গান আর মেডিকেলে পড়া দুটো এক সঙ্গে হয় না! কথাগুলো বলেছিলেন তার কাছের কিছু মানুষেরা। কিন্তু ঐশী ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। প্রবল ইচ্ছে আর ধৈর্য্য তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে। কণ্ঠশিল্পের পাশাপাশি আর একটি টাইটেলে যুক্ত হলেন মেধাবী এই মুখ। এমবিবিএস পাস করেছেন ফাতিমা তুয যাহরা ঐশী। পড়াশোনার পরের ধাপগুলো পেরিয়ে মেডিসিনের চিকিৎসক হতে চান এই শিল্পী। পাশাপাশি গানও চালিয়ে যেতে চান। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
সুরেলা কন্ঠ দিয়ে মানুষের হৃদয়ে অনেক আগেই আসন করে রেখেছেন ফাতিমা তুয যাহরা ঐশী। সব ধরনের গানেই রয়েছে তার বিচরণ। এবার মানুষের মন জয় করতে চান সেবা দিয়ে। মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষেই ঐশী বেছে নেন মেডিকেলের পড়াশোনা। বিশেষ করে অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে মেডিকেলে ভর্তি হন মেধাবী এই কন্ঠশিল্পী। শুরুর দিকে যদিও অনেকে উপদেশ দিয়েছিলেন দুটো একসঙ্গে হয় না। ঐশী এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছেন। সফলতার সঙ্গে এমএইচ শমরিতা হসপিটাল অ্যান্ড মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন তিনি। পড়াশোনার পরের ধাপগুলো পেরিয়ে মেডিসিনের চিকিৎসক হতে চান এই শিল্পী। মেডিকেলে পড়াশোনা প্রসঙ্গে ঐশী বলেন, “গানের পাশাপাশি মেডিকেলে পড়া সত্যিই কঠিন কাজ। শুরুতে অনেকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, পড়াশোনা আর গান একসঙ্গে হবে না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কাজটা আমি করে দেখাব। যদিও দুটো কাজ একসঙ্গে করা ভীষণ কঠিন ছিল। সামনে যে বিশাল পথ বাকি, সেখানেও আমি গান ও ডাক্তারি দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যেতে চাই।
ঐশী জানান, তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন, গানের জন্য যেন পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অনুষ্ঠান করতে ঢাকার বাইরে যখন যেতাম, গাড়িতে বসে বই পড়তাম। দিনে অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিতে বসেছি। প্রতিটি দিনই আমার জন্য ছিল একেক রকমের গল্প।
এইদিকে নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘ঐশী এক্সপ্রেস’ ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চ্যানেলের জন্য বেশ কিছু নতুন গান করেছেন তিনি। স¤প্রতি নিজের চ্যানেলে প্রকাশ করেছেন ‘ভালোবাসা এমনই রোগ’। গানটির সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন বাপ্পা মজুমদার, লিখেছেন সাহান কবন্ধ। এছাড়া আহমেদ হুমায়ুনের সুর ও সোমেশ্বর অলির লেখা স¤প্রতি প্রকাশিত ঐশীর আরেকটি গান ‘ঘোমটা পরা গান’। একই সঙ্গে গান ও পড়াশোনা এগিয়ে নিতে চান ঐশী
২০০০ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর শিশু একাডেমিতে গান শেখা শুরু করেন ঐশী। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালিতে মুহাম্মদ শরীফ ও পরে হাফিজ উদ্দীন বাহারের কাছে উচ্চাঙ্গ ও নজরুলসংগীতে তালিম নেন তিনি। ঢাকায় আসার পর ‘হৃদয় মিক্স থ্রি’ অ্যালবামের জন্য শিল্পী বাছাই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিযোগিতার নানা ধাপ পেরিয়ে সেরা পাঁচে জায়গা করে নেন ঐশী। এই আয়োজনের সেরা প্রতিযোগীদের নিয়ে তৈরি এক অ্যালবামে ‘দখিন হাওয়া’ শিরোনামে একটি গানে কণ্ঠ দেন তিনি। সেই থেকে শুরু। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ঐশীর প্রথম একক অ্যালবাম ‘ঐশী এক্সপ্রেস’। মায়া : দ্য লস্ট মাদার’ সিনেমার ‘মায়া’ গানটির জন্য ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন ঐশী।
গান ও পড়াশোনা কীভাবে সমন্বয় করেছেন- ঐশী বলেন, “মেডিকেলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। আবার গানের চর্চায়ও থাকতে হয়, এজন্য আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি, ক্লাশ করেছি, ক্লাশ থেকে এসেই হয়ত অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। বাসায় এসে আবার পড়াশোনা। পুরোটা সময় আমার পড়াশোনা আর গানের মধ্যেই কেটে যায়। মেডিকেলে পড়াশোনা মিস দিলেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, এজন্য আগে পড়াশোনাকে প্রাধান্য দিয়ে বাকি সময়টা গানে দিই। ক্লাশ ও পরীক্ষা বিবেচনা করে প্রোগ্রাম করে থাকি।”
কোন ধরনের গান আপনার বেশি ভালো লাগে ? ঐশী বলেন, “গান তো মুডের বিষয়। কখনো কখনো দেখা যায় রবীন্দ্রসংগীত গাইছি, তখন রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া অন্য কিছু ভালো লাগে না। আবার ভালো লাগে পুরনো দিনের গান, আধুনিক গান, ফোক গান প্রভৃতি। তবে ফোক গান আমাকে খুব টানে। আমি ফোকটাই গাই, গাওয়ার পর হয়ত ফোক ও রকের কম্বিনেশন তৈরি হয়। এককথায় ফোক গান আমি খুব পছন্দ করি।”
প্লেব্যাকে ঐশী প্রশংসা কুড়িয়েছেন, এই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। ছবিতে গান গাওয়া প্রসঙ্গে ঐশী বলেন, “ছবিতে আমার গান গাইতে ভালো লাগে। এমনিতেই গান নিয়ে আমরা নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করি। বিভিন্ন ধরনের গান করি। প্লেব্যাকেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গান গাইতে হয়। যেমন যখন প্রেমের গান করি, তখন আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে, যিনি গানটি অভিনয় করবেন তার এক্সপ্রেশন কেমন হবে, তার ঢংগুলো কেমন হতে পারে, এটা মাথায় রেখে গানগুলো গাইতে হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় আমিও সেরকম ঢং করে গানগুলো গাইছি। আবার কখনো দেখা যায় রক টাইপের গান করেছি, আইটেম, ফোক, দুঃখের গান করেছি। বিভিন্ন রকম ঢঙের গানগুলো করে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটা একমাত্র প্লেব্যাকেই সম্ভব।”
ঐশী তার আজকের এই অবস্থানের জন্যে প্রথমে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক বড়ো একটি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিয়েছেন। আর এটার জন্য তিনি আমার বাবা-মাকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছেন। কারণ, আমাকে আমার বাবা-মা যেভাবে সাপোর্ট করেছেন, সেভাবে হয়ত কেউ করতে পারতেন না। কারণ, মিউজিকে থেকে মেডিকেলে পড়া খুবই কঠিন। এত কঠিন সময় বাবা-মা’র সহযোগিতায় পার করতে পারছি। কারণ, আমার স্বপ্নের আগে বাবা-মার স্বপ্ন দেখেছেন, এ ক্ষেত্রে কিছু করবেন। তাদের স্বপ্নেই সঞ্চারিত করতে চাই। তাদের জীবনটা আর তাদের নেই, তাদের জীবনটা আমার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন তারা। এছাড়াও আমি তাদের কথা বলতে চাই যারা আমাকে সবসময় সহযোগিতা করে আসছেন, আমার শিক্ষাগুরুরা। কিন্ডার গার্ডেন থেকে শুরু করে সংগীতের শিক্ষকদের আমি স্মরণ করতে চাই। আমার স্কুল, আমার সংগীত-স্কুল সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে। এছড়াও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়াসহ সমাজের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সবার সহযোগিতা নিয়েই আমি পথ পাড়ি দিতে চাই।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এ প্রসঙ্গে ঐশী বলেন, “এখন যেভাবে দিনগুলো যাচ্ছে, এভাবেই যেন বাকি সময়টা কাটে। মানুষ আমার গান ভালোবাসে, আমিও চেষ্টা করি তাদের ভিন্ন ধাঁচের গান উপহার দেওয়ার। এটা যেন বজায় থাকে। যেহেতু মেডিকেলে পড়াশোনা করছি, গানের পাশাপাশি মানুষ যেন আমাকে ডাক্তার হিসেবেও গ্রহণ করে এবং তাদের সেবা করতে পারি। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতেই আমি ডাক্তারি পড়ছি।