লালন একাডেমি করার ইচ্ছে আছে আমার -নাসরিন আক্তার বিউটি

16 Nov 2021, 01:46 PM সারেগারে শেয়ার:
লালন একাডেমি করার ইচ্ছে আছে আমার -নাসরিন আক্তার বিউটি

সংগীতাঙ্গনের দীর্ঘদিনের পথচলায় লালনগীতি কিংবা লোকজ ঘরানার গান যার কণ্ঠে বেশি শোভা পায় এবং লালনগীতি যার কণ্ঠে বেশি পূর্ণতা পায়, বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তিনি লালনকন্যা বিউটি। পুরো নাম নাসরিন আক্তার বিউটি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী বিউটিকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লালনকন্যা উপাধি দিয়েছেন। তারপর থেকেই দেশের অগণিত ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন লালনকন্যা হিসেবে। আনন্দভুবনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিউটি বলেছেন নানা কথা। সেইসব কথার চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শহিদুল ইসলাম এমেল



আনন্দভুবন : এই মুহূর্তে কেমন আছেন ?

বিউটি : খুব ভালো আছি।

আনন্দভুবন : বর্তমানে ব্যস্ততা কী নিয়ে ?

বিউটি : বর্তমানে ব্যস্ততা বলতে আপনি জানেন, ওপেন স্টেজ শোগুলো তো এখন বন্ধ। এখনো আগের মতো শুরু হয়নি। তবে টেলিভিশন এবং অডিও রেকর্ডিংগুলো চলছে। আর বিভিন্ন টেলিভিশনের লাইভ শোগুলো করছি নিয়মিত। নতুন অ্যালবামের দুটো গান রেকর্ডিং হয়ে গেছে আর এর মধ্যে নতুন কিছু গান রিলিজও হয়েছে। পাশাপাশি আমার দুই ছেলে রায়াত আর রাহিলকে সময় দিচ্ছি। মোটামুটি এই আমার ব্যস্ততা।

আনন্দভুবন : আপনার এ পর্যন্ত কয়টি অ্যালবাম বেরিয়েছে ?

বিউটি : পাঁচটি সলো এবং একটা ডুয়েট অ্যালবাম বেরিয়েছে।

আনন্দভুবন : কতগুলো ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন ?

বিউটি : চারটি সিনেমায় প্লেব্যাক করেছি। আমি যেহেতু ফোক গান করি তাছাড়া ফোক রিলেটেড ছবির সংখ্যা খুবই কম নির্মিত হয়। ফোক রিলেটেড ছবি বেশি হলে হয়ত আরো বেশি ছবিতে প্লেব্যাক করার সুযোগ হতো।

আনন্দভুবন : ফোক গানের প্রতি আগ্রহী হলেন কেন ?

বিউটি : ফোক গান তো হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জুড়েই তো আছে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ফোক গান। মানে মাটির গান। ফোক গান কেন করি যদি বলেনÑ তাহলে তো আমি বলব ফোক গান আমার রক্তে মিশে আছে। কারণ লালন সাঁইজির কাছাকাছি আমার জন্ম, সেটাার একটা প্রভাব আমার ভেতর ছিলই। আমি ছেলেবেলা থেকেই চেষ্টা করতাম সব ধরনের গান গাইতে। আমি ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় আসার আগে স্টেজ প্রোগ্রাম করতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম তখন সবাই আমার গাওয়া ফোক গানই বেশি পছন্দ করত। তারপর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় এলাম তখন শ্রদ্ধেয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার আমাকে ভালোবেসে লালনকন্যা উপাধি দিলেন এবং উনি বললেন লালন সাঁইয়ের গান তুমি ছাড়বে না। তারপর জনগণও আমাকে স্বীকৃতি দিয়ে দিল ফোক গানের জন্য আমি কিছুটা হলেও যোগ্য। আর যে যেটা ভালো পারে তার সেটা নিয়েই এগিয়ে যাওয়া উচিত। একসঙ্গে সব বিষয় নিয়ে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে কোনোটাই ভালো হবে না। যেমন এখন আমি চাইলেই আধুনিক গান ভালো গাইতে পারব না। আমাকে শ্রোতারা যে গানে ভালোবাসে, আমার কাছে শ্রোতারা যে গান শুনতে চায় সেই গানই আমাকে করতে হবে। এভাবেই ফোক গানে আসা এবং ফোক গান করা।

আনন্দভুবন : লালনকন্যা হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি। পরিবার থেকে কার অনুপ্রেরণা বেশি পেয়েছেন ?

বিউটি : আমি বলব, আমার বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি। আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। আসলে আমি বেড়েই উঠেছি একটা সাংস্কৃতিক পরিমÐলে। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি বাবা ওস্তাদ রেখে বাড়িতে গান শিখেছেন এবং গানটা ছিল ওনার মনের খোরাক। কখনো স্টেজ প্রোগ্রামে গান গাননি। ছেলেবেলা থেকেই আমার বাসায় সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখে আমি অভ্যস্ত এবং সন্ধ্যা হলেই বাবা হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা, দোতারা এগুলো নিয়ে গান গাইতে বসতেন। আসলে এগুলো শুনতে শুনতেই বাবার হাত ধরেই আমার গান শেখা। তারপর বাবা দেখলেন যে, আমি যখন একটু ভালো গান করতে পারি তখন স্থানীয় ওস্তাদদের গান শেখার একাডেমিতে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের সবার অনুপ্রেরণায় আমার গানের যাত্রা শুরু।

আনন্দভুবন : ফোক গানের বর্তমান অবস্থার কথা বলুন-

বিউটি : আমি মনে করি, বর্তমানে ফোক গানের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। অন্য ধারার সংগীতের চেয়ে ফোক ধারা অনেক এগিয়ে আছে আমার মনে হয়। যেটা অনেক আগে ছিল না। তখন গতানুগতিক আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা ধারণ করতেন একটা বিষয়কে নিয়ে কিন্তু এখন ফোক গান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এখন সর্বজনীন স্বীকৃত হচ্ছে আমাদের ফোক গান। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও যেসব প্রতিযোগিতা হয় সেখানেও কিন্তু মেক্সিমাম শিল্পীরাই ফোক গান গেয়ে থাকেন। যখন ২০০৫-এ ক্লোজআপ ওয়ানে আমি তখনো কিন্তু সারেগামাপাতেও ফোক গান রিলেটেড প্রতিযোগী খুব একটা দেখিনি। কিন্তু এখন দেখেন সারেগামাপার গত কয়েকটি সিজনে অনেক প্রতিযোগীই কিন্তু শুধু ফোক গান নিয়েই এসেছে। তাও আবার আমাদের বাংলাদেশের ফোক গান। আমাদের দেশের ফোক গান গেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এখান থেকেই তো বোঝা যায়, আমাদের ফোক গান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরে কতটা প্রভাব ফেলেছে। 

আনন্দভুবন : লালন সাঁইজির ১০০টি গান নিয়ে অ্যালবাম করার কথা ছিল। সেটা কতদূর ?

বিউটি : লালন সাঁইজিকে নিয়ে যখন অ্যালবাম করার কথা ছিল তখন আসলে অ্যালবামের একটা চাহিদা ছিল শ্রোতাদের মধ্যে। তারপর হঠাৎ করেই কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইউটিউব কেন্দ্রিক হয়ে পড়লাম। ইউটিউবে তো সব সলো গান হয়। আমি বিভিন্ন জায়গায় লালনগীতি সিঙ্গেল ট্র্যাকগুলোই করি, যা মিউজিক ভিডিও আকারে বের হয়। এখন যেহেতু অ্যালবামের যুগ নেই তাই আমার নিজের চ্যানেলের জন্য লালন সাঁইজির গানগুলো আরকাইভ করে রাখব ইনশাল্লাহ। আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

আনন্দভুবন : সংগীতজীবনের একটি বিশেষ স্মৃতির কথা বলুন-

বিউটি : সংগীতজীবনে অনেক বিশেষ স্মৃতি আছে। ক্লোজআপ ওয়ান-২০০৫ ছিল বাংলাদেশের প্রথম রিয়েলিটি শো। তাছাড়া সেই সময়ে ক্লোজআপ ওয়ান দেশে এবং দেশের বাইরে খুব সাড়া ফেলেছিল। প্রতিযোগিতা শেষে আমরা যখন প্রথম আমেরিকা ট্যুরে গেলাম, নোলক তো প্রথম ছিল তাই নোলককে নিয়ে সবার একটু বেশি কৌতূহল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওখানে আমাকে নিয়ে যে মানুষের এত ভালোবাসা, এত উৎকণ্ঠা, এত এত শুভকামনা, দোয়া- আসলে ওখানে না গেলে আমি বুঝতে পারতাম না। নোলক ক্লোজআপ ওয়ান, রাজিব ২য়, আমি ৩য়। কিন্তু আমাকে মানুষ এত ভালোবাসে ওখানে না গেলে বুঝতে পারতাম না। গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ঠেলে হুড়োহুড়ি করে মানুষ আমার কাছে চলে আসে বিউটিকে একজনের দেখার জন্য। অনেকে আবার গিফট নিয়েও আসত। মানুষের জমায়েতের কারণে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। আমার প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা পাথেয় হয়ে থাকবে আমার সংগীতজীবনে। আমি দর্শকদের এই ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই।

আনন্দভুবন : সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

বিউটি : আসলে পরিকল্পনা ওইভাবে করা যায় না। ধরুন, এখন যে পরিকল্পনার কথা ভাবছি, দেখা যাচ্ছে দু’বছর পরে সেটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আসলে সংগীত নিয়েই আমার সব পরিকল্পনা। সংগীত আরো বেশি সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা থাকবে এবং লালন সাঁইয়ের গান আমি যেন আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে পারি। ভবিষ্যতে লালন একাডেমি করার ইচ্ছে আছে আমার। লালন একাডেমি বলতে সেখানে আমার একটা আর্কাইভ থাকবে একটা একাডেমি থাকবে সেখানে আমার জীবদ্দশায় চেষ্টা করব গান শেখাতে। শুধু লালন সাঁইয়ের গানের চর্চা হবে সেখানে। এই ধরনের একটা চিন্তা আমার আছে, সেটা কতদিনে সম্ভব হবে, জানি না। যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে সুস্থ রাখে চেষ্টা করব।

আনন্দভুবন : সংগীতের ওপর কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন ?

বিউটি : হ্যাঁ, আমি সংগীতের ওপর মাস্টার্স করেছি ইউডা থেকে।

আনন্দভুবন : স্বামী, সন্তান, সংসার সামলে সংগীতে সময় দেন কীভাবে ?

বিউটি : আমার কোনো সমস্যা হয়নি কখনো। আমি সমানভাবে যেমন গান চালিয়ে যাচ্ছি তেমনি সমানভাবে সংসারটাও দেখছি। এটার জন্য আমি আমার হাজবেন্ডকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, একটা মেয়ে যখন তার বাবা-মায়ের কাছে যে ফ্রিডম পায় সেটা সংসার জীবনে গিয়ে কিন্তু অন্যরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে, আমি এখনো মনে করি না যে আমি সংসার করি। কারণ, আমার স্বামী আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করে যার কারণে আমি আমার সন্তান দুটোকে সময় দিতে পারছি। এজন্য অবশ্যই আমার হাজবেন্ডকে ক্রেডিট দেব।

আনন্দভুবন : আপনার প্রিয় শিল্পী কে ?

বিউটি : অনেকেই আমার প্রিয় শিল্পী। আমি যেহেতু লালনের গান করি তাই ফরিদা পারভিন ম্যামকে আমি অনুসরণ করি। উনি আমার আইডল। তাছাড়া আমাদের গুরুজি শফি মÐল স্যার আছেন আমার ধারার। আর অন্যদের মধ্যে আছেন আমাদের রুনা লায়লা ম্যাম, সাবিনা ইয়াসমীন, সামিনা চৌধুরী, কনকচাঁপা ম্যাম, এন্ড্রুকিশোর, সুবির দা, আব্দুল হাদি স্যার।

আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

বিউটি : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।