পিতলের সেমাইকলের সময়টায়
শৈশবকাল কেটেছে আমাদের,
সোমাইকলের হাতল ঘোরানোর কাজটি
আমরাই করতাম- কী আনন্দে !
যদিও শ্রমসাধ্য ছিল তা...
তবুও ছোটোদের ওপর এ-দায়িত্ব এসে পড়ত
কাজটি নিরানন্দ ছিল না...
আনন্দের বিদ্যুৎ নিয়ে
আমরা একেক জন বাল্ব হয়ে জ্বলে উঠতাম যেন
পাড়ার এ-ঘরে ও-ঘরে,
যদিও তখন বিদ্যুৎ পৌঁছেনি পাড়ায়
হেরিকেনের আলোই ছিল রাত্রির ভরসা !
পাড়ার প্রত্যেক ঘরে ঘরে ছিল না তখন সেমাইকল
দু’চারটি ছিল মাত্র...
ঈদের আগেই, পাড়ার সকল পরিবারের প্রয়োজনে
হাতে হাতে তা ঘুরত,
ও-গুলোর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও
তা হয়ে উঠেছিল সমষ্টির ও পাড়া-মহল্লার !
পানিপট্টি দিয়ে...
অপরের জ্বর কমানোর ইচ্ছে লেপ্টে থাকতো বলেই
স্বর্ণসূত্রমিশ্রিত স্বপ্ন নিয়ে আমরা একসাথে সেদিন বেঁচেছিলাম।
পিতলের সেমাইকল
চেয়ার অথবা টেবিলে নাটবল্টু দিয়ে আটকে রেখে
আমরা সেমাই তৈরিতে মেতে উঠতাম,
তা রোদে শুকিয়ে ভাণ্ড নিয়ে তাতে ভরে তুলতাম,
শুধু ভাণ্ড ভরতো না ..
সেইসাথে আমাদের মনের ভাণ্ড কী খুশির জলে ভরে যেত,
এমন কি উপচে পড়ত !
সেই জল বেড়ে যেন সমুদ্রদয়িতা হয়ে যেত !
ঈদের আনন্দে
নানা রকম লোভনীয় খাবারের সঙ্গে
সেমাইয়ের অনুপস্থিতি
কল্পনা করিনি কোনোদিন,
আজও সেমাইয়ের কদর রয়েছে ঘরে ঘরে।
ঘরে বানানো সেমাই
শিশু-কিশোরের হাত-ছোঁয়ানো সেমাই
আমরা এখন কমই ব্যবহার করি,
আমরা এখন সবাই বাজারমুখী
বাজারের সেমাই নিয়ে ঘরে তুলি.. রান্না করি
হাতে তৈরি সেমাইয়ের বদলে এখন
লাচ্ছা সেমাই
ঘিয়ে ভাজা সেমাই
খোরমা সেমাই
খোচা সেমাই,
এ-বয়সে এসে দেখি বাজারে কত রকমের সেমাই।
ভাগ হয়ে যাওয়া সেমাইয়ের মতো
ঈদের আনন্দ ভাগ হয়ে যায়...
হতদরিদ্রের ঈদ এক ধরনের
ধনী লোকের ঈদ আরেক ধরনের।
যে শিশুটি ভাঙ্গারি টোকায় তার ঈদ এক ধরনের
অভিজাত এলাকায় ধনী শিশুটির ঈদ আরেক ধরনের।
চরের শিশুটি ঈদের দিনে ডাংগুলি খেলে
চরের ধুলোয়,
শহরের শিশুটি ঈদের দিনে ইচ্ছেমতো যেকোনো রাইডে উঠে খেলা করে
শহরের শিশুপার্কে।
যেকোনোই উৎসব হোক...
মানবিকতায় মোড়ানো ও সবার গ্রহণীয়
যেন গ্রহণ না লাগে... অন্ধকার গ্রাস না করে
বøাকহোলে পরিণত না হয়।
ঈদ উৎসবে...
ঐকসূত্র নিয়ে ঐকতান নিয়ে তানপুরা বাজাতে বাজাতে
যেন ঊষালোক ও রৌদ্ররাগে পরিব্যাপ্ত হই... প্রসারিত হই।
উৎসব সবার
জাহিদ মুস্তাফা
সম্পর্কের হাতে হাত রেখে
সামাজিকতার পাশে মানুষ দাঁড়ায়।
মানুষে মানুষে মিল হলে
জাতের বড়াই ঘুচে যায় !
ধর্ম যাই হোক-
নিরপেক্ষতার আলো জ্বেলে দেখো
আপনি আচরি ধর্ম- কোথাও তো বিরোধ নেই।
শতবর্ষ আগে প্রেম ও দ্রোহের কবি
নজরুল লিখেছিলেন-
‘হিন্দু না, ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন
কাÐারী বল-ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার !’
পৃথিবীর সর্বত্রই গুণিজনেরা কহেন-
ধর্ম যার যার, উৎসব তো সবার।
ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে উৎসবে রঙিলা মন
এই তো বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি, এই তার জাত চেনা
শেকড়ের মূল পরিচয়।
এইসব মানবিক উৎসবের উৎস থেকে
জেগে ওঠে বলোÑ আমরা বাঙালি
ততোধিক আমরা মানুষ
সরলা পৃথিবী এই-আমাদের আরাধ্য জননী।
ঈদ
শিহাব শাহরিয়ার
ঈদ মানে কাজী নজরুল-‘এলো খুশির ঈদ’
ঈদ মানে কাস্তের মতো একফালি বাঁকা চাঁদ
ঈদ মানে লাল-নীল গামছা, রঙিন নতুন লুঙ্গি
ঈদ মানে নদী-পাড়, সবুজ-ঘাস, ঈদগাহ-মাঠ
ঈদ মানে দিনের সূর্য, নামাজ, সারি সারি কাঁধ
ঈদ মানে কোলাকুলি শিশু-বুকের আনন্দ-ওম
ঈদ মানে পিঠা-পুলি, পোলাও-কোর্মা, সেমাই
ঈদ মানে কিশোরীর সকাল, সাথে বাহারি ফ্রক
ঈদ মানে সেলামি পা ছুঁয়ে পাওয়া নতুন টাকা
ঈদ মানে ঘ্রাণমাখা শাড়ি, কামিজ, পায়জামা
ঈদ মানে পাঞ্জাবি, টুপি মাথায় মনোরম হাসি
ঈদ মানে সৌহার্দ্য-দড়ি বেড়েই চলবে ফি বছর
ঈদ যেন না হয় গরিবের একই ঘুমভাঙা ঘর
ঈদ যেন না হয় ধনির রুপালি গাড়ির ঝিলিক
ঈদ যেন হয় সব মানুষের ভেদাভেদহীন পার্বণ
আনন্দ ফিরে আসে
মীর মাসরুর জামান
নতুন চাঁদের আলোর সাথে
আনন্দ ফিরে আসে
উঁচু-নিচু নেই
জাতপাত নেই
শুভর বার্তা মনের ভেতর
সুবাতাস হয়ে ভাসে।
ভালোবাসলেই চাঁদ ছোঁয়া যায়
চাঁদ মানুষের মনে
কোনো ঘৃণা নেই
রাগ কিছু নেই
ত্যাগের সঙ্গে প্রেম ছুঁয়ে যায়
সব জন থেকে জনে।
মন ভালো তাই মনে পাওয়া যায়
নতুন ফুলের ঘ্রাণ
কোনো ক্ষোভ নেই
বিদ্বেষও নেই
ক্ষমা-মমতায় ভরা মায়াময় সব
আলো জ্বেলে রাখা প্রাণ।
উৎসব শুধু উৎসব নয়
মানুষের জয়গান
হিংসাও নেই
হানাহানি নেই
ভয়ভীতি আর শঙ্কা-জড়তা
সব হয়ে যাক জ্ঞান।
মানুষে-মানুষে ঠিক মিলে যায়
অশুভের পরাজয়
হতাশাও নেই
ক‚টিলতা নেই
হাসুক মানুষ প্রাণ খুলে আর
বেদনার হোক ক্ষয়।
চাঁদের আলোয় মন ভরে থাকে
ঈদে আর পার্বণে
সঙ্কোচ নেই
জড়তাও নেই
আকাশ-সমান মন খুলে যায়
আকাশ সবার মনে।