আলিয়ার গাঙ্গুবাই হয়ে ওঠার গল্প

23 Mar 2022, 03:24 PM বলিউড শেয়ার:
আলিয়ার গাঙ্গুবাই হয়ে ওঠার গল্প

২৫  ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াদি’। ৪ মার্চ ছবিটি পৌঁছে গেছে ১০০ কোটির ঘরে। যতদিন যাচ্ছে ছবিটির আয় বেড়েই চলেছে। প্রধান চরিত্র আলিয়ার অভিনয়ে আবারো নড়েচড়ে বসেছে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। গাঙ্গুবাই চরিত্রের যথাযথ মর্যাদাই রেখেছেন আলিয়া। একটি বাস্তব চরিত্রকে কেন্দ্র করেই পরিচালক নির্মাণ করেছেন এই সিনেমা। আলিয়ার গাঙ্গুবাই হয়ে ওঠা ও গাঙ্গুবাইকে নিয়েই এবারের বলিউড আয়োজন...

লেখক হুসেন জাইদির বই ‘সাফিয়া কুইন্স অব মুম্বাই’-এর একটি অধ্যায়ের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে গাঙ্গুবাই সিনেমাটি।

গল্পটি মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার একটি পতিতালয়ের সর্দার গাঙ্গুবাইকে ঘিরে। মূলত গাঙ্গুবাইয়ের প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, উত্তরাধিকার ও পতিতালয়ের কুটিল রাজনীতির বাস্তব ঘটনা নিয়ে পরিচালক তৈরি করেছেন সিনেমাটি।

ছবির ট্রেলার দেখার পর অনেকেই আলিয়ার ওপর তেমন ভরসা করতে পারেননি। মনে হচ্ছিল গাঙ্গুবাই চরিত্রের সঙ্গে ঠিক যেন মানানসই নয়। তার জায়গায় তাব্বু কিংবা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া হলেও বোধহয় আরো মানানসই হতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে গঙ্গা বলিউডে নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রেমিক রমনিকের হাত ধরে ঘর ছাড়ে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার স্থান হয় কামাথিপুরার পতিতাপল্লিতে। কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন কামাথিপুরের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী।

প্রথমে অবশ্য হীরা মান্ডি নামে সিনেমা তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন সঞ্জয়লীলা বানশালি। আলিয়াকে যখন চরিত্রটির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আলিয়া নাকি কোনো কথা না বলে একদম বাসায় চলে গিয়েছিলেন। চরিত্রটি আলিয়ার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। বেশ্যালয়ের মালকিন হিসেবে সে যেভাবে প্রয়োজন তা কি ফুটিয়ে তুলতে পারবে আলিয়া ? এমন প্রশ্ন ছিল খোদ আলিয়ারই নিজের কাছে। কিন্তু আলিয়া জাত অভিনেত্রী। নিজেকে তৈরি করে নিয়েছেন চরিত্রটির জন্য। নিজের শরীরী ভাষা, কথা বলার ভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন এনেছেন আলিয়া আর ক্যামেরার সামনে দিয়েছেন উজাড় করে। তাতেই বাজিমাত। এখন মনে হচ্ছে গাঙ্গুবাই চরিত্রের জন্য আলিয়ার চেয়ে যোগ্য আর কেউ হতেই পারেন না।

তাছাড়া গাঙ্গুবাই চরিত্রটিকে বেশ গৌরবান্বিত করেই দেখিয়েছেন সঞ্জয়। আফসান হিসেবে শান্তনু মহেশ্বরীর অভিনয় যতটুকু ছিল তিনি ভালোই করেছেন। তবে রহিম লালার ভূমিকায় অজয় দেবগন অনবদ্য। সীমা পাহওয়া, ইন্দিরা তিওয়ারি নিজেদের ভূমিকা পালন করেছেন। রাজিয়াবাই হিসেবে বিজয় রাডাকে যেন সুযোগ দেওয়া হয়নি। আলিয়ার চরিত্রটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য চরিত্রগুলো যেন একটু ম্লানই হয়ে গেল। তবে এটা বলতেই হবে আলিয়া তার ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি চরিত্রে কাজ করেছেন এই গাঙ্গুবাই সিনেমায়।

ছবিটির শুটিং শুরু হওয়ার পর থেকেই নানা জটিলতা শুরু হয়। বারবার মুক্তির তারিখ পিছিয়েছে। এমনকি সিনেমাটির জন্য আইনি জটিলতায়ও ভুগতে হয়েছে সঞ্জয়লীলা বানশালী ও আলিয়া ভাটকে।

কে ছিলেন এই গাঙ্গুবাই, কেন তিনি এত আলোচিত ? চলুন জেনে নিই অল্প কথায় : গাঙ্গুবাই কাহিয়াওয়ারির বিখ্যাত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে হুসেন জায়েদির ‘মুম্বাই মাফিয়া ক্যুইন’ বইতে লেখা রয়েছে। সমাজে গণিকাদের অধিকারের জন্য লড়া থেকে শুরু করে তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজে গিয়ে কথা বলা, সমাজে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেইজন্য গাঙ্গুবাই একাই লড়েছিলেন। তাদের অধিকারও আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। তার সাহস ও অদম্য লড়াইয়ের জন্য রাজনৈতিক দলেও ডাক পেয়েছিলেন তিনি।

মুম্বাই নগরীর দক্ষিণ প্রান্তে কামাথিপুরায় বিশাল এলাকা নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের মদদে গড়ে উঠেছিল এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড়ো পতিতালয়। এর খদ্দেরদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ সৈনিক, দেশীয় রাজা-মহারাজা ও সমাজের বিত্তশালী লোকজন। সত্তর ও আশির দশকে কামাথিপুরা ছিল মুম্বাই মাফিয়াদের একটি প্রিয় আস্তানা। আর গঙ্গাবাই ছিলেন এই কামাথিপুরার সবার প্রিয় নেত্রী। গুজরাটের অভিজাত পরিবারে জন্ম হয় গঙ্গা হরজীবনদাস কাতিয়াবাদীর। সেই সময়েই তাদের পরিবারের মেয়েদের সিনেমা দেখার সুব্যবস্থা ছিল। সেই সিনেমা দেখে দেখেই গঙ্গার মনে নায়িকা হওয়ার বাসনা জাগে।

ঠিক ওই সময়েই রামলাল নামে এক যুবক গঙ্গার পিতার ফার্মে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করতে আসে। গঙ্গা জানতে পারে রামলাল নামের ওই তামিল যুবক আগে বোম্বে নগরীতে কাজ করত। গঙ্গারাম লালকে পেলেই বোম্বের নগরীর সিনেমা জগত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত। গঙ্গা রামলালকে তার স্বপ্নের কথা জানায় যে, সে বোম্বেতে নায়িকা হতে যেতে চায়। আর গঙ্গালালও জানায়, সে এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে চায়। গঙ্গা তার স্বপ্ন পূরণ করতে রামলালকে নিয়ে পাড়ি জমায় বোম্বেতে। কাটিয়াবাদের এক মন্দিরে বিয়েও করে নেয় দুজন।

মায়ের যে গয়নাগাটি ছিল সেগুলো নিয়ে এসেছিল। সেগুলো বিক্রি করে কিছুদিন চলা গেছে। এরপর রামলাল গঙ্গাকে তার এক মাসির কাছে কিছুদিন থাকতে বলে চলে যায়। পরে অবশ্য গঙ্গা বুঝতে পারে এটি একটি পতিতালয়। কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় গঙ্গা। এরপর গঙ্গা নাম পাল্টে হয়ে যায় গাঙ্গু। নিজ এলাকা কাতিয়াবাদী যোগ করে গাঙ্গু হয়ে উঠল কামাথিপুরার সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াদি।

অভিজাত ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে পতিতালয়ের অন্য মেয়েরা তাকে সমীহ করতে শুরু করে। খুব অল্প সময়েই তিনি নির্বাচিত হন ঘরওয়ালী নির্বাচনে। মুম্বাই মাফিয়া সর্দার করিম লালাকে রাখি পরিয়ে ভাই বানিয়ে গাঙ্গুবাই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করল কামাথিপুরায়। প্রতিপত্তিও অর্জন করে।

তিনি জোর করে কোনো মেয়েকেই পতিতালয়ে রাখতে রাজি ছিলেন না। কোনো মেয়ে থাকতে না চাইলে নিজ খরচে তাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে গাঙ্গুবাইয়ের নেতৃত্বে নিরাপদ থেকেছে কামাথিপুরার বাসিন্দারা। গাঙ্গুবাই প্রকাশ্যে সমর্থন করত পতিতালয়ের প্রয়োজনীয়তাকে। একবার মুম্বাই নগরীর বিখ্যাত আজাদ ময়দানে হাজার হাজার দেহকর্মীদের সম্মেলনে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়। তার সেই বক্তব্য ভারতজুড়েই আলোড়ন তুলেছিল। তখন তিনি হয়ে যান ‘প্রেসিডেন্ট অব কামাথিপুরা’। একবার প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল গাঙ্গুবাইয়ের। সেসময় কামাথিপুরা সংলগ্ন এক বালিকা বিদ্যালয় ছিল। অভিভাবকবৃন্দ পতিতালয় উচ্ছেদের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে। দেহকর্মীরাও তাদের জীবিকা টিকিয়ে রাখতে রাস্তায় নামে। তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সেই পরিস্থিতিতেই তিনি দেখা করেন নেহরুরর সঙ্গে। নেহরু তাকে বলেন, কেন তুমি এ নোংরা কাজ করছ। এসবের থেকে বের হয়ে ভালো কিছু করো। গাঙ্গুবাই বলেছিলেন আপনি আমাকে বিয়ে করেন এর থেকে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। এতে নেহেরু রেগে যান। তখন গাঙ্গুবাই বলেন, আমি শুধু আপনার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলাম। উপদেশ দেওয়া সহজ, বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। পতিতালয় উচ্ছেদ হলো না। স্কুল অন্যত্র সরে গেল।

এমন ঘটনাবহুল গাঙ্গুবাইয়ের জীবন। তাই তার জীবন নিয়ে সিনেমা হবে এটা স্বাভাবিক। তার জৌলুস ও সংগ্রামকে বেশ মর্যাদার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন আলিয়া। 

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন