আমার আমি -ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু

10 Oct 2021, 01:45 PM অন্যান্য শেয়ার:
আমার আমি -ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু

আমার জন্ম পুরান ঢাকার লালবাগে, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে। পুরান ঢাকার নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে, আমরা নতুন ঢাকার মানুষেরা বলি, সেটা সভ্য সমাজের নয়। এরকম একটা কথাবার্তা আচরণের মধ্যে দিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। তারপরেও আমাদের পারিবারিক শিক্ষার কারণেই হয়ত এবং আমাদের পারিপার্শ্বিক কিছু ভালো মানুষের কারণে সেই অশ্লীলতা আমরা ত্যাগ করতে পেরেছি। পুরান ঢাকার মানুষদের কথার মধ্যে যে অশ্লীল ভাষা ব্যবহৃত হয় সেটা তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক বিষয় কিন্তু সভ্য সমাজে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের ছেলেবেলা খুব আনন্দের ছিল, মধুর ছিল। কারণ, আমরা বেড়েই উঠেছি একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। আমাদের অগ্রজ যারা ছিলেন তারা আমাদের কবিতা আবৃত্তি, নাচ, অভিনয়, খেলাধুলা, সুকুমারবৃত্তিচর্চা এই মাধ্যমগুলোর সঙ্গে সবসময় জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ছেলেবেলায় আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের কথা, আমার মনে আছে, ১৯৭৩, ’৭৪, ’৭৫ এই সময়গুলোতে আমরা আমাদের বড়ো ভাইদের নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংকলন বের হতো, লিটল ম্যাগাজিন বের হতো, সেগুলোর মূল্য নির্ধারিত ছিল পঞ্চাশ পয়সা, বারো আনা, এক টাকা এবং ১৯৭৬-’৭৭-এ এর মূল্য দু’টাকা হলো ঠিক এইরকম সময়ে আমরা সারারাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম শহিদ মিনারের আশেপাশে। তখন আমরা ভাষা আন্দোলন কী, ভাষা সংগ্রম কী কিছু বুঝতাম না। এগুলো বলছি আমি আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের কথা। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আমি সরাসরি ক্লাশ থ্রিতে ভর্তি হই। তখন আমাদের পাড়ায় [ষান্মাসিক] বছরে দু’বার সংস্কৃতি প্রতিযোগিতা হতো। একবার একটা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হই। সেটা সম্ভবত ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের বছর। সেই প্রতিযোগিতায় আমি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙ্গে ফুল’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলাম। আর পুরস্কার হিসেবে যে বইটি পেয়েছিলাম সেটি ছিল কাবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর লেখা। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সেটি বইটির নাম সম্ভবত ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’। আমার পরিণত বয়সে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে যখন পরিচয় হয় এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যখন আমি তাঁকে পাই, তখন তাঁকে আমার এই স্মৃতির কথাটি বলার সুযোগ হয়েছিল।

এরপর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর স্কুলের বিভিন্ন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম, কখনো আমি উপস্থাপনা করেছি, আবৃত্তি করেছি, বিজ্ঞানমেলায় অংশ নিয়েছি এরকমভাবে আমি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলাম। তারপর স্কুলের শেষ দিকে এসে ‘অভিযাত্রীক’ কিশোর নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হই। ‘অভিযাত্রীক’ তখন বাংলাদেশের শিশুদের নাটকের দলে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তীসময়ে আমি যখন কলেজে চলে যাই তখন নাট্যদল ‘ঢাকা নাট্যম’র সঙ্গে জড়িত হই। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এসে আমি প্রাতিষ্ঠানিক অভিনয় এবং আবৃত্তি শিক্ষা গ্রহণ করি। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আমার আবৃত্তি গুরু, তাঁর সংগঠন ‘কথা আবৃত্তিচর্চা কেন্দ্রে’। তারপর কার্জন হলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আমি অংশ নিই। আমি সরাসরি যাদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি- যেমন নাটকের ক্ষেত্রে সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামালউদ্দিন নীলু, সালেক খান, কামরুজ্জামান রুনু। আর সেই সময় সবচেয়ে বেশি সান্নিধ্য পেয়েছি প্রয়াত সৈয়দ মহিদুল ইসলামের কাছে। তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রথম [এনএসডি] ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে ২৫ বছরের সাংস্কৃতিক চুক্তি হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যাওয়া এবং তারই অংশ হিসেবে প্রথম নাট্যশিক্ষা গ্রহণ করতে যিনি যান তিনি সৈয়দ মহিদুল ইসলাম। তাঁর কাছে আমি অভিনয়ের অ আ ক খ শিখি এবং ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পরিচালিত স্কুল অব অ্যাক্টিং যেটি ধানমন্ডি ২ নম্বরে, জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হতো, সেখানে আমি অংশ নিই এবং আমার জীবনে আমি যত কর্মশালা করেছি সবগুলোতেই কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছি। কৃতিত্ব বলতে আমি বলতে চাইছি, সবগুলো কর্মশালাতেই প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছিলাম। এই কারণেই এইসব গুণী ও প্রাজ্ঞজনদের নজরে আমি পড়েছিলাম। তারপর আমি সৈয়দ মহিদুল ইসলাম পরিচালিত ‘ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী’র সঙ্গে জড়িত হই। আমি মঞ্চনাটকে সক্রিয়ভাবে ব্যতিক্রমের সঙ্গে ১৯৮৭-’৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করি। পরবর্তীসময়ে আমি লোকনাট্যদল টিএসসির সঙ্গে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে যুক্ত হই এবং সেখানে আমি ভারত সরকারের বৃত্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘লোকনাট্যদল’ টিএসসির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তারপর ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে চলে যাই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। সেখানে আমি বিশেষ সম্মান নাটকে এবং পরবর্তীসময়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। 

এরপর ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে এসে কিছু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। এখানে একটা কথা বলতে চাই, এটা আমার সৌভাগ্য, এটা আমার খুব বড়ো রকমের একটি পাওয়া যে, আমি সবচেয়ে কম বয়সী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। যখন আমি প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিই, তখন আমার বয়স মাত্র ত্রিশ বছর। সেই সময়ে তারা আমাকে দিয়ে প্রথম ১৫ দিনের নাট্যকর্মশালা এবং ১৫ দিনের আবৃত্তি কর্মশালা শুরু করেন। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন- এই কারণে যে, তারা আমাকে দিয়ে প্রথম আবৃত্তির কর্মশালা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু করে এবং সেই সিলেবাসও শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে আমি তৈরি করি। বিাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সেই অনুযায়ীই কিন্তু এখন দেশব্যাপী আবৃত্তি কর্মশালা পরিচালনা করে। আমাকে অনেক সুযোগ তারা দিয়েছে। ২০ থেকে ২৫টি জেলায় শিল্পকলা একাডেমি আমাকে পাঠিয়েছে আবৃত্তি এবং অভিনয়ের কর্মশালার জন্য। আমি এই সুযোগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

এখন আসি বাংলাদেশ টেলিভিশনে কথায়, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আমার অডিশন প্রক্রিয়া করা হয়। তারপর ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এসে সেখান থেকে অর্ধেক বাছাই করে মৌখিক পরীক্ষা হয়। ১৯৯০-এর শুরুতে এসে স্ক্রিন টেস্ট হয় এবং সেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার প্রতিযোগী ছিল। সেখান থেকে আমরা মাত্র ৪৫জন চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হই। তারপর বাংলাদেশ বেতার, সেটা তো আরো কঠিন। বাংলাদেশ বেতারেও আমরা একই সময়ে তালিকাভুক্ত নাট্যশিল্পী হিসেবে যুক্ত হই। এরপর আমরা একটা বৈরী সময় দেখতে পেলাম। ওই বৈরী সময়টাতেও ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমি কিছু কাজ করেছি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে সিলেটে দেহের ভাষার একটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলাম, সেটির শিরোনাম ছিল ‘অতঃপর তবুও’। এটা সিলেটের ‘সন্ধানী নাট্যচক্র’ আমাকে কাজটি করার সুযোগ দিয়েছিল। এরপর গাজীপুরের শিল্পকলা একাডেমির দেড় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আমি একটি নাটক করেছিলাম। সেটা অলোক বসুর লেখা নাটক ‘সংরুদ্ধ সময়’। মাহমুদুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘খেলাঘর’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন অলোক বসু। তারপর ঢাকায় একটা কাজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে ওঠেনি। এটা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। এটি আমি খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বিষয়টি এখানে উল্লেখ করতে চাই। এই কথাটি আমি এতদিন বলিনি। এখন বোধহয় বলা উচিত। ‘নাট্যজন’ নামের একটি নাটকের দল ওরা আমাকে দিয়ে একটি নাটকের নির্দেশনা এবং পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল। আমি তাদের সঙ্গে প্রায় তিন মাস কাজ করেছিলাম আমার পিএইচডি গবেষণাকালীন। তখন হঠাৎ আমার সুপারভাইজার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভারতে চলে গেলাম। আমি চলে যাওয়ার একসপ্তাহ পরেই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। আমার কাছে একটা বিষয় বিস্ময়কর লাগল যে, আমি নাটকের নির্দেশনা দিলাম অথচ যখন নাটকটি মঞ্চস্থ করল তখন নির্দেশকের নাম দেখলাম ভিন্ন দু’জনের। আমার নাম নেই। এটি নিয়ে পরবর্তীসময়ে আমি আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। তারা এটার সুরাহা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই, তারা সেই সময়ে সুরাহা করে দিতে পারেনি বলে আজকে এখন পর্যন্ত অনেক অনেক সমস্যা তারা মোবাবিলা করছে। যাই হোক, এটা একটা ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল আমার। বলে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করলাম।

তারপর ২০০১-এ যখন একটা সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে পরাস্ত করে তারা সরকার গঠন করল এই সময়টায় আমরা যারা প্রগতিশীল, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষ, যারা বেতার, টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত শিল্পী তাদের কালো তালিকাভুক্তি করার কারণে আমি শেষ পর্যন্ত আর টিকতে পারিনি। আমি ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে পিএইচডি করার জন্য দেশ ত্যাগ করি। তারপর আমি ২০০৮-এর নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে আমার পিএইচডির থিসিস সম্পন্ন করি। এটি আমি করেছি ‘লোকনাটক’র ওপর। এটিকে আমরা বলি আমাদের যাত্রাপালা, আমাদের গীতিকা এগুলোর ওপর। এটা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পন্ন করি এবং ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ডিগ্রি পাই। তো এই সময়ে আমি যে মধ্যবর্তী সময় পেরিয়ে এলাম ১৯৯৮ থেকে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে পিএইচডি করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সময়ে আমি বেশ কয়েকটি নাটক নির্দেশনা দিই। তার মধ্যে আমি আগেই বলেছি গাজীপুরে একটি, সিলেটে একটি, ঢাকায় একটি। ঢাকায় তিনটি দলের সঙ্গে কাজ করেছি। পদাতিক নাট্যসংসদ, দৃষ্টিপাত এবং লোকনাট্যদল। ‘পদাতিক নাট্যসংসদ’ তখন ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা ‘চৈতন্যের দ্রোহ’ নামে সাইকো অ্যানালেটিক্যাল একটি ড্রামা করে। এটির রচয়িতা ছিল শামীম আহসান এবং নির্দেশনায় ছিলাম আমি। এরপর দৃষ্টিপাতের সঙ্গে একটি কাজ করি। তাঁরা করেছিল আবদুল হালিম আজিজের লেখা ‘মানুষ সংবাদ’। এটি ছিল একটি গণনাটক। আরেকটি ছিল আমাদের ‘লোকনাট্যদল’র সাওতাল বিদ্রোহের ওপর। এটির নাম ছিল ‘হুল’। ‘হুল’ মানে বিদ্রোহ, সংগ্রাম। এটি শামীম আহসানের লেখা। মোটামুটি এই কাজগুলো করে আমি চলে যাই। 

বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠনকালে সেখানে আমি যুক্ত ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে। ১৯৮৭-তে আমরা কাজ শুরু করি এবং ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে এসে এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এখানে কিছু কাজ করার সুযোগ হয় এবং তারপর তৎকালীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম, সেখানে আমি আমার মতো ভূমিকা পালন করি। কখনো আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে, কখনো নাট্যকর্মী হিসেবে, কখনো আবার রাজনৈতিককর্মী হিসেবেও। এছাড়া আমাদের আবৃত্তির দল ‘কজনা’র মাধ্যমে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সঙ্গে কাজ করি। এবং সর্বশেষ আমি ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সংগঠনটির [১৯৯২-এর কাউন্সিলে] আমি সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই। এরপর ভারতে চলে যাওয়ার কারণে সেখানে আমি অনুপস্থিত হয়ে পড়ি এবং একটা দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৮-এ ফেরত আসি। তারপর আবার আমি আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের নির্বাহী সদস্য হিসেবে কাজ করি। এখন আমি আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে যুক্ত আছি। 

আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব, কবি, প্রাবন্ধিক শেখ হাফিজুর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একটি আবৃত্তি সংগঠন তৈরি করি। এর নাম হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ’। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রয়াত কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী এবং আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এরপর কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীর প্রয়াণের পর সভাপতি হিসেবে পাই শিক্ষাবিদ, নাট্যজন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী স্যারকে। এভাবেই আমরা সারাদেশে কাজ করে চলেছি। দেশের ৬৪ জেলাতেই এখন আমাদের শাখা-সংগঠন রয়েছে এবং জাতীয়ভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ বার্ষিকী, জাতীয় শোকদিবস এবং ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে যে সমস্ত ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে সেগুলো আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা নিরলসভাবে করে চলেছি। বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ এই দুঃসময়টায় আমি রাজনৈতিককর্মী, সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির যে আন্দোলন, নেত্রী সাবজেলে যখন বন্দি ছিলেন, তখন কবি আসলাম সানী এবং আমি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে কবিদের লেখার জন্য বলতাম, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে কাজ করেছি, যেটা অনেকেই সাহস করেনি। আমরা এমনভাবে তাদের প্ররোচিত করেছি এবং [আমি পজেটিভভাবেই বলছি কথাটা] লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি আমরা। এরকম বেশ কিছু লেখা নিয়ে আমি একটা সিডি প্রকাশ করি ‘জনতার উক্তি, শেখ হাসিনার মুক্তি’ নামে। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন এবং এটি পাঠ করেছিলেন প্রয়াত কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। সেটি একটি কাজ, এরপর আমাদের নেত্রী যখন সরকারের দায়িত্ব নিলেন তখন তাকে নিয়েও বিভিন্ন ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করেছি। সেটি নিয়ে আমার দু’টো সিডি হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিবেদন করে। তার একটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্রের মানস কন্যা’ আকেরটি হচ্ছে ‘মানবতার জননী শেখ হাসিনা’। তাছাড়া ‘বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ’র কার্যক্রম করতে গিয়ে আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা তাতে আমি অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি। যার কারণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার এককভাবে সিডি রয়েছে কুড়িটি আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৫-৬টি। সব মিলিয়ে আমার ২৬-২৭টি সিডি রয়েছে যার অধিকাংশেরই বিষয় বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমার এইসব সিডি বেরিয়েছে। যখন আমি এখানে কথা বলতে পারছিলাম না, এটা ছিল ২০০৩ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ। তখন ৩-৪টি সিডি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেরিয়েছে। আর আবৃত্তি বিষয়ক আমার একটি শিক্ষামূলক গবেষণা গ্রন্থ বেরিয়েছে সেটির নাম ‘আ-তে আবৃত্তি’ আর অভিনয়ের ওপর আমার একটি শিক্ষামূলক গবেষণা গ্রন্থ বেরিয়েছে, সেটার নাম ‘অ-তে অভিনয়’। বাংলাদেশের সব জেলাতেই তাদের পাবলিক লাইব্রেরিতে বইদুটো চোখে পড়বে। এই বই দুটোর ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় পৃষ্ঠপোষকতা করার যে জায়গাগুলো সেখানে সহযোগিতা করেছে আমার প্রকাশককে। এজন্য আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার ঋণ স্বীকার করছি। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার পরিচালনা, পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় সম্প্রচারিত হচ্ছে ‘কবিতার দিক দিগন্ত’ আর বাংলাদেশ বেতারে ‘কবিতার কথকতা’। বাংলাদেশ বেতারে বর্তমানে আমার প্রযোজনায় এবং আমার বন্ধু, বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী, লেখক, নাট্যকার ও সম্পাদক ইকবাল খোরশেদের রচনায় ‘সবুজের অভিযান’ নামে একটি কিশোর-উপযোগী ধারাবাহিক নাটক প্রচার হচ্ছে। আর লেখালেখি বলতে মাঝখানে বেশ কিছুদিন দৈনিক জনকণ্ঠে নাটকের রিভিউ লিখতাম। সেটার ওপরে একটি বই আছে ‘বাংলাদেশের নাটক, নাট্যসমালোচনা’। সেটা ২০০৩-২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেরিয়েছিল। তাছাড়া আমার নিজস্ব গবেষণাধর্মী গ্রন্থ আছে, যার নাম ‘ময়মনসিংহ গীতিকা সমাজচিত্র ও শিল্পরূপ’। ছড়া-কবিতা মিলে আমার বইয়ের সংখ্যা কুড়িটি। অতিসম্প্রতি আবৃত্তিশিল্পীদের নিয়ে একটি সর্বোচ্চ ফোরাম ‘বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ’ গঠিত হয়েছে। যার আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী। আমি যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে যুক্ত আছি। কর্মসূত্রে আমি বাংলা একাডেমিতে উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত। 

অনুলিখন : শহিদুল ইসলাম এমেল