জয়ের ছন্দে ফেরা

20 Sep 2021, 12:04 PM সারেগারে শেয়ার:
জয়ের ছন্দে ফেরা

২০০১ সালে ‘সাদা কাফন পরাইয়া’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশের মাধ্যমে সংগীতের অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেছিলেন জয়। নানা জটিলতায় পরে গান গাওয়া থেকে দূরে থাকেন। প্রায় দুই দশক পরে আবার গানে ফিরে এসে ছন্দ ফিরে পেয়েছেন সংগীতশিল্পী জয়। একের পর এক প্রকাশ পাচ্ছে তার কণ্ঠের নতুন নতুন গান। গেল ঈদে সাউন্ডটেক থেকে প্রকাশিত হয় কবির বকুলের কথায় ও উজ্জল সিনহার সুরে ঝিলিকের সঙ্গে তার দৈত কণ্ঠের গান ‘শুধু ইচ্ছে হয়’। চলতি মাসেই প্রকাশ পাবে বিন্দুকণার সঙ্গে তার আরেকটি গান। জয়ের সংগীতভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন নিথর মাহবুব ...

‘ছোটবেলা থেকেই গানের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমার বড়ি যশোহর জেলার সদর থানার উসমানপুর গ্রামে। আমার দাদা ছিলেন একজন সংগীতপ্রিয় মানুষ। তিনি ভায়োলিন বাজিয়ে গান করতেন। আমার পরিবারের মধ্যে আমার ছোট ভাই একজন গীতিকার। তার নাম লক্ষণ কুমার। আমি প্রথমে গান শিখি যশোরের কিংশুক সংগীত একাডেমিতে। সেখানে আমি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেই।’ আড্ডার শুরুতেই বলছিলেন সংগীতশিল্পী জয়। করোনায় লকডাউন শুরু হওয়ার পর অবসর পেয়ে অনেক বছর পরে আবার নিজের কণ্ঠের গান প্রকাশের ইচ্ছে জাগে জয়ের। পরপর প্রকাশ করলেন কয়েকটি গান। সেই গানে নতুন করে সংগীত অঙ্গনের মানুষদের নজরে আসেন এই জয়। এর মধ্যে কবির বকুলের লেখা এবং উজ্জল সিনহার সুরে একটি ডুয়েট গান করেন সেরা কণ্ঠের ঝিলিকের সঙ্গে। সেটি ঈদে প্রকাশ হলে জয়ের ভরাট কন্ঠ আরও অনেক মানুষের নজরে আসে। এর মধ্যে সালমা ও বিন্দু কণার সঙ্গে গেয়েছেন নতুন আরও দুইটি গান। ক্লোজআপ তারকা সালমার সঙ্গে গাওয়া গানটির শিরোনাম ‘প্রেমের বাঁশি’ আহম্মেদ রিজভির লেখায় এর সুর ও সংগীত আয়োজন করছে সুমন কল্যাণ। বিন্দু কনার সঙ্গে গাওয়া গানটির শিরোনাম ‘নজর দিও না গো’। গানটির কথা ও সুর করেছেন রবিউল হাসান এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন মান্নান মোহাম্মদ । জয় জানান, ২০০১ সালে ‘সাদা কাফন পরাইয়া’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশের মাধ্যমে সংগীতের অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। প্রায় দুই দশক পরে গানে ফিরে যেন নিজের মধ্যে ছন্দ ফিরে পেয়েছেন। জয়ে’র কাছে জানতে চাইলাম- কেমন উপভোগ করছেন বর্তমান সময়টা। উত্তরে তিনি বললেন, ‘প্রথমে আমি খুলনা বেতারে এনলিস্টেড হই পল্লিগীতির শিল্পী হিসেবে। বেতারে এনলিস্টেড হবার পর আমার গানের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। আমার গ্রাম শহরের মানুষরা রেডিওতে আমার গান শুনে উৎসাহ দিতে থাকে। আমার মাও আমাকে গান করার জন্য খুব উৎসাহ দিতে থাকেন। তখন থেকেই মনের ভিতরে শিল্পী হবার স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে। এত বছর পরে সেই স্বপ্ন যেন আমার জীবনে উকি দিচ্ছে। আমার গাওয়া প্রকাশিত নতুন গানগুলোর সুবাদে এখন সংগীত জগতের অনেক বড় বড় নামি-দামি মানুষদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, বেশ উপভোগ করছি সময়টা। করোনার কারণে সময়টা এখন খারাপ, তা না হলে সময়টা আরো উপভোগ্য হতো। অনেক স্টেজ শো করতে পারতাম।’ গানের বিষয়ে জয়ের মা তাকে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতেন। কিন্তু সেই মা আজ পৃথিবীতে নেই। জয়’র জীবনে এ এক বিশাল অপূর্ণতা। মায়ের প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে জয় বলেন, ‘মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে আমি একসময় ঢাকায় আসা-যাওয়া শুরু করি। বিভিন্ন গীতিকার সুরকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকি। সে অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা। একেকজন একেক ধরনের কথা বলতেন। অবশেষে আমার প্রথম অ্যালবাম ‘সাদা কাফন পরাইয়া’ বের হয় মিল্টন খন্দকারের কথা ও সুরে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো আমার মা সেটা দেখে যেতে পারেননি। অ্যালবামের জন্য আমি স্টুডিওতে প্রথম যেদিন ভয়েজ দিতে আসি ; সেদিন ভয়েজ দেওয়া অবস্থায় খবর আসে আমার মা মারা গেছেন।’ 

জয়ের বাবাও গান ভালোবাসতেন তবে ওভাবে জয়কে কখনো উৎসাহ দিতেন না। তিনি ভাবতেন গানের নেশায় পড়লে ছেলের পড়া-লেখা হবে না। বাবা চাইতেন পড়ালেখা করে ছেলে ভালো চাকরি করবে। তবে মা’র অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন ভালো শিল্পী হবে। মায়ের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে, ২০০১সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন জয়।

জয় বলেন, ‘ঢাকায় চলে আসলে তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে অডিশন দিয়ে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তালিকা ভুক্ত হই। তারপর ডিজিটাল মিউজিক নামে একটা অডিও কোম্পানি থেকে কামাল হোসেন নামে একজনের মিক্সড অ্যালবামে গান করি। সেই অ্যালবামে এন্ড্রু কিশোর, কনকচাঁপা, মমতাজের গানও ছিল। গানের পিছনে ছুটতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করে আর্থিক সংকটে পড়ে যাই। তখন গান করা বাদে ঢাকায় আমার আর কোনো কাজ ছিল না। যেহেতু আমার চিন্তা ভাবনা ছিল সংগীত নিয়ে তাই প্যাড ড্রামপ্যাড্রাম্স বাজানো শিখলাম কিছু একটা করে টিকে থাকার জন্য। কিন্তু ভাটা পড়ে আমার গান গাওয়াতে। তবে প্যাড ড্রাম বাজানোর সুবাদে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ হলো। সিঙ্গাপুর, দুবাই, ওমান, কাতার, জাপান, মালয়েশিয়ায় শো করি। ইন্ডিয়াতে অনেক শো করি। এভাবে যখন আর্থিক টানাপোড়েন কাটল ততদিনে মোবাইলে গান শোনার যুগ চলে আসে। আবার বিভিন্ন প্রতিযোগিতাসহ নানা মাধ্যমে অনেক অনেক শিল্পীদের আগমন ঘটতে থাকে। অপরদিকে অডিও সিডির বাজারে ধস নামল। শিল্পীরা ইউটিউবে নিজেরাই গান প্রকাশ করতে লাগল। যার ফলে সাধারণভাবে গান গেয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিংই হয়ে যায়।’

জয় যখন দেখলেন নিজের স্বপ্ন পূরণের আর কোনো সম্ভবনা নেই ; তখন তিনি চিন্তা করলেন তার মতো যারা বড় শিল্পী হতে ঢাকায় এসে সংকটে কর্মহীনতায় ভোগে তাদের জন্য কিছু একটা করবেন। তাই নিজেই একটা প্রেক্টিস প্যাড দিলেন। যার মাধ্যমে অনেকেরই এখানে কাজ করার সুযোগ হয়। এর বাইরে কালচারাল ইভেন্টের যেমন গায়ে হলুদ, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব নিতে থাকেন। অনেক শিল্পীদের আয়ের সুযোগ হলো এসব অনুষ্ঠানে গান করে। জয়ও অনুষ্ঠানগুলোতে শিল্পীদের সঙ্গে গাইতে থাকেন। 

জানতে চাইলাম এই সময়ে এসে ছন্দ ফিরে পাওয়ার প্রসঙ্গে। এবার সংগীত শিল্পী জয় বলেন, ২০২০ সালে মহামারি করোনা সারা পৃথিবীর মানুষ হতাশা ও আতঙ্কে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে শুরু করল। আমাদের শিল্পী কলাকুশলীরাও বেকার হয়ে গেল, প্রেক্টিস প্যাডের শিল্পী কলাকুশলীদের নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমি আমার প্রেক্টিস প্যাড থেকে নিয়মিত গানের আসর জমাতে শুরু করি, কখানো কাওকে দিয়ে, কখনো লাইভে গিয়ে, কখনো রেকর্ড করে সেগুলো অনলাইনে প্রচার করে ঘরবন্দি মানুষদের আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করি। এরই মধ্যে আমার ছোট ভাই লক্ষণ কুমার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে একটা গান লিখে। গানের শিরোনাম ‘ক্ষমা চেয়েছি ক্ষমা করে দাও’। সময়োপযোগী গানটি আমার ভালো লাগল এবং নিজেই গেয়ে ফেলি। গানটি প্রচার করার পর অনেক সাড়া পেতে থাকি। বিভিন্ন সুরকার গীতিকররা তখন আমাকে গান করার প্রস্তাব দিতে শুরু করেন। আমিও আবার সাহস করে মাঠে নামি। এর মধ্যে প্রকাশ হয়েছে ‘দোষ’, ‘কাল নাগিনী সুমী’, ‘আজ এই বৃষ্টিতে’, ‘ভালোবাসার বাজি’, ‘বাবা আমার বাবা’ শিরোনামে গানগুলো। এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গানের অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ডাক পাচ্ছি। আজীবন আমি গান নিয়েই থাকতে চাই, গানের বাইরে আমার আর করার কিছু নেই।