সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার জন্যই আমার কাজ -মনির খান

24 Apr 2022, 01:10 PM সারেগারে শেয়ার:
সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার জন্যই আমার কাজ -মনির খান

মনির খান ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘তোমার কোনো দোষ নেই’ নামের একটি একক অ্যালবাম রিলিজের মাধ্যমে সংগীত জীবন শুরু করেন। দীর্ঘ সংগীতজীবনে তিনি ৪৩টি একক অ্যালবাম, তিন শো’র বেশি মিক্সড অ্যালবাম এবং চার শো’রও বেশি ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। তার গানের সংখ্যা ছয়শত। তিনি তিনবার পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। গুণী এই শিল্পীর সংগীতজীবনের নানার বিষয় নিয়ে কথা হয় আনন্দভুবনের সঙ্গে। সেই কথার চুম্বক অংশ আনন্দভুবনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...
মনির খান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগস্ট ঝিানাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল শিক্ষক পিতা মো. মাহবুব আলী খান এবং মাতা মোছা. মনোয়ারা খাতুনের ঘরে এক বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে মনির খান দ্বিতীয়। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর হাকিমপুর এবং যশোরের চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর বহরাম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন কোটচাঁদপুর ডিগ্রি কলেজে। একই কলেজ থেকে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ডিগ্রি পাশ করেন।


মনির খানের ছেলেবেলা কেটেছে তার নিজ গ্রামে বন্ধুদের সঙ্গে পুকুরে সাঁতার কেটে, মাছ ধরে, খেলাধুলা করে। সব মিলিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন এই শিল্পী। এ সবের মধ্যেও ছেলেবেলা থেকেই তার গানের প্রতি একটা নেশা ছিল।
মনির খানের সংগীতে হাতেখড়ি ওস্তাদ রেজা খসরুর কাছে। তনার হাতেই পদ্ধতিগতভাবে প্রথম গান শেখা। তারপর স্থানীয় আরো কয়েকজন ওস্তাদের কাছে গান শিখে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন গান করবেন বলে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে যখন স্কুল-কলেজে পড়েন তখন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। যেখানেই অংশগ্রহণ করতেন সেখানেই মানুষের খুব বাহবা পেতেন। ভক্তশ্রোতারা গান শুনে হাততালি দিতেন, উৎসহ দিতেন। ছেলেবেলায় গান গেয়ে বহু পুরস্কারও পেয়েছেন। তখন থেকেই মনির খানের গানের আগ্রহটা অনেক বেড়ে যায়। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি পরীক্ষার পর রেজাল্ট বের হওয়ার আগ পর্যন্ত তিন মাস বা সাড়ে তিন মাস একটা সময় থাকে। সেই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য বাবা একটি হারমোনিয়াম কিনে দেন তাকে। বাবা বলেন, সংগীতের প্রতি তোমার একটা মোহ আছে। তুমি লেখাপড়ার পাশাপাশি সংগীত নিয়েই থাক। তারপর বাবাই ওস্তাদ ঠিক করে দিলেন। তখন থেকেই গান-বাজনা শুরু। এরপর সেখান থেকেই আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছেন মনির খান।
বর্তমান সময়ে ব্যস্ততা সম্পর্কে মনির খান বলেন, আমি তো গানের মানুষ তাই গান নিয়েই যত ব্যস্ততা আমার। আমার দুটো ইউটিউব চ্যানেল আছে। চ্যানেল দুটির জন্য দুটি ইসলামিক গান হামদ ও নাতের কাজ সম্প্রতি শেষ করলাম। যেহেতু এটা রোজার মাস তাই ইসলামিক গান দুটো করলাম। সারামাস জুড়ে আমার ইউটিউব চ্যানেলে গান দুটো চলবে। স্টেজ প্রোগ্রাম এবং আরো কিছু কাজ নিয়ে বর্তমানে ব্যস্ত আছি।
মনির খানের প্রায় গানেই একটা বিরহের ছাপ থাকে। বিরহের গান বেশি গাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের হিসাবে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে। আসলে সুখ, ভালো থাকা, ভালো লাগা খুবই সামান্য সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। আর বিরহ, দুঃখ-কষ্ট এটা দীর্ঘ সময়ের এবং এটা আপন মনের ভেতরে দীর্ঘসময় ধরে থাকে, এটা সহজে বের করা যায় না। আর সুখটা নেওয়ার জন্য আশেপাশে বহুলোক থাকে। দুঃখের সময় কেউ পাশে থাকে না। কাউকে পাওয়া যায় না। দুঃখটা একেবারেই আপন মনের আপন জনেরÑ একান্তই নিজের। আসলে কোনো মানুষ দুঃখের কথা শুনতে চায় না। দুঃখটা ভাগ করতে চায় না। তখন তার এই দুঃখের সঙ্গী হিসেবে বিরহের গানগুলোই তার কাছে আপন এবং সবচেয়ে প্রিয় মনে হয়। যার কারণে আমি এই জায়গাটা বেছে নিয়েছি।
মনির খানের বেশ কিছু গানে আলোচিত চরিত্র অঞ্জনা। তিনি ছাব্বিশটিরও বেশি গান গেয়েছেন অঞ্জনাকে নিয়ে। এই আলোচিত চরিত্র অঞ্জনার রহস্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মনির খান বলেন, এখানে আসলে আমি গল্পের কথা কিছু বলতে চাই না। এটা গানে গানেই বলা আছে। ইতোমধ্যে এবিষয়টি সব মানুষ জেনে গেছে। আপনিও হয়ত জেনেছেন। তারপরও বলি : ধরুন, আপনার কাছেও কোনো-না-কোনো বিষয় ছিল যা প্রকাশ করতে পারেননি। গান গেয়ে মানুষের সঙ্গে বিষয়টি ভাগাভাগি করার সুযোগ হয়েছে বলেই আমি এটা করতে পারছি। এই সুযোগ তো সবার হয় না। কারণ সবাই তো আর মনির খান নয়।
এখন আগের মতো অ্যালবাম বের হচ্ছে না। মিউজিক ভিডিও আকারে ইউটিউব চ্যানেলে গানগুলো রিলিজ হচ্ছে, এ ব্যাপারে মনির খান বলেন, আসলে গান সব সময়ের জন্যই শোনার এবং হৃদয়ে ধারণ করার। গান কিন্তু দেখার নয়। সিনেমা দেখার, নাটক দেখার, নৃত্য দেখার। গান শুধু শোনার জন্যই।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সেই স্বর্ণযুগের বিখ্যাত শিল্পীরা- মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, আশা ভোঁশলে, লতা মঙ্গেশকর- এদের গান কখনো কিন্তু আমরা ভিডিও আকারে দেখিনি। ইভেন আমাদের দেশের সৈয়দ আব্দুল হাদি, সাবিনা ইয়াসমীন রুনা লায়লা, এন্ড্রু বিশোর-সহ যত বড়ো বড়ো শিল্পীর কথাই বলি না কেন, তারা কিন্তু কখনোই ভিডিও আকারে তাদের গান আমাদের সামনে উপস্থাপন করেননি। তাদের গান শুনেই আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি, ভালো লেগেছে। এখন হয়ত যুগের চাহিদা অনুপাতে সময়ের দাবি হিসেবে ভিডিওটি এখন প্রয়োজন মনে হয়েছে। তারপরও আমি মনে করি, গানে ভিডিওর গুরুত্ব খুবই কম। ভালো বাণী, ভালো সুর, ভালো কম্পোজিশন, ভালো গায়কি এগুলোরই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ভিডিওটা হয়ত যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে। তবে, সেটার গুরুত্ব আমার কাছে কম। আমি গানটাকে শোনাতেই চাই।
সংগীতজীবনে একটি বিশেষ স্মৃতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তখন গ্রামে থাকি, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তো আমার কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঢাকা থেকে অনেক নামিদামি শিল্পীরা এসেছেন। আমাদের কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং এলাকার মানুষে মাঠ কানায়-কানায় পূর্ণ। সেই অনুষ্ঠানে আমি একটা গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। গান শেষ হওয়ার পর দর্শক মুহুর্মুহু তালি দিয়ে আরেকটি গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি সেখানে আরেকটি গান গাইলাম। তারপর আবারো গান গাওয়ার অনুরোধ এলো। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়টি হলো দর্শকসারি থেকে আমার গান শুনে একশত টাকা পুরস্কার দেওয়া হলো। মাইকে ঘোষণা করা হলো মনির খানের গান শুনে মো. মাহবুব আলী খান একশত টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। তো সেই টাকাটা নিয়ে আমি বাসায় এলাম। আসলে মাহবুব আলী খান আমার বাবার নাম। উনি যে অনুষ্ঠানে গেছেন আমি জানতাম না। দর্শক সারির পেছন থেকে গান শুনে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে একশত টাকা দিয়েছিলেন। বাসায় এসে জিজ্ঞেস করার পর বললেন, ‘হ্যাঁ আমি গিয়েছিলাম। তুমি গান গাচ্ছো, কেমন গাচ্ছো, দর্শক তোমাকে কেমনভাবে নিচ্ছে সেটা দেখার জন্য আমি গিয়েছিলাম। বাবা হিসেবে তোমাকে নয়, একজন শ্রোতা হিসেবে আমি তোমাকে টাকাটা দিয়েছি।’ বাবার কথা শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। তো বাবার দেওয়া সেই টাকাটা আমি আজও রেখে দিয়েছি। এটাই আমার জীবনে বড়ো প্রাপ্তি, বড়ো স্বীকৃতি, বড়ো আনন্দ এবং বড়ো স্মৃতি।
সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মনির খান বলেন, পরিকল্পনা তেমন কিছু নেই। আমি যেভাবে কাজ করছি সেভাবে কাজ করে যাব এবং সুস্থ চিন্তায়, সুস্থ অবস্থায় কাজ করে যেতে চাই। কারণ, এখানে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সুন্দর চিন্তায় ভালো কিছু করে জীবন পার করাই আমার স্বপ্ন। সংগীতকে সমৃদ্ধ করা এবং দেশের সুস্থ সংস্কৃতিকে যদি আমরা ভালোভাবে দাঁড় করাতে পারি সেটাই হবে দেশের জন্য এবং জনগণের জন্য কাজ করা। একটি সুস্থ সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে নিজেদের মুখ উজ্জ্বল করতে সহযোগিতা করে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার জন্যই আমার কাজ করার স্বপ্ন সবসময়।