একবার লতা মঙ্গেশকরকে এক ইন্টারভিউ-তে এ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আবার যদি কোনো জীবন পান তাহলে কি হয়ে জন্মাতে চান ? তিনি বলেছিলেন, “আমি আর যাই হই, লতা মঙ্গেশকর হয়ে জন্মাতে চাই না। কারণ, লতার যা কষ্ট তা শুধু লতাই জানে।” কী কষ্ট ছিল এই জাদুকরী কন্ঠের গায়িকার তা আর জানা হলো না। যার গান মন ভালো করেছে হাজারো মানুষের, তার মনে কি ব্যথা ছিল তা আর জানা হলো না। নিজের মতো করে হারিয়ে গেলেন তিনি। ৯২ বছর বয়সে পার্থিব জগতের মায়া ছেড়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন শূন্যতার সুরের জগতে। কিন্তু যুগ-যুগ ধরে তার কণ্ঠ বেঁচে থাকবে শ্রোতার মন ও মননে। তার মারা যাওয়ার খবরে শোকাহত গুণী এই শিল্পীর ভক্ত অনুরাগীরা। লতা মঙ্গেশকরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিকটদেশ-এর এই বিশেষ আয়োজন...
শশধর মুখার্জী তখন শহিদ [১৯৪৮] চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাজ করছেন। তার সিনেমাতে গান গাইবার জন্য ১৯ বছর বয়সী লতাকে নিয়ে আসেন সংগীতপরিচালক গুলাম হায়দার। গান শুনে শশধর মুখার্জী বললেন, “মেয়েটির কণ্ঠ বেশি চিকন, সিনেমাতে প্লে ব্যাকের জন্য না।” তিনি লতাকে বাতিল করে দিলেন। বিরক্ত রাগান্বিত হায়দার বলে বসলেন, “একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে।” হায়দার সাহেবের এই ভবিষদ্ববাণী সত্যি হয়েছে। বলিউডের তথা ভারতের গানের পাখি হিসেবে সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত হয়েছেন।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে জন্ম নেন তাদের প্রথম সন্তান হেমা। সেবন্তী দ্বীননাথের অবশ্য দ্বিতীয় স্ত্রী। পÐিত দ্বীননাথের সংগীত ও নাটক- দু’ক্ষেত্রেই ছিল সাবলীল বিচরণ। মঞ্চনাটক লিখতেন, সাথে অভিনয়ও করতেন। নাটকের প্রয়োজনে গানও গাইতেন। ‘ভাউবন্ধন’ নামের একটি নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতির। তাই সন্তানের নাম হেমা থেকে বদলে রাখা হলো লতা। বর্তমান মধ্যপ্রদেশের অধিবাসী লতা মঙ্গেশকরের পরিবারের পদবি ছিল হরদিকর। দ্বীননাথ এটিকে বদলে মঙ্গেশকর করেন, যাতে তাদের নিজেদের এলাকা গোয়ার মঙ্গেশি শহরের মানুষ বলে তাদের চিহ্নিত করা যায়।
লতা মঙ্গেশকরের পুরো পরিবারই বলতে গেলে সঙ্গীতের রথী মহারথী ছিলেন। লতার পর একে একে সেবন্তীর কোলে আসেন আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও সর্বকনিষ্ঠ হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ভাই-বোনকে অনেক ভালাসতেন লতা। প্রতিদিন নাকি ছোটো বোন আশা ভোঁসলেকে নিজের সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে রাগ করে সেই স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি। এ নিয়ে অবশ্য ভিন্ন একটি মতও প্রচলিত। স্কুলের প্রথম দিনেই নাকি শিশু লতা অন্য শিশুদের গান শেখাচ্ছিল! শিক্ষক নিষেধ করতেই ছেড়ে চলে আসেন স্কুল।
শোনা যায়, লতাকে ছেলেবেলায় গান শেখানো হলেও কোনো অগ্রগতি ছিল না তার শেখায়। ওদিকে দ্বীননাথ নিজের বাসাতেই অনেক ছাত্রকে গান শেখাতেন। একদিনের ঘটনা, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছেন দ্বীননাথ। এক ছাত্রকে বলে গিয়েছেন গানের অনুশীলন করতে। ফিরে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন ছোট্ট লতা তার ছাত্রের গানের রাগ শুধরে দিচ্ছে। তারপর থেকেই বাবার কাছে লতার তালিমের শুরু।
পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোটো ছোটো চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। একদিন দ্বীননাথের নাটকে নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতা কোনো কারণে এসে পৌঁছাননি। তার আবার গানও গাওয়ার কথা। লতা বাবাকে এসে বললেন, তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। প্রথমেই দ্বীননাথ তার প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। লতার পীড়াপীড়িতে শেষটায় রাজি হলেন। লতার অভিনয় আর গান শেষে দর্শকেরা ‘আবার চাই, আবার চাই’ বলে চিৎকার করেছিল সেদিন।
পিতার ছায়া খুব বেশিদিন থাকেনি মঙ্গেশকর পরিবারের উপর। লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন [১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ] হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার ওপর। পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে শেখালেন। মারাঠি চলচ্চিত্রে গাওয়া তার গান ‘খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ চলচ্চিত্রের ফাইনাল কাট থেকে বাদ পড়ে গেলেন। তবু দমে যাননি লতা।
মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’-এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট্ট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রে দাদা চান্দেকারের রচনা করা গান ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাল’ এ কন্ঠ দেন তিনি। তখনো চলছে তার জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। চলচ্চিত্রের জীবন-কে কখনো আপন করে নিতে পারেননি তিনি। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের জিজ্ঞাসার জবাবে জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগৎ তার আর ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করার নেই, পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। বসন্ত যুগলকরের ‘আপ কি সেবা ম্যায়’ চলচ্চিত্রে ‘পা লাগো কার জোরি’ গানটি তার প্রথম হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে গাওয়া গান।
বিনায়কের মমৃত্যুর পর সংগীতপরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু। ৮৪তম জন্মদিনে তিনি বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। গুলাম হায়দারের হাত ধরে তার জীবনে সুযোগ এল ‘মজবুর’ [১৯৪৮] চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড়ো ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’ [১৯৪৯] চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা।
সেই থেকে শুরু। তারপর শত শত গানে আপ্লুত করেছেন লাখো মানুষকে। ভালোবাসার সঙ্গে এসেছে অসংখ্য পুরষ্কার ও উপাধি। পাঁচের দশকেই গান করে ফেললেন নামীদামী সব সংগীত পরিচালকদের সাথে। ছয়ের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’-এর মতো এখনো পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয় সব গান।
একবার বেশ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। ডাক্তার জানালেন, ধীরে ধীরে রোজ কেউ বিষ দিচ্ছে তাকে। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে দেখলেন রাঁধুনি বেতন না নিয়েই পালিয়েছে। তার মতো একজন সদা হাসিমুখ কোকিলকন্ঠীকে যে কেউ মারার ষড়যন্ত্র করতে পারে, তা ছিলো কল্পনারও অতীত।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ। ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈনিকেরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন [ভারতের প্রথম] প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহেরু। সাতের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথে সাথে কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, বেশ কিছু আবার ছিল চ্যারিটিও। তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যার গান রেকর্ডকারী হিসেবে তার নাম আসে। পরে অবশ্য তার এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন নিজেরই ছোটো বোন আশা ভোঁসলে। মোট ৩৬টি ভাষায় রচিত তাঁর এই গানগুলোর অনেক ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে বাংলা গানও আছে।
বহু পুরস্কার ও সম্মাননা আছে লতার অর্জনের ঝুলিতে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরতেœ ভূষিত হন। এছাড়া ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ এবং ১৯৬৯-এ তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ অর্জন করেন তিনি। এছাড়া ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স সরকার দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করে লতাকে। এছাড়াও দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার [১৯৮৯], মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার [১৯৯৭], এনটিআর জাতীয় পুরস্কার [১৯৯৯], জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার [১৯৯৯ এএনআর জাতীয় পুরস্কার [২০০৯], শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য অর্জন আছে লতার।
শখ ছিল ফটোগ্রাফিতে, কিন্তু এখনকার এই ক্যামেরা তার আর ভালো লাগত না। ছোটো বোন আশার সাথে তার ঝামেলা চলছে এমন কথা অনেক শোনা যায়, কিন্তু তিনি বলেন উল্টোটা। আশা আর তার ধরন ভিন্ন, দুজনের গান ভিন্ন। কিন্তু বাড়িতে তাদের দুজনের ঘরের ভেতর কোনো দরজা নেই।
ভূপেন হাজারিকার সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা শোনা গিয়েছে। আজীবন তাঁর কুমারী থেকে যাওয়া নিয়ে অনেক কানাঘুষো চললেও, তিনি দিব্যি আছেন বলে বহু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। গানের রয়ালিটি দাবি করে লতা মঙ্গেশকর আর মোহাম্মদ রাফির বিবাদ চলছিল বহুদিন। লতা জানিয়েছিলেন, রাফি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু রাফির ছেলে তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন লতা। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বারবার যখন ‘আনন্দ ঘন’ নামের কাউকে ডাকা হচ্ছিল, ডকুমেন্ট বলছিল সে এখানে উপস্থিত, কিন্তু কেউ পুরস্কার নিতে উঠছিল না স্টেজে। অবশেষে লতা উঠে পুরস্কার নেন। মারাঠি চলচ্চিত্রের রহস্যময় সংগীত পরিচালক আনন্দ ঘন-এর রহস্য এভাবেই সবার সামনে আসে।
শেষ হলো এক মহিয়সীর জীবনের অধ্যায়। তিনি চলে গেছেন কিন্তু তার গান সুর রবে সারাজীবন। মানুষকে হাসাবে কাঁদাবে আগের মতোই। লতা নতুন জন্ম পেলে লতা হয়ে জন্মাতে চান নি। তিনি যদি দেখে থাকেন তিনি চলে যাওয়াতে কতটা হাহাকার তৈরি হয়েছে তাহলে তিনি হয়ত লতা মঙ্গেশকার হয়েই তার ভক্তদের মাঝে ফিরে আসতে চাইবেন...