গানের জগতে লম্বা সময় টিকে থাকতে হলে চর্চার বিকল্প নেই -বেলাল খান

24 Aug 2021, 01:02 PM সারেগারে শেয়ার:
গানের জগতে লম্বা সময় টিকে থাকতে   হলে চর্চার বিকল্প নেই  -বেলাল খান

বেলাল খান বাংলাদেশের এই সময়ের একজন জনপ্রিয় গায়ক। শুধু গায়কই নন, প্রতিভাবান এই মানুষটি একাধারে সুরকার ও সংগীত প্রযোজক। ২০১৪ সালে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ চলচ্চিত্রে ‘নিশিপক্ষী’ গানের জন্য সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি নিয়মিতই চলচ্চিত্র, মিক্সিড অ্যালবাম এবং নাটকের টাইটেল সংগীত তৈরি ও সেগুলোতে কণ্ঠ দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি তার মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত দুটি গান পাখি ও শূন্য হৃদয়। করোনাকালে গান নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে সংগীত জগতের অবস্থা, নিজের কাজ ও ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আনন্দভুবনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাতেমা ইয়াসমিন...

আনন্দভুবন : এই করোনাকালে কেমন আছেন ?

বেলাল খান : এখনো বলতে পারছি ভালো আছি। আসলে এই করোনার সঙ্গে তো আমাদের বসবাস প্রায় দুই বছর হলো। প্রথম দিকে যে আতঙ্ক ছিল, এখন যে তা একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু সকলেই হয়তো বুঝে গেছে আসলে আমাদের করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে। এর মধ্যেই কাজকর্ম এগিয়ে নিতে হবে। 

আনন্দভুবন : যেহেতু কাজের কথা বললেন ! বর্তমানে আপনার কাজের অগ্রগতি বা কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন ?

বেলাল খান : সম্প্রতি আমার দুটি গান রিলিজ হয়েছে। প্রথমটি ‘পাখি’ শিরোনামে যেটি রোজার ঈদে মুক্তি পায়। এটিতে আমার সহশিল্পী ছিলেন লিজা। গানটির সুর আমি নিজেই করেছি, কথা লিখেছেন সুমা কে মাহমুদ। গানটি আমার ইউটিউব চ্যানেল থেকেই রিলিজ হয়। তিনমাসে গানটির ভিউ আসে ১২ মিলিয়ন। আর এই দুদিন আগে আমার আরেকটি গান রিলিজ হয় রঙ্গন মিউজিক ব্যানারে ‘শূন্য হৃদয়’ শিরোনামে। এই গানটির সুরও আমার করা। কথা লিখেছেন জামাল হোসেন। মেলোডি ধাঁচের এই গানটিও দুদিনে বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। 

আনন্দভুবন : আপনি এক সময় অনেক স্টেজ প্রোগ্রাম করেছেন, এখন তো তা  বন্ধ ! স্টেজ মিস করেন কি না ?

বেলাল খান : আমি আসলে স্টেজ শো খুব মিস করি। যেকোনো শিল্পীর জন্যই স্টেজ প্রোগ্রাম বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি দর্শক শ্রোতাদের অভিব্যক্তি, ভালোবাসা দেখতে পাওয়া যায়। যা শিল্পীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই যে বেশ কিছু গান এই করোনাকালে করেছি, তা করে সরাসরি ভক্ত, শ্রোতাদের সামনে গাইবো তার জন্য মুখিয়ে আছি।

আনন্দভুবন : আপনার ছেলেবেলা, পরিবার নিয়ে জানতে চাই

বেলাল খান : আমার ছেলেবেলা বেশ সবুজ ছিল বলতে পারেন। টাংগাইলের সখিপুরের নলুয়া গ্রামে আমার জন্ম। এই গ্রামটির চারপাশে কিছু পাহাড় পাহাড় টাইপ জায়গা রয়েছে, সবুজ বনাঞ্চল, সবুজ ক্ষেত, ছোটো ছোটো খাল-নদী বলতে পারেন ছবির মতো এই গ্রামীণ পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা। আমার গায়ক হওয়া বা গান গাওয়ার পেছনে আমার গ্রামের পরিবেশের অবদানও রয়েছে। সারাদিন গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে গান-বাজনা। সন্ধে হলেই মা-বাবার বকুনি খেয়ে ঘরে ঢোকা। আমার বাবা লুৎফর রহমান খান ও মা বেদেনা রহমান। তিন ভাইবোনের মধ্যে আমিই সবার বড়ো। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমি গ্রামেই কাটিয়েছি। 

আনন্দভুবন : গানের প্রতি কীভাবে আগ্রহী হলেন ? পরিবারের কেউ কি জড়িত সংগীতজগতের সঙ্গে ?

বেলাল খান : গানের প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। গান গাইতে ভালো লাগত, শুনতে ভালো লাগত। তখন তো ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ ছিল। সেগুলোর প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। গ্রামের যে বড়ো ভাইয়েরা ছিল গান করতে পারত, তাদের আশেপাশে থাকতে ভালো লাগত, নিজেও ওদের সঙ্গে গুনগুন করে গাইতাম। কোনো অনুষ্ঠান হলেই ওদের ডাক পড়ত, ওদের সমাদরের চোখে দেখতো। মানে অনেকের মাঝে গানের জন্য তারা একটু বেশি খাতির-ভালোবাসা পাচ্ছে এই বিষয়টি আমার ছোটো মনে বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমার এক মামা ছিলেন, তিনি ফোক গান নিয়ে কাজ করতেন। উনি কোনো অনুষ্ঠানে গান করলে সারা গ্রামে আগেই মাইকিং হতো। এই বিষয়গুলো আমাকে বেশ নাড়া দিত। তাছাড়া সকলের মুখে শুনতাম আমার গলা বেশ ভালো। সেই থেকেই মূলত আমার নেশার মতো হয়ে যায় গান গাওয়া। আমি গায়কই হবো, পরবর্তীসময়ে এমন ছিল মনোভাব। 

আনন্দভুবন : সেক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট বা ভূমিকা কেমন ছিল ?

বেলাল খান : আসলে গানের ক্যারিয়ার কেমন হবে বা এই সম্পর্কে আগে তেমন ধারণা ছিল না তাই হয়তো মা-বাবা বিষয়টি পছন্দ করতেন না। তারা চাইতেন আমি পড়ালেখা করে চাকরি-বাকরি করি। তবে তারা যে খুব বাধা দিয়েছেন তাও নয়। আমি জানতাম আমি যদি সফল হই তাহলে এই বিষয়গুলো আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাই আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। 

আনন্দভুবন : সংগীতের ক্যারিয়ার বা স্ট্রাগল পিরিয়ডের শুরু কীভাবে ?

বেলাল খান : গান গাইতে হলে গায়ক হতে হলে আমাকে ঢাকায় আসতে হবে এটা আমি জানতাম। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকায় চলে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। শুরু হয় হলের জীবন। আমি খুঁজতে থাকি আশেপাশের কারা গানের সঙ্গে জড়িত। আস্তে আস্তে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। বেইলি রোডের স্টুডিও পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতাম। সেই সুবাদেই মনির খানের সঙ্গে পরিচয়। তখন থেকেই আমি গান লিখতাম ও নিজেই সুর দিতাম আর তা ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করে রাখতাম। আমি বাংলাদেশ বেতারে কিছুদিন কাজ করি। কিন্তু আমার যে স্বপ্ন ছিল গান নিয়ে তা পূরণ হচ্ছিল না। তাই সেটি ছেড়ে দিই। ‘প্রাচীর’ নামে একটি ব্যান্ডদল করি। বিভিন্ন স্টেজ পারফর্মেন্স করতাম। ২০০৯ সালে মনির খান ও বেবী নাজনীনের দুটি অ্যালবামে সুর করার মাধ্যমে আমার এই জগতে পথচলার সূচনা। এরপর আরো কিছু কাজের সুযোগ হয়। কিছু নাটকের গান সুর করা, ভয়েস দেওয়া এমন। যে গানটি আমাকে পরিচিতি এনে দেয় তা হলো ‘পাগল তোর জন্য’ যা রিলিজ হয় ২০১১ সালে। এরপর কাজের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়। মিউজিক কোম্পানি থেকে আমার একক অ্যালবামের জন্য যোগাযোগ করতে থাকে। আমার প্রথম অ্যালবাম রিলিজ হয় ২০১২ সালে। অ্যালবামের নাম আলাপন। যা লেজার ভিশনের ব্যানারে নির্মিত হয়। অ্যালবামের ‘এক মুঠো স্বপ্ন’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ইতোমধ্যে অনেক চলচ্চিত্রেও গান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমি প্রায় ৩৫টির মতো চলচ্চিত্রে গান করেছি। সর্বশেষ ‘দিন দ্যা ডে’ সিনেমাতে আমি কণ্ঠ দিয়েছি। এর পরেও কিছু কাজ হয়েছে তা সবই এখনো মুক্তির অপেক্ষায়।

আনন্দভুবন : কোন ধরনের গান আপনার পছন্দের ?

বেলাল খান : একেক ধরনের গানের মজা একেক রকম। তবে মেলোডি গান আমার সব সময়ই ভালো লাগে। পরিচ্ছন্ন কথা, স্বচ্ছ সুর যে গান মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে সেধরনের গানই ভালো লাগে। মানুষ মেলোডি গান সবসময়ই পছন্দ করে, আমার ধারণা মেলোডি গানের আবেদন সবসময়ই থাকবে।

আনন্দভুবন : নবীন শিল্পীদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন ?

বেলাল খান : আমাদের সময়ে আমরা অনেক স্ট্রাগল করেছি। গানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য এখনকার মধ্যে এত প্লাটফর্ম ছিল না। রাতারাতি তারকা হওয়ার মতো ইচ্ছে সুযোগ কোনোটাই ছিল না। নতুনরা যেন গানটা ভালোবেসে গায়। সবার হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ সামর্থ্য নাও থাকতে পারে, কিন্তু পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। গান নিয়ে সময় দিতে হবে। গানকে জানতে হবে। গানের জগতে লম্বা সময় টিকে থাকতে হলে চর্চার বিকল্প নেই। যুগের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের গানকে তুলে ধরতে হবে। 

আনন্দভুবন : ছেলেবেলায় যে স্বপ্ন দেখতেন, গান নিয়ে, আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে তা নিয়ে কী বলবেন ?

বেলাল খান : আমি ছেলেবেলা থেকে গানই করতে চেয়েছি। আমি বলব, আমার অবস্থান নিয়ে সুখী। গান গাইছি, সুর দিচ্ছি, কথা লিখছি। যতটুকু সাফল্য বা জনপ্রিয়তা সবই গান থেকেই এসেছে। গ্রামে গেলে এখন আমাকেও একটু অন্যভাবে দেখে লোকেরা, গর্ব করে। ছেলেবেলায় তো এতটুকুই চেয়েছিলাম। 

আনন্দভুবন : লকডাউনে পরিবারের সঙ্গ কতটা উপভোগ করছেন ?

বেলাল খান : আমি বলবো দারুণ সময় কাটাচ্ছি আমরা। মা-বাবা গ্রামে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। ঢাকায় আমি আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকছি। অন্য সময়ে বাইরে ব্যস্ত থাকি। তেমন সময় হয়ে ওঠে না সবাই একসঙ্গে গল্প করার। ছেলেমেয়ে তো দারুণ খুশি আমাকে সবসময় বাসায় পেয়ে।

আনন্দভুবন : কাল্পনিক এক প্রশ্ন করি ! যদি গায়ক না হতেন তাহলে কোন পেশা বেছে নিতেন ?

বেলাল খান : আমি অন্য কিছু হবো কখনো চিন্তা করিনি। এখন নেশা, পেশা দুটোই গান। আসলে অন্য কিছু করার চিন্তা আসে অর্থনৈতিক আরো সমৃদ্ধির জন্য। সেক্ষেত্রে বিজনেস করলে করা যায়। হয়তো ভবিষ্যতে করতেও পারি। দেখা যাক।

আনন্দভুবন : করোনা সংগীতজগতকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে করেন ?

বেলাল খান : আসলে বলতে গেলে এখন পুরো পৃথিবীর চিত্রই বদলে দিয়েছে। সব সেক্টরই কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সংগীতেও তার প্রভাব পড়েছে। ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে সবাই। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ঘরে বসেও আমরা গান রিলিজ দিচ্ছি। আমরা আশাবাদী, এ ক্ষতি আমরা খুব শিগগিরই মিটিয়ে ফেলব।

আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

বেলাল খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।