রোহিঙ্গা সুন্দরী মিথিলা

16 Nov 2021, 02:17 PM কাভার গার্ল শেয়ার:
রোহিঙ্গা সুন্দরী মিথিলা

২০১৩ সালে মডেলিং দিয়ে মিডিয়ায় ক্যারিয়ার শুরু করেন তানজিয়া জামান মিথিলা। নিজেকে আরো ঝালিয়ে নিতে অংশ নেন ২০২০-এর মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায়। সেখানেও সফল হন তিনি। মিথিলার ধ্যান জ্ঞান জুড়েই ছিল মডেলিং। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনয় করার সুযোগও এসেছিল একাধিকবার। ফিরিয়ে দিয়েছেন বারবার। তবে ফেরাতে পারেন নি বলিউডের ছবির প্রস্তাবটি। সবকিছু ব্যাটেবলে মিলে গেলে অভিনয় করেন ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা ‘রোহিঙ্গা’য়। ১৫ নভেম্বর ছবিটি ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পাচ্ছে। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...


নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপনের জন্যে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা ফ্যাশন শো দিয়ে মডেল হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০২০-এর মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের তানজিয়া জামান মিথিলা। প্রথম শো করেই নজর কাড়েন অগণিত দর্শকের। শোটি করার পরেই, তার বডিল্যাংগুয়েজ, চাহনি, এক্সপ্রেশন দৃষ্টি এড়াতে পারেনি নামিদামি ব্র্যান্ড পোশাক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। খুব দ্রুতই মডেল হন দেশের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন হাউজের। মডেলিং নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছিলেন মিথিলা। অন্য কোনো অঙ্গনে কাজ করার ইচ্ছেও জাগেনি কখনো। এরমধ্যে নিজেকে আরো বড়ো পরিসরে উপস্থাপনের জন্য অংশ নেন মিস ইউনিভার্স ২০২০ প্রতিযোগিতায়। সেখানে সফল হওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকে মিথিলার জীবনধারা। সুযোগ আসে বলিউড ছবিতে। প্রথমে না করলেও ছবির বিষয় ভাবিয়ে তোলে মিথিলাকে। কয়েকদিন ভেবে ছবিতে কাজ করতে রাজি হন মিথিলা। শুরু হয় মিথিলার দ্বিতীয় ইনিংস। শুরু হয় ছবির কাজ। এর আগে প্রস্তুতি পর্বও শেষ করেন তিনি। টানা শুটিংয়ের পর ছবিটির কাজ সম্পন্ন করে মুক্তির দিনও ঠিক হয়ে যায়, বাধা হয়ে দাঁড়ায় বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শুটিংয়ের পাশাপাশি বন্ধ থাকে সিনেমা হলগুলো। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হতে থাকে মিথিলার। কবে মুক্তি পাবে এই মহামারি করোনা ভাইরাস থেকে, কবে স্বাভাবিক হবে মানুষের জীবনযাত্রা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সঠিক পরিকল্পনার জন্যে বাংলাদেশে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি কোভিড। বর্তমানে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকাংশে ভালো। এমন অবস্থায় আবার সরব হয়ে উঠছে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গন, মুক্তি পাচ্ছে নতুন ছবি। তবে, সিনেমা হলের চেয়ে ওটিটি প্লাটফর্মে এখন বেশি ছবি মুক্তি পাচ্ছে। মিথিলা অভিনীত ‘রোহিঙ্গা’ চলচ্চিত্রটিও প্রথমে বড়ো পর্দায় মুক্তির কথা থাকলেও মুক্তি দেওয়া হচ্ছে ওটিটি প্লাটফর্মে। অ্যাপেল ও সামো অ্যাপে মুক্তি পাবে এই ছবিটি। ইতোমধ্যে মুক্তির তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৫ নভেম্বর মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। ছবি মুক্তির খবরে উচ্ছ¡সিত মিথিলা।

ছবিতে মিথিলা ছাড়া বেশিরভাগ শিল্পী ও কলাকুশলী বলিউডের। ‘রোহিঙ্গা’য় মিথিলার বিপরীতে অভিনয় করছেন ‘মিস্টার ভুটান’ স্যাঙ্গে। যিনি সালমান খানের নতুন ছবি ‘রাধে’তে প্রধান ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তিনটি দেশÑ বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন ভারতের আকাশ সিং এবং ভুটানের থান্ডার ড্রাগন প্রোডাকশনের দরজি ওয়াংচুক।

ছবিটির নির্মাতা বলিউডের ‘কমান্ডো’ ও ‘দঙ্গল’ ছবির সহকারী পরিচালক হায়দার খান। ছবিতে মিথিলা রোহিঙ্গা মেয়ে হুসনে আরার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এখানে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা উপজীব্য নয়, তাদের দুরবস্থার কথাই উঠে এসেছে বলে জানান মিথিলা। ছবিটির শুটিং হয়েছে মানালি, ত্রিপুরাসহ ভারতের বেশ কয়েকটি স্থানে। রোহিঙ্গা ও হিন্দি দুই ভাষায় ছবিটির কাজ হয়েছে। ছবিতে কাজ করতে গিয়ে মিথিলাকে আরাকান ভাষাও শিখতে হয়েছে।

নিজের প্রথম ছবি মুক্তি প্রসঙ্গে মিথিলা বলেন, অবশ্যই আমি আনন্দিত। আরো খুশি হতাম যদি আমরা ছবিটি বড়ো পর্দায় দেখতে পারতাম। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌলতে মিথিলার সঙ্গে আলাপ হয় পরিচালকের। ইনস্টাগ্রামে মিথিলার ছবি দেখে মিথিলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোহিঙ্গা ছবির পরিচালক। মিথিলাকে পরিচালক জানান, তোমার চেহারাটা ইউনিক। আমি তোমার সঙ্গে কাজ করতে চাই। প্রথমে সিনেমাতে কাজ করতে না চাইলেও গল্প ও চরিত্রের কথা ভেবে কাজটি করতে রাজি হয়ে যান।

ছবিতে আরাকান ও হিন্দি দুই ভাষায় কথা বলতে দেখা যাবে মিথিলাকে। হিন্দি ভাষায় পারদর্শী। তাই সংলাপ বুঝতে আর বলতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি তার। তবে শুটিং সেটে তার জন্য একজন অনুবাদক রেখেছিলেন পরিচালক।

বলিউডের ছবি দিয়ে অভিষেক ঘটছে মিথিলার। কেমন লাগছে জানতে চাইলে মিথিলা বলেন, ছবিতে আমি একজন রোহিঙ্গা মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমার চরিত্রের নাম হুসনে আরা। অনুভূতির কথা যদি বলি, এটা অবশ্যই আমার জন্যে অনেক বড়ো অ্যাচিভমেন্ট। আমার শুরুটা হচ্ছে বলিউডের ছবির মাধ্যমে। শুধু আমার নয়, যেকোনো শিল্পীর জন্যে এটা একটা বড়ো প্লাটফর্ম। কে না চান ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্মে কাজ করতে। আমার শুরুটা হলো সেই প্লাটফর্মে, কাজেই আমি অনেক হ্যাপি।

ছবিতে নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমার ছবির যে ডিরেক্টর, উনি একজন ফটোগ্রাফার, যখন সিনেমা করার প্ল্যান করেন তখন উনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে শিল্পী নিতে। আমি আগে অভিনয় করতাম না, উনি আমাকে চিনতেন মডেল হিসেবেই। আমাকে যখন প্রথম ইনস্টাগ্রামে নক করে জানতে চাইলেন আমি অভিনয় করব কিনা।

আমি সবসময় মডেলিং নিয়েই থাকতে চেয়েছি, অভিনয় নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। পরে ভাবলাম বলিউডের একজন আমাকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে, কিছু ফুটেজ পাঠাই। আমাকে সিলেক্টও করে ফেললেন। পরে জানতে পারি আমার মতো অরো ৫২জন স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছে। সেখান থেকে আমাকে সিলেক্ট করেন। ডিরেক্টর জানালেন চরিত্রের জন্য তোমাকে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে, তাই তোমাকে নিয়ে কাজটি করতে চাই। যখন অভিনয় শুরু করে শেষ করলাম তখন আমার ধারণা পরিবর্তন হলো, অভিনয়ের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি হলো। এখন অভিনয় অনেক মিস করি।

রোহিঙ্গা চরিত্রের জন্যে কতটা প্রস্তুত, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মিথিলা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু খুব সেনসিটিভ ইস্যু। একটি চরিত্র দিয়ে পুরো রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর দুঃখ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবুও আমি চেষ্টা করেছি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে। ছবিটি করার আগেই আমি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি তাদের দুর্বিষহ জীবন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাইÑ উনি এদের আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছেন। সেই সময়ে আমি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সেখান থেকে কিছুটা অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আমাদের শুটিং যেখানে হয়েছে, সেখানে কিছু রোহিঙ্গা মেয়ে এসেছিল আমার ট্রান্সলেটার হিসেবে। ওখানে যে মেয়েগুলো এসেছিল আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ওদের জীবনধারা, ওদের জীবনের কষ্ট, ওদের নিজের কোনো পরিচয় নেই, দেশ নেই, পুরো বিষয়টা কিন্তু স্যাড। আমি ওদের লাইফ স্টাইল অনুভব করে চেষ্টা করেছি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে। হয়ত ওদের লাইফস্টাইলের দুই ভাগও দিতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা স্ট্রাগল থাকে, আমিও এর বাইরে নই। ওদের ব্যাপারটা পুরোই আলাদা। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, বিনোদন থেকে বঞ্চিত, স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। আমার চরিত্র দিয়ে ওদের পুরো কষ্ট প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবুও আমি চেষ্টা করেছি ওদের ভেতরে ঢুকে ওদের চরিত্র ধারণ করে ডেলিভারি দেওয়ার। আমার জায়গা থেকে ৮০ভাগ আমি চরিত্রে ডুবে ছিলাম। কারণ, আমাদের শুটিং যেখানে হয়েছিল ওখানে ইন্টারনেট নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আমার ফ্যামিলি-বন্ধুবান্ধবও ছিল না। অন্য একটা দেশে শুটিং করছি। সবকিছু মিলিয়ে আমি স্যাড ছিলাম। চরিত্রটাও স্যাড ছিল। রোহিঙ্গা মেয়েদের আমি ফলো করতাম। কারণ, ওরা বাংলা বলতে পারে। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতাম ওদের কী কী ফেস করতে হয়েছে। ওই অল্প সময় জেনেবুঝে আমি ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

রোহিঙ্গা ছবিটা কেন দর্শক দেখবেন এই প্রসঙ্গে মিথিলা বলেন, এই ছবির মধ্যে সবকিছু হয়েছে অ্যাকশন, রোমান্স, স্যাড, স্ট্রাগল প্রভৃতি। ম্যাসেজের কথা যদি বলি, এই ছবি দেখলে বোঝা যাবে তাদের স্ট্রাগল কী, কী কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছেন। এখনো তারা কষ্ট করছে, সবচেয়ে বড়ো ম্যাসেজ একজন মানুষ হয়ে একজন মানুষের পাশে থাকা। যতটুকু সাপোর্ট বা হেল্প করা দরকার, এই ছবিতে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ছবির একটি দৃশ্য মিথিলাকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছে, এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি দৃশ্য রয়েছে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ তুমি আমার জীবনটা এত জটিল কেন করলে ? এই দৃশ্যটি করতে গিয়ে আমি সত্যি সত্যিই কেঁদেছি। আমার সার্থকতা আমার অভিনয় দিয়ে একজন রোহিঙ্গা মেয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি।

কোভিডের সময়ে পরিবারকে সময় দিয়েছি। এই সময়টা খুবই দুরূহ একটি সময় ছিল আমার জন্য, সবাই সবার কাছ থেকে পিছিয়ে ছিলাম, প্রথম দিকে ভয় পেয়েছিলাম। সে-সময় বুঝতে পারি পরিবারের গুরুত্ব। এই সময় কিছু অসহায় মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছিলাম। মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছি। রোজার সময় প্রতিদিন ২৫০ জন মানুষকে ইফতারি দিতাম। বন্ধুদের মিস করেছি, সঙ্গে কাজও। আমি ট্রাভেলিং পছন্দ করি, সেটা মিস করেছি। করোনায় মজার মজার রান্না করতে শিখেছি। মা খুব ভালো রান্না করেন, তিনি শিখিয়েছেন। এখন আবার কাজ শুরু করেছি। নতুন বছরে দুটি ছবিতে কাজ করব। এখন ছবির কিছুই বলতে চাই না।

দর্শক সাধারণত বড়ো পর্দায় ছবি দেখতে বেশি আনন্দ পান এই প্রসঙ্গে মিথিলা বলেন, অবশ্যই বড়ো পর্দায় ছবি দেখার মজাই আলাদা। সবার মতো আমিও দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোভিড সবকিছু এলোমেলো করে দিল। আবার ওটিটিতে দেখার সুযোগও কিন্তু বেশি। কারণ, সবার হাতে হাতে মুঠোফোন। সময় বের করে দেখে নিতে পারবেন রোহিঙ্গা ছবিটি। ভবিষ্যতের কাজের প্রসঙ্গে মিথিলা বলেন, এই মুহূর্তে আমি অভিনয় নিয়েই ব্যস্ত আছি। একটু ড্যান্সও শিখে নিচ্ছি। কারণ, সিনেমায় কাজ করতে হলে তো একটু ড্যান্স শিখতে হবেই। সেই সঙ্গে অভিনয়ও।