বেগম রাজিয়া হোসাইনের ছোটদের বঙ্গবন্ধু তথ্যসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় -ইকবাল খোরশেদ

11 Oct 2021, 02:20 PM অন্যান্য শেয়ার:
বেগম রাজিয়া হোসাইনের ছোটদের বঙ্গবন্ধু তথ্যসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় -ইকবাল খোরশেদ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এই পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বই লেখা হয়েছে। তারমধ্যে শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ছেটোদের উপযোগী বইগুলোর মধ্যে শিশুসাহিত্যিক বেগম রাজিয়া হোসাইন রচিত ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ স্বতন্ত্রমাত্রায় উজ্জ্বল। সহজ-সরল ভাষা ও অনবদ্য উপস্থাপনরীতি, অধ্যায়ের বিন্যাস, আকার-আয়তন, কলেবর, প্রচ্ছদ, ভেতরে সংযোজিত ছবি- সবকিছু মিলে বইটি শিশুকিশোরদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও তথ্যসমৃদ্ধ। 

বেগম রাজিয়া হোসাইন তাঁর ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ বইটিতে গল্প বলার ভঙ্গিতে অত্যন্ত সংক্ষেপে অথচ বিস্তৃতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বংশ পরিচয়, তাঁর জন্ম, শৈশব-কৈশোর-যৌবন, তাঁর রাজনীতিতে জড়িত হওয়া, দীর্ঘ তেইশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন স্বদেশভ‚মিতে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট তাঁকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনা ছোটোদের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজের অজান্তেই ঘুরে বেড়ান টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, কলকাতা, ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বিচরণ ক্ষেত্রে, পথে-প্রান্তরে ও কারাগারের অন্তরালে। ছোট্ট বন্ধুরা কখনো সাঁতার কাটেন মধুমতি বা তার শাখা বাইগার নদীর জলে। কখনো-বা বঙ্গবন্ধুর সাথে ফুটবল নিয়ে ছুটে চলেন খেলার মাঠে।   

বেগম রাজিয়া হোসাইনের ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ বইটি মোট নয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়টি অনেকটা পুরো বইয়ের ভ‚মিকার মতো। পিওনি নামের ছোট্ট এক বন্ধুর নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে এই গল্পের অবতারণা এবং পিওনির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে রাজিয়া হোসাইন বলে চলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানা ঘটনা ও প্রসঙ্গ। এই অধ্যায়েই লেখক ছুঁয়ে যান ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনা এবং সেই রাতে নিষ্ঠুরতার শিকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ সন্তান ১০ বছরের রাসেলের প্রসঙ্গ। প্রথম অধ্যায়টি লেখক শেষ করেন তাঁর লেখা ‘শ্রাবণ রাত্রি কাঁদে’ কবিতা দিয়ে। 

বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শৈশব তুলে ধরেছেন এবং লেখকের মেধাবী ও শিল্পিত প্রয়োগে বঙ্গবন্ধু যে তাঁর প্রিয় টুঙ্গিপাড়ায় চিকালের জন্য শুয়ে আছেন তা জানিয়ে দিয়েছেন। লেখকের বর্ণনা স্মরণযোগ্য : “টুঙ্গিপাড়া এখন রূপশালী গ্রাম। এখানেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং এখানেই বুক জুড়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আজীবন তাই থাকবেন।

ছোটবেলায় পড়াশোনার জন্য গোপালগঞ্জ যাওয়ার পথে শেখ মুজিবের কী মন খারাপ। বাবা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। বললেন, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, মানুষের সেবা করতে হবে। তাই টুঙ্গিপাড়ার চেয়ে ভালো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি- ওখানে স্কুল অনেক বড়, অনেক ভালো। মুজিবের বুক ফাটা কান্না, টুঙ্গিপাড়া ছেড়ে যাওয়া তার জন্য কষ্টকর। বললেন, ‘এই টুঙ্গিপাড়ায় আবার আমি ফিরে আসবো আব্বা। তারপর আর কোথাও যাবো না। কোথাও না...’। ”

তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন ডানপিটে এক মুজিবের সঙ্গে, যে তার দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাঁতরিয়ে নদী পার হয়। মাছ ধরে, বৃষ্টিতে ভেজে, গাছে চড়ে। এর পাশাপাশি লেখক আমাদের জানান, কেমন করে শেখ মুজিবুর রহমান সকলের ‘মিয়া ভাই’ হয়ে ওঠেন এবং ‘মিয়া ভাই’ থেকে কী করে লোকে তাঁকে ক্রমে ‘মুজিব ভাই’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করে সেসব কথা।   

‘তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছে। সুভাষ বোসের দলের সঙ্গে ভিড়ে যান মুজিব’ -এই বাক্য দিয়ে শুরু হয় বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়। মুজিব তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই অধ্যায়ে কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের দুই গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এবং সাখওয়াৎ উল্লার প্রসঙ্গ এবং কিশোর শেখ মুজিবের জীবনে তাদের প্রভাবের কথা উঠে আসে। এই অধ্যায়ে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন স্বদেশী আন্দোলন এবং এর পুরোধা সংগ্রামী মাস্টারদা সূর্যসেন, সুভাস চন্দ্র বসু আর গান্ধীজির সাথে। সেই সময়ে যে মুসলিম সমাজের অবস্থা ভালো ছিল না সে-কথাও আমরা জানতে পারি রাজিয়া হোসাইনের লেখায়। এই সময়ে মুজিব মুসলিম ছাত্রদের জন্য ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র মাধ্যমে ‘এক মুঠো চাল’ সংগ্রহের প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং সেই চাল বিক্রির টাকা দিয়ে গরিব মুসলিম ছাত্রদের বই খাতা কলম কিনে দেবার ব্যবস্থা করেন। লেখক আমাদের একথাও জানাতে ভোলেন না যে, মুজিব ‘পঞ্চব্রতে’ দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। পঞ্চব্রত হলো : জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য ও আনন্দ। ‘জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তিনি কৈশোরের এই নীতিশিক্ষাকে মেনে চলেছেন’। এই অধ্যায়েই পিওনি এবং আমরা যারা তার সঙ্গী, জানতে পারি কেমন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা ও আলাপ হয়েছিল এবং কী কারণে তিনি কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি লিখেছিলেন। 

পঞ্চম অধ্যায়ে বেগম রাজিয়া হোসাইন আমাদের সাহসী ও নির্ভীক এক কিশোর শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হিন্দু-মুসলমানে তখন মারামারি হতো প্রায়ই মুজিবের এক সহপাঠী বন্ধু আবদুল মালেককে ধরে নিয়ে গেলে মুজিব দলবলসহ তাকে ছাড়াতে যান। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও প্রায় মারামারির উপক্রম হয়। একপর্যায়ে মুজিবুরের দল দরোজা ভেঙে তার বন্ধুকে উদ্ধার করে। এই ঘটনায় মুজিবুর ও তার দলের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যায়। পরিচিত এক পুলিশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ‘কিশোর মুজিব সেদিন মাথা উঁচু করে বলেছিলেন, যাবো না, আমি পালাবো না, লোকে বলবে আমি ভয় পেয়েছি। অথচ ন্যায়ের জন্য আমি এসেছি’। পালিয়ে যাননি কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান। সেই শুরু হলো মুজিবের হাজতবাস। 

ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্কুল-উত্তীর্ণ শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতার জীবন, ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের জীবন, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষ এবং সেই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ত্রাণ কাজে যুক্ত হওয়া, ১৯৪৭-এর দেশ ভাগ এবং দেশভাগ পরবর্তীকালে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি এবং বিশ্বিবিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির সমর্থনে আন্দোলন এবং অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে ছাত্রত্ব হারানো- জিন্নাহ’র ‘উর্ধই হবে রাষ্ট্রভাষা’- এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা এবং কারাবরণ প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। 

সপ্তম অধ্যায়ে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা-আন্দোলন, সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাস, ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিক-এর সভায় ‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রাদেশিক নাম পূর্ব-পাকিস্তানের পরিবর্তে হবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’ ঘোষণা করা, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সামুদ্রিক জালোচ্ছ্বাস, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫-এ মার্চের গণহত্যা এবং সেই রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা, পাকিস্তনের কারাগারে বন্দিজীবন, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। 

অষ্টম অধ্যায়ে লেখক রাজিয়া হোসাইন বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের জীবনে ১৪ বছরের কারাবাস, ৭ই মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গ, ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিরাপদ স্থানে প্রেরণসহ আমাদের জাতীয় জীবনে চারটি বিশেষ দিন ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ, ২৫-এ মার্চ, ২৬-এ মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বর-এর কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। 

নবম অধ্যায়ে আগের আটটি অধ্যায়ের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত চমৎকার একটি কবিতা দিয়ে শেষ করেন ছোটদের বঙ্গবন্ধু :

‘ঘাতক ওরা কেড়ে নিয়ে প্রাণ

তোমাকে করেছে চির অম্নান

চারিদিকে তাই মুজিবের ঢল

অতন্দ্র নির্ভীক, তুমি চিরঞ্জীব

    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’

বইটি প্রকাশ করেছে পালক পাবিশার্স। প্রকাশ কাল মার্চ ২০২১। মূল্য ২০০ টাকা। 


একনজরে বেগম রাজিয়া হোসাইন

বেগম রাজিয়া হোসাইনের জন্ম ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ, বিএড-ও করেছেন। সরকারি চকিরি থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ ক’বছর আগে। এখন লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫৫। শিক্ষা-সাহিত্য ও সমাজসেবার জন্য তিনি জাতীয় ও অন্যান্য পর্যায়ে মোট ৩৫টি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ খ্র্রিষ্টাব্দ জাতীয় পর্যায়ে ‘বেগম রোকেয়া’ পদক প্রাপ্তি তাকে বিশেষ মর্যাদায় সম্মানিত করেছে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি লেখালেখি করেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তার ভাবনা ও প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকতা জীবনে সুদীর্ঘকাল কাজ করার সুবাদে তিনি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে লেখার জগতে। ছোটদের হাসি-আনন্দ, উৎসাহ-উদ্দীপনা, কৌতূহল এবং জানার আগ্রহ সম্পর্কে তার জানার জগৎ বিস্তৃত বিশাল। শিশুদের জন্য তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২ ডজনেরও বেশি।