থাইরয়েডের কারণ ও লক্ষণ -ডাক্তার আকলেছুর রহমান [তুহিন]

08 Feb 2022, 02:08 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
থাইরয়েডের কারণ ও লক্ষণ -ডাক্তার আকলেছুর রহমান [তুহিন]

বর্তমানে পৃথিবীতে থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক। অনেকে এই রোগের নাম শুনলেও বা আশেপাশে আক্রান্ত রোগী দেখলে কিংবা নিজে আক্রান্ত হলেও আমরা এই রোগ সম্পর্কে অনেকেই খুব একটা জানি না। চলুন তাহলে এই সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক ...



থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে হাজার বছর আগের দলিল বিদ্যমান। অবশ্য এই গ্রন্থির বর্ণনা ও নামকরণ পাওয়া যায় রেনেসাঁ যুগের পরবর্তীসময়ে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে চৈনিক ভাষার লিপিতে থাইরয়েডের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্র্ব সময়ে চীনে গলগণ্ড রোগের চিকিৎসায় পোড়া স্পঞ্জ ও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হতো। এই চিকিৎসাপদ্ধতি পরে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও ব্যবহার করা হয়। আয়ুর্বেদের বই ‘শুশ্রুত সংহিতা’তে ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে হাইপার থাইরয়েডিজম, হাইপো থাইরয়েডিজম ও গলগণ্ড রোগের ব্যাপারে বর্ণিত আছে। হিপোক্রেটস ও প্লেটো চার শতকের দিকে থাইরয়েড গ্রন্থিকে লালাগ্রন্থি হিসেবে বর্ণিত করেন।

১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রথম থাইরয়েডের চিত্র অঙ্কন করেন। ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আন্দ্রেয়া ভ্যাসিলাস প্রথম থাইরয়েড গ্রন্থির চিত্রসহ শারীরস্থানীয় বর্ণনা প্রদান করেন।

থাইরয়েড একটি গ্রন্থি যা আমাদের গলার সামনের দিকে থাকে। এই গ্রন্থি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন আমাদের বিপাকসহ আরো বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন তৈরির জন্য এই গ্রন্থিটির প্রয়োজনীয় পরিমাণে আয়োডিনের দরকার হয়। উক্ত হরমোন আমাদের বিপাক ক্রিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে।

১. ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন [T3]

২. থাইরক্সিন [T4]

শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের সময় এই গ্রন্থি ঠিকভাবে তৈরি না হলে কিংবা প্রয়োজনমতো হরমোন তৈরি করতে না পারলে শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

আমাদের শরীরে যতটুকু হরমোন প্রয়োজন তার চেয়ে কম কিংবা বেশি পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে তখন নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে হাইপোথাইরয়ডিজম হতে পারে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে এই হরমোন উৎপন্ন হলে হাইপারথাইরয়ডিজম হতে পারে। উভয়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

এছাড়াও উক্ত গ্রন্থিতে আরো বিভিন্ন রকমের রোগ হতে পারে। সাধারণত বেশি হয় এমন কিছু রোগ নিয়ে আলোচনা করা যাক -

* হাইপোথাইরয়ডিজম [Hypothyroidism] * হাইপারথাইরয়ডিজম [Hyperthyroidism]

* গয়েটার [Goiter] * নডিউল [Nodule] * থাইরয়েড ক্যান্সার [Thyroid Cancer] * গ্রেভস ডিজিজ [Graves’ disease]


হাইপোথাইরয়ডিজম [Hypothyroidism]

থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে তখন হাইপোথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা থাকে। যদিও অনেক সময় এর চোখে পড়ার মতো লক্ষণ দেখা যায় না, যার ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না তারা হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত।

তবে হাইপোথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো :

* ক্লান্তি কিংবা অবসাদ অনুভব করা

* কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা।

* শুষ্ক ত্বক

* কোষ্ঠকাঠিন্য

* অল্পতেই শীত শীত অনুভূত হওয়া

* পেশি এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা অনুভূত হওয়া

* বিষণœতা

* নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুশ্র্রাবের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হওয়া

* পালস রেট স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকা


হাইপারথাইরয়ডিজম [Hyperthyroidism]

এক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়ডিজম এর উল্টো ঘটনা ঘটে। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হরমোন উৎপাদন করলে হাইপারথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা থাকে।

থাইরয়েড গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি নামক এক গ্রন্থি। মস্তিষ্কের এই পিটুইটারি গ্রন্থিকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশ। এই হাইপোথ্যালামাস থাইরয়েড রিলিজিং হরমোন [TRH] নামক এক হরমোন নির্গত করে। এই TRH হরমোন-এর কাজ হলো পিটুইটারি গ্রন্থি-কে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন [TRH] নামক এক হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠানো। এই TSH হরমোন উক্ত গ্রন্থিকে থাইরয়েড হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠায়। বোঝা গেল, তাহলে এই হরমোন উৎপাদন এর জন্য শুধুমাত্র থাইরয়েড গ্রন্থি দায়ী নয়। হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থির মিলিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমণ কাজ সম্পন্ন হয়।

এখন উক্ত ৩টি গ্রন্থির যেকোনো একটি বা একাধিক গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করে ফেলে তখন ফলাফল হিসেবে যতটুকু হরমোন দরকার তার চেয়ে বেশি পরিমাণ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর তখনই বাঁধে সমস্যা। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত।


হাইপারথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায়

* অতিরিক্ত ঘাম হওয়া

* গরম সহ্য না করতে পারা

* হজমে সমস্যা হওয়া

* দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া

* অস্থিরতা অনুভব করা

* ওজন কমে যাওয়া

* পালস রেট বেড়ে যাওয়া

* ঠিকমতো ঘুম না হওয়া

* চুল পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া

* ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া

* মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব অনিয়মত কিংবা খুব অল্প পরিমাণে হওয়া

* বয়োজ্যেষ্ঠ রোগীদের ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া

খুব খারাপ অবস্থা হলে এবং হাইপারথাইরয়ডিজমের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেওয়া হলে থাইরয়েড স্টর্ম [Thyroid storm] হতে পারে। এতে রোগীর রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, জ্বর আসতে পারে এবং হৃদস্পন্দনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে


গয়েটার [Goitar]

এছাড়াও থাইরয়েড গ্রন্থিটিই বড়ো হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একে গয়েটার [Goiter] বা গলগণ্ড বলা হয়ে থাকে। যেহেতু গ্রন্থিটি হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। সেহেতু আয়োডিনের অভাব হলে গ্রন্থিটি হরমোন তৈরি করতে পারে না ঠিকভাবে। তবুও এটি চেষ্টা করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে। ফলস্বরূপ এটি নিজে বড়ো হয়ে যায় শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে। এবং একটা সময় এটি আর পারে না স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করতে। ফলে হরমোনের পরিমাণ কমে যায় প্রয়োজনের তুলনায়। এবং ফলাফল হিসেবে উক্ত ব্যক্তি হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হয়। এজন্য যেসব শিশু বা মানুষ আয়োডিনের স্বল্পতায় ভোগে তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে বর্তমানে লবণের সঙ্গে আয়োডিন গ্রহণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমে এসেছে।


নডিউল [Nodule]

এছাড়া এই গ্রন্থিতে টিউমারও হতে পারে। যাকে নডিউল [Nodule] বলে। এক্ষেত্রে এই টিউমার সংখ্যায় এক বা একাধিক হতে পারে। এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে, টিউমার হলেই সবক্ষেত্রে ক্যান্সার হয় না। তবে অবস্থা বেশি খারাপ হলে এবং কোনো চিকিৎসা না নেওয়া হলে এটি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় থাইরয়েড ক্যান্সার। 

লেখক : ডায়াবেটোলজিস্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল