্তির বিভিন্ন অডিও ভিডিও তার রয়েছে। এ বছরই একটি একক এবং একটি দ্বৈত আবৃত্তির অ্যালবাম প্রকাশের কাজ চলছে।

কবিতা এবং আবৃত্তিশিল্পের প্রতি নিজের গভীর আকর্ষণ, চর্চা ও নিবেদিত থাকার স্বীকৃতি হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছেন। পুরস্কারের চাইতে দর্শক-শ্রোতাদের বিপুল উৎসাহ, অনাবিল ভালোবাসা পাওয়াই মুখ্য তার কাছে। বাংলাদেশে এখন আবৃত্তিশিল্পের গুরুত্ব বেড়েছে অনেক। বেড়েছে চর্চা এবং ঘটছে এর বিকাশ। দর্শনীর বিনিময়েও মানুষ আবৃত্তি শুনছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মিলছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আবৃত্তির একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন এদেশে নতুন প্রজন্ম আবৃত্তিশিল্পকে পেশা হিসেবে নিতে পারবে। মনে রাখতে হবে হুট করেই শিল্পী হওয়া যায় না। কবির বক্তব্য সফলভাবে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে হলে উপযুক্ত কণ্ঠস্বর তৈরি ও উচ্চারণের প্রমিতরূপ রপ্ত করতে হবে। চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সাধনা। গুণী মানুষদের আবৃত্তি শুনতে হবে বেশি বেশি। বুঝতে হবে কবিতার শব্দ, আবেগ, কবিতার চিত্রকল্প, রূপকল্প। সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারে গভীর বোধসম্পন্ন হওয়াটাও জরুরি।

দেওয়ান সাঈদুল হাসান গত শতকের নয়ের দশকের শুরু থেকে সক্রিয় হন সংবাদ উপস্থাপনায়। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ উপস্থাপন করছেন নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে। বিবিসি বাংলায়ও সংবাদ উপস্থাপন করেছেন বেশ কয়েক বছর। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং দেশের সকল বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজ প্রেজেন্টারদের একমাত্র রেজিস্টার্ড সংগঠন নিউজ প্রেজেন্টার্স সোসাইটি অব বাংলাদেশÑ এনপিএসবি [যা এর আগে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ সংবাদ পাঠক সমিতি নামে]-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোপূর্বে এ সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশিন এবং বাংলাদেশ বেতারে অডিশন বোর্ডের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ঢাকাস্থ জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট-সহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বাচিক প্রতিষ্ঠানে সংবাদ ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা এবং আবৃত্তির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন।

দেওয়ান সাঈদুল হাসান সংবাদ উপস্থাপনা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলাদেশের জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান, মুজিব বর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনারও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ বেতারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রন্থনার পাশাপাশি বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করে থাকেন তিনি।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সংবাদচিত্রে কণ্ঠ দান, আন্তর্জাতিক জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদিবস উদ্যাপন, আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমনদিবস, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ইত্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বিষয়ের উপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রেও ধারা বর্ণনা করে থাকেন। এছাড়া টিভিসি, ওভিসিতেও কাজ করেন তিনি।

দেওয়ান সাঈদুল হাসান শুধু একজন দর্শক-শ্রোতাপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক ও নন্দিত আবৃত্তিকারই নন, তিনি কবি এবং গীতিকারও। দেশের প্রথম সারির দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় তিনি কবিতা ও ছড়া লিখে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ‘বৈঠা’ নামে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন তিনি। বর্তমানে ‘চর্যাপদ’ নামে লিটল ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার সাঈদুল হাসান। তার লেখা গান বেশ কয়েকটি সিডিতেও প্রকাশ হয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীদের গাওয়া তার রচিত ও প্রকাশিত অ্যালবাম ‘উদাসী ঘুঙুর’ শ্রোতাদের মন জয় করেছে।

এক সময় লীগে ক্রিকেটও খেলেছেন তিনি। এছাড়া ভ্রমণ ও ফোটোগ্রফির প্রতি তার রয়েছে বিশেষ টান। তার প্রিয় রং নীল। পছন্দ বাংলাদেশি যেকোনো খাবার। স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন দেশীয় আরামদায়ক পোশাক পাঞ্জাবি-পায়জামা।

পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কাজের সূত্রে এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি ভ্রমণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ।

দেওয়ান সাঈদুল হাসান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। সহধর্মিণী সামিয়া আলমও সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা, যিনি তার নিত্য প্রেরণার সঙ্গী।